সীমান্তজুড়ে জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) যেসব হামলা চালাচ্ছে, তার ফল ভালো হবে না বলে পাকিস্তান সরকার আবারও কাবুলের তালেবান কর্তৃপক্ষকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। দুই বছর আগে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পরপরই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও সরকারের নেতারা শক্ত ভাষায় তালেবানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, আফগানিস্তানের মাটি যাতে সন্ত্রাসীরা বাইরের দেশগুলোতে হামলা চালানোর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, বিষয়টি তালেবানকে নিশ্চিত করতে হবে।
এরপর অনেকবার তালেবানকে পাকিস্তান একই হুঁশিয়ারি দিয়েছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে যে সম্পর্ক উত্তরোত্তর খারাপের দিকে যাচ্ছে, এই হুঁশিয়ারি তার সর্বশেষ আভাস। গত সপ্তাহে বিবৃতি দিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ‘আফগানিস্তানে সন্ত্রাসীদের মুক্তধাম ও অভয়ারণ্য’ হয়ে উঠছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
দোহা চুক্তিতে (২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে যেটি হয়েছিল) তালেবান যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা যাতে মেনে চলে, এ বিষয়ে তাগিদ দিতে কোয়েটায় পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির প্রথম তালেবান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে তিনি তালেবানকে বলেছিলেন, আফগানিস্তানের অভ্যন্তর থেকে কোনো ধরনের হামলা হলে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ‘কার্যকর প্রতিক্রিয়া’ দেখাবে।
গত সোমবার কোর কমান্ডার সম্মেলনের পর আরেকটি বিবৃতি জারি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘টিটিপির সহযোগী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যগুলো... সন্ত্রাসীদের কাছে সর্বাধুনিক অস্ত্র থাকা (সম্মেলনের) নজরে এসেছে, যা পাকিস্তানের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে ইসলামাবাদকে একটি আঞ্চলিক বিকল্প নিয়ে কাজ করতে হবে। তাকে একটি সমন্বিত আঞ্চলিক কৌশল তৈরি করতে হবে, যাতে কাবুলের ওপর সম্মিলিত চাপ দেওয়া সম্ভব হয়। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান-চীন-আফগানিস্তান মিলে একটি নিরাপত্তা ফোরাম গড়তে হবে।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফের মন্তব্য আরও কঠোর ছিল। তিনি দোহা চুক্তির প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তালেবান ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, আফগানিস্তান চুক্তির শর্ত মানতে ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রতিবেশী দেশের নিরাপত্তা হুমকি ঠেকাতে দৃশ্যমান আন্তরিকতা দেখাচ্ছে না। তিনি বলেছেন, আফগান মাটিকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে এবং এটি বন্ধ করতে পাকিস্তান অবশ্যই তার সর্বোচ্চ সক্ষমতা প্রয়োগ করবে।
১২ জুলাই বেলুচিস্তানের ঝোব শহরে সেনাচৌকিতে চালানো হামলায় নয়জন সেনা জওয়ান নিহত হন। ওই একই দিনে বেলুচিস্তানেরই সুই এলাকায় আরেকটি হামলায় তিনজন সেনা নিহত হন। এ ঘটনার পর পাকিস্তানের দিক থেকে ধারাবাহিকভাবে হুঁশিয়ারিমূলক বক্তব্য আসতে থাকে। সর্বশেষ এই হামলাগুলো যেখানে হয়েছে, জায়গাটি আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকা। মূলত খাইবার পাখতুনখাওয়া এলাকায় টিটিপি ঘাঁটি গেড়ে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা তাদের তৎপরতা বিস্তৃত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সেনাদের সংঘাতের কারণে বেলুচিস্তানে নাজুক অবস্থা চলছে, তার মধ্যে টিটিপির এই তৎপরতা সরকারকে অনেক বেশি ভাবিয়ে তুলেছে। তালেবান কাবুল দখল করার পর থেকেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো তাদের হামলা বাড়িয়ে দিয়েছে।
গত মে মাসে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফাঁস হওয়া একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কাবুল টিটিপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী নয় এবং তাদের আশ্রয়–প্রশ্রয়েই টিটিপি সম্প্রসারিত হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রুপটি এখন পুরোমাত্রায় পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে, যা পাকিস্তানের নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি পর্যবেক্ষক দলের ধারাবাহিক প্রতিবেদন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে তালেবানের কাবুল দখলে আফগানিস্তানে থাকা যেসব বিদেশি চরমপন্থী গোষ্ঠী উপকৃত হয়েছে, তাদের মধ্যে টিটিপি সবচেয়ে বেশি উপকার ভোগ করেছে। টিটিপিকে লক্ষ্য করে ও তাদের কিছু জ্যেষ্ঠ নেতাকে নির্মূল করার লক্ষ্যে পাকিস্তান ইতিমধ্যেই অঘোষিত পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এটি একটি কার্যকর পদ্ধতি নয় এবং এর সুস্পষ্ট ঝুঁকি ও ত্রুটি রয়েছে।
এ বিষয়ে ইসলামাবাদকে একটি আঞ্চলিক বিকল্প নিয়ে কাজ করতে হবে। তাকে একটি সমন্বিত আঞ্চলিক কৌশল তৈরি করতে হবে, যাতে কাবুলের ওপর সম্মিলিত চাপ দেওয়া সম্ভব হয়। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান-চীন-আফগানিস্তান মিলে একটি নিরাপত্তা ফোরাম গড়তে হবে।
ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত
● মালিহা লোধি পাকিস্তানি কূটনীতিক, যিনি এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন