সন্তান সবচেয়ে নিরাপদ মা-বাবার কাছে, পরিবারের হেফাজতে। বসতবাড়ির চেয়ে অভয়ের আশ্রয়ও তো আর কিছু হতে পারে না। অথচ ৪ বছরের শিশু আহাদ যখন গুলিবিদ্ধ হয়, তখন তার দুই পাশে মা-বাবা তো ছিলেনই, ছিল সে নিজেদের ঘরেও। মা-বাবা বুঝতেও পারেননি তাঁদের সঙ্গে থাকা আদরের সন্তান কেন আচানক মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল! আহাদদের বাসাটি একটি বহুতল ভবনের আটতলায়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকার সেই বাসার বারান্দায় ১৯ জুলাই বিকেল চারটার দিকে গুলি ছুটে এসে আহাদের ডান চোখে ভেদ করে মাথার ভেতর আটকে যায়। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে শিশুটি এক দিন হৃদ্যন্ত্র সচল রাখতে পেরেছিল। ২০ জুলাই রাত সাড়ে আটটার দিকে সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। নাকি বলা ভালো, এ ‘পোড়া দেশ’ ছেড়ে চলে যায়!
আহাদের হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের সচল থাকার আওয়াজের কি কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি হয়েছে? বাবার কাঁধে সন্তানের লাশের ওজন যে কতটা ভারী, তারও কিছু আন্দাজ কি আছে এ রাষ্ট্রযন্ত্রের?
কবি সুকান্ত যদি নবজাতকের কাছে ‘এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে’ যাওয়ার ‘দৃঢ় অঙ্গীকার’ না-ও করে যেতেন, তবু কোনো মা-বাবাই তাঁদের সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার আন্তরিক চেষ্টার এতটুকু ত্রুটি রাখতেন না। তাঁদের কারণে অন্যের সন্তানের সামান্যতম হানি হোক, তা-ও তাঁরা কস্মিনকালে চাইতেন না। শিশুদের জন্য এ কেমন ‘বাসযোগ্য বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ করা হয়েছে যে বাবার কোলে বুলেটবিদ্ধ হয় সন্তান!
১৯ জুলাই দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায় চারতলা বাসার ছাদে ৬ বছরের রিয়ার দিকে ছুটে আসে বুলেট, সেটি ঢুকে পড়ে তার মাথার ভেতরে।
এরপর সন্তানকে বাঁচাতে মা-বাবাসহ স্বজনদের আপ্রাণ ছোটাছুটি, প্রার্থনা, চিকিৎসকদের আন্তরিক চেষ্টা। সব ব্যর্থ! ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর কিছুটা আশার আলোও দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ২৪ জুলাই সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যায় রিয়া। অপঘাতে সন্তানের এমন করুণ মৃত্যুর শোক কি মা-বাবা কোনো দিন ভুলতে পারবেন? সব অমানিশা কাটিয়ে সহজ দিনের সহজিয়া সূর্যের আলোও কি তাঁদের শোকের ছায়া ঘোচাতে পারবে এতটুকু? রাষ্ট্রের কাছে হয়তো এর জবাব আছে।
যৌক্তিক ও ন্যায়ের ভিত্তিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনটি ছিল শান্তিপূর্ণ। পরে সেটিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ছড়ায়। রক্ত ঝরে, সম্পদের বিনাশ হয়। কার ঘরে লাগা আগুনে কে আলু পুড়িয়ে খাবে, ক্ষমতামুখী রাজনীতির সেই হিসাব যাঁরা বোঝেন, তাঁদের ভাষ্য, ব্যাখ্যা যেমনই হোক; বাড়ির আঙিনায় বুলেট কেড়ে নেবে নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ, এ কেমন রাষ্ট্র! এ কার পাপ, কিসের পাপ?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিয়ার মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়েছে ‘গানশট ইনজুরি’। একই কথা ১১ বছরের সামিরের মৃত্যুসনদে লেখা হয়েছে কি না, জানা নেই। তবে মিরপুরের কাফরুলে ঘরের জানালা বন্ধ করতে গেলে গুলি ছুটে এসে শিশুটির চোখ দিয়ে ঢুকে মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। ১৯ জুলাইয়ের ঘটনা। জানালা দিয়ে টিয়ার শেলের ধোঁয়া ঢুকছিল ঘরে। পড়ার টেবিল জানালার পাশেই। তাই জানালা বন্ধ করতে গিয়ে প্রাণ হারায় সামির। সে সময় ঘরে থাকা তার ১৭ বছরের কাকা মশিউরের কাঁধেও গুলি লাগে।
সামিরের বাবা আইনের দ্বারস্থ হননি। কেন? তিনি জানান, স্থানীয় মুরব্বিরা বোঝাতে থাকেন, সন্তানের লাশ দ্রুত দাফন করা বাবা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব। আইনি জটিলতায় যাওয়ার দরকার নেই। তাই ‘মামলা করব না, অভিযোগ নেই’ লিখে থানা থেকে চলে আসেন। যদিও রাতেই একদল তরুণ হাসপাতালের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন। এলাকাবাসী লাশ নিয়ে মিছিল করে বিচার চেয়ে প্রশাসনের কাছে যেতে চেয়েছিলেন।
তখন পুলিশও বোঝায়, মামলা করলে তদন্ত, প্রমাণ হাজিরসহ অনেক ঝামেলায় পড়তে হবে। আচ্ছা, আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে চাওয়ার বিষয়টিকে মোটাদাগে কেন ‘জটিলতা ‘বা ‘ঝামেলা’ হিসেবে বিশেষায়িত করা হয়? রাষ্ট্রের কাছ থেকে এর কি কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে? কিন্তু একমুহূর্ত চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, সন্তান ‘হত্যা’র বিচার চাওয়া থেকেও একজন বাবা পিছিয়ে আসেন কেমনতর ব্যবস্থা বহাল থাকলে!
১৯ জুলাই উত্তরায় ১৫ বছরের নাইমারও অপঘাতে মৃত্যু হয় গুলিবিদ্ধ হয়ে। চারতলায় বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি।
সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে ভর করে বিশ্বের মানচিত্রে পরিচিতি খোদাই করা বাংলাদেশ তো ৫০ বছর পার করে ফেলেছে। এরপরও ‘কলি ছেঁড়ার কাল’ কি অতিক্রান্ত হবে না? কীভাবে তবে ফুলের সুবাসে সুবাসিত হয়ে আসবে আগামীকাল? কংক্রিটের আজদাহা স্থাপনাই কি কেবল অগ্রগতির মাপকাঠি?
যৌক্তিক ও ন্যায়ের ভিত্তিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনটি ছিল শান্তিপূর্ণ। পরে সেটিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ছড়ায়। রক্ত ঝরে, সম্পদের বিনাশ হয়। কার ঘরে লাগা আগুনে কে আলু পুড়িয়ে খাবে, ক্ষমতামুখী রাজনীতির সেই হিসাব যাঁরা বোঝেন, তাঁদের ভাষ্য, ব্যাখ্যা যেমনই হোক; বাড়ির আঙিনায় বুলেট কেড়ে নেবে নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ, এ কেমন রাষ্ট্র! এ কার পাপ, কিসের পাপ?
হাসান ইমাম: সাংবাদিক
hello.hasanimam@gmail.com