৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগই যে আবার ক্ষমতাসীন হবে—আগে থেকেই তা অনুমেয় ছিল। ফলে নির্বাচনের পর কোন দল সরকার গঠন করবে তা নিয়ে নয়; বরং কারা বিরোধী দল হবে, সেটিই কিছুটা আগ্রহ তৈরি করেছিল।
কেউ কেউ বলেছিলেন, এ নির্বাচন ‘বিরোধী দল খোঁজার নির্বাচন’। এমনকি বিদেশিরাও নির্বাচনের এই ‘অভিনবত্ব’ নিয়ে সচেতন ছিলেন। এ কারণে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদলের সদস্যরা জানতে চেয়েছিলেন, সংসদে বিরোধী দল কে হবে? (বিরোধী দল কে হবে জানতে চেয়েছেন ইইউ প্রতিনিধিরা, সমকাল, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩)
৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বেশ দ্রুততার সঙ্গে সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। নতুন সরকারও গঠিত হয়েছে; কিন্তু সংসদে বিরোধী দল কারা হবে—এ প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি। বিরোধী দল খুঁজে পেতে এ বিলম্বের দৃশ্যমান কারণ কী?
পূর্বানুমিতভাবে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি (২২৩টি) আসন পেয়েছে । এ ছাড়া জাতীয় পার্টি ১১টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি ১টি করে আসন পেয়েছে। অপরদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন ৬২টি আসন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রাপ্ত মোট আসনসংখ্যা জাতীয় পার্টির চেয়ে বেশি হওয়ায় বিরোধী দল কারা হবে তা নিয়ে ‘গোল’ বেঁধেছে।
আমাদের সংবিধানে বিরোধী দল হওয়ার শর্ত বা যোগ্যতা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালিবিধি অনুসারে প্রচলিত রীতি হলো, যে দল বা ‘জোট’ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাবে, তারাই বিরোধী দল হবে এবং দলটি যাকে নেতা নির্বাচিত করবে, তিনিই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হবেন।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অবশ্য বলেছেন, মোট আসনের (৩০০) কমপক্ষে এক-দশমাংশ অর্থাৎ ৩০টি আসন না পেলে রীতি অনুযায়ী সেটিকে বিরোধী দল বলা যায় না। ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি, বিরোধী দলগুলো ২টি এবং স্বতন্ত্ররা ৫টি আসন পেয়েছিল। সেই সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো দলকে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
জাতীয় পার্টি না ‘স্বতন্ত্রদের জোট’—কাকে এবার সংসদে বিরোধী দল করা হবে, তা হয়তো কিছুদিনের মধ্যে জানা যাবে। কিন্তু এটা এখন স্পষ্ট যে এদের মধ্যে যাকেই এবার বিরোধী দলের স্বীকৃতি দেওয়া হোক, তাদের কেউই প্রকৃত অর্থে সরকারের বিরোধী পক্ষ নয়। ফলে এবারের সংসদে যারাই আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দল হোক না কেন, বাস্তবে তাঁরা হবে একটি ‘অনুগত’ কিংবা ‘ডামি’ বিরোধী দল।
সংসদে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতির ক্ষেত্রে মোট আসনের এক-দশমাংশ আসন পাওয়ার প্রচলিত রীতি সব সময় মেনে চলা হয়নি। গত সংসদে (একাদশ) ২২টি আসন নিয়েও জাতীয় পার্টি এবং চতুর্থ সংসদে ১৯টি আসন নিয়ে কপ (কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিজ) বিরোধী দলের স্বীকৃতি পেয়েছিল।
এ দুটি উদাহরণ থেকে স্পষ্ট—রীতিনীতি ছাড়াও কখনো কখনো রাজনীতিও সংসদে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। এবারও কি তেমন কিছু হতে যাচ্ছে?
এবারের নির্বাচনের জয়ী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য অনেকেরই সরকারি দল আওয়ামী লীগের পদ-পদবি রয়েছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ থেকে সংসদে ‘বিরোধী দল’ হতে অপারগতার কথা জানিয়েছেন। (বিরোধী হতে রাজি নয় স্বতন্ত্ররা, দেশ রূপান্তর, ৯ জানুয়ারি ২০২৪)।
তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। দু-একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য স্বতন্ত্রদের জোট করে ‘বিরোধী দল’ গঠনের কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা বা অনুমোদনেরও কথা উল্লেখ করেছেন। (প্রধান বিরোধী দল গঠন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা, প্রথম আলো, ১৩ জানুয়ারি ২০২৪)।
এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একই রকম কথা বলেছিলেন। (বিরোধী আসনে কে বসবে, সিদ্ধান্ত নতুন প্রধানমন্ত্রীর: ওবায়দুল কাদের, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৮ জানুয়ারি, ২০২৪)
সংসদ সদস্য ও সরকারি দলের নেতাদের এমন বক্তব্যের পর যে প্রশ্নটি সামনে আসে, তা হলো বিরোধী দল কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর কোনো এখতিয়ার আছে কি না। আগেই বলা হয়েছে, এ বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা নেই, যা কিছু আছে তা সংসদের কার্যপ্রণালিবিধিতে। কার্যপ্রণালিবিধির অনুচ্ছেদ-২ এর উপ-অনুচ্ছেদ (১) এর (ট) দফায় বলা হয়েছে,‘‘‘বিরোধীদলের নেতা’’ অর্থ স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত, ক্ষেত্রমতে দল বা অধিসঙ্গের নেতা৷’
কার্যপ্রণালি বিধি থেকে স্পষ্ট যে সংসদে বিরোধী দল কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নয়; বরং স্পিকারের ভূমিকা রাখার বিষয়ে বলা হয়েছে। এর চেয়ে বড় কথা, কার্যপ্রণালি বিধি অনুসারে বিরোধী দলকে সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতা করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, জাতীয় পার্টি বা স্বতন্ত্রদের জোট— এই দুইয়ের মধ্যে যাকেই বিরোধী দলের স্বীকৃতি দেওয়া হোক, তাঁরা কি সত্যি সত্যি সরকারের বিরোধিতা করতে পারবে?
দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টিকে সংসদের বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ দলটি কার্যকরভাবে সরকারের বিরোধিতা করেছে—এমন কোন দৃষ্টান্ত নেই। তারা সরকারের একটি ‘অনুগত’ বিরোধী দল হিসেবে কাজ করেছে, এমনকি সরকারের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
অপরদিকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের বেশির ভাগই সরকারি দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। একটি ‘বিশেষ’ পরিস্থিতিতে এরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে সরকার এবার ‘ডামি প্রার্থী’ কৌশল অবলম্বন করেছিল। এই ‘ডামি প্রার্থী’ কৌশলের ফল হিসেবে তাঁদের অনেকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
জাতীয় পার্টি না ‘স্বতন্ত্রদের জোট’—কাকে এবার সংসদে বিরোধী দল করা হবে, তা হয়তো কিছুদিনের মধ্যে জানা যাবে। কিন্তু এটা এখন স্পষ্ট যে এদের মধ্যে যাকেই এবার বিরোধী দলের স্বীকৃতি দেওয়া হোক, তাদের কেউই প্রকৃত অর্থে সরকারের বিরোধী পক্ষ নয়। ফলে এবারের সংসদে যারাই আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দল হোক না কেন, বাস্তবে তাঁরা হবে একটি ‘অনুগত’ কিংবা ‘ডামি’ বিরোধী দল।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক