মতামত

দুর্নীতিতে কে এগিয়ে, আমলা নাকি নেতা?

২১ জুন, শুক্রবারের পত্রিকার কয়েকটি শিরোনামের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

 ১. সেই তরুণ এনবিআর কর্মকর্তারই ছেলে, ২. পিতার অঢেল সম্পদে পুত্রের বিলাসী জীবন, ৩. সিলেটে এক কাউন্সিলরের দাপটে তটস্থ সবাই, ৪. দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছে আমলাদের একটি অংশ: সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ৫. দেশ থেকে বছরে ৭০০-৮০০ কোটি ডলার পাচার হয়: সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী, ৬. বন্ধ ৩৯৭টি সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ৯. কৃষি ব্যাংক যাঁদের নামে ঋণ দিয়েছে, তাঁদের চারজন ১৯৭১ সালের আগে মারা গেছেন।

উল্লিখিত শিরোনামগুলো পড়লে বাংলাদেশে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রাটি বোঝা যায়। দুর্নীতির কথা উঠলে সরকারের মন্ত্রীরা পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘পৃথিবীর কোন দেশে দুর্নীতি নেই? দুর্নীতি বিএনপি-জাতীয় পার্টির আমলেও হয়েছে। আপনারা সেসব নিয়ে কথা বলেন না। কেবল আওয়ামী লীগ আমলে কিছু ঘটলেই শোরগোল তোলেন।’

তাঁদের এসব বক্তব্যের জবাব দেওয়ার আগে দুর্নীতির হালফিল চিত্রটি তুলে ধরা প্রয়োজন।

প্রথমেই শুরু করা যাক ছাগল–কাণ্ড নিয়ে। কোরবানির জন্য ছাগল কিনে মুশফিকুর রহমান ওরফে ইফাত নামে এক তরুণকে নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়। সেই সঙ্গে তাঁর বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানকে নিয়েও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দুজন নেটিজেন আজাহার উদ্দিন অনিক ও সাইয়েদ আব্দুল্লাহ তাঁদের ফেসবুকে এ–সংক্রান্ত অনেক তথ্য–উপাত্ত সামনে আনেন। 

পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদকে নিয়ে আলোচনার মধ্যে এনবিআরের সদস্যের বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া জনমনে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। তাহলে যাঁরাই প্রশাসনের শীর্ষ পদে থাকেন, তাঁরা অনায়াসে বিপুল সম্পদের মালিক হতে পারেন? 

পত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, ছেলের ছাগল–কাণ্ডের পর এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। ইতিমধ্যে দুদকের কর্মকর্তারা মাঠে নেমেছেন। 

এর আগেও মতিউরের বিরুদ্ধে কমিশনে চারবার দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছিল। প্রতিবার তিনি ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ আদায় করেছেন। এবার কমিশনে তাঁর নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। (সমকাল, ২১ জুন ২০২৪)

বেনজীর আহমেদ ও আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদের হিসাব গণমাধ্যমে আসার বিষয়টি অস্বস্তিকর বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। কিন্তু সেই অস্বস্তি কাটাতে তাঁরা সাবেক দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত চাইলেন না। বিচার চাইলেন না। উল্টো গণমাধ্যমকে ধমক দিলেন। 

ছেলে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কেনায় ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে হোক বা নিজের অবৈধ সম্পদ বাঁচাতে ইফাতকে সন্তান হিসেবে অস্বীকার করে বসেন মতিউর। যদিও পরে প্রমাণিত হয়, ইফাত মতিউর রহমানের দ্বিতীয় সংসারের প্রথম সন্তান। ইতিমধ্যে ইফাতের বিলাসবহুল একাধিক গাড়ি ব্যবহারের বিষয়টিও সামনে আসে। ফলে সরকারি চাকরিজীবী বাবার বেতনের টাকা দিয়ে ছেলে কীভাবে এমন ব্যয়বহুল জীবন যাপন করতে পারেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 

মতিউর রহমান কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আছেন। একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদেও আছেন। আমলাদের পদ যত ভারী হয়, সম্পদের পরিমাণও তত বাড়ে। 

ঢাকার এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের কাছে মতিউরের বিষয়ে সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা কোনো প্রশ্ন নয়। এ নিয়ে কোনো প্রশ্নের জবাব দেব না।’ 

এনবিআরের একজন সদস্যের বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া নিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে যদি প্রশ্ন করা না যায়, তাহলে কার সম্পর্কে প্রশ্ন করা যাবে? 

এর পাশাপাশি বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরে তাদের সভায় সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আংশিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ঢালাও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএসএ)। সংগঠনটি এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।

বেনজীর আহমেদ ও আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদের হিসাব গণমাধ্যমে আসার বিষয়টি অস্বস্তিকর বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। কিন্তু সেই অস্বস্তি কাটাতে তাঁরা সাবেক দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত চাইলেন না। বিচার চাইলেন না। উল্টো গণমাধ্যমকে ধমক দিলেন। 

অন্যদিকে পদ হারানোর পর সাবেক মন্ত্রীরা সত্য কথা বলতে শুরু করেছেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেটের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমলাতন্ত্রের একটি অংশ দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছে। এতে জনগণের হয়রানি বাড়ছে। অল্পসংখ্যক দুর্নীতিবাজ আমলার জন্য সারা আমলাতন্ত্রের বদনাম হচ্ছে।’ 

২০২০ সালের নভেম্বরে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যাঁরা টাকা পাচার করে বিদেশে বাড়ি করেছেন, তাঁদের মধ্যে আমলাদের পাল্লাই ভারী। 

একই দিন বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি আয়োজিত বাজেটবিষয়ক আলোচনায় সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, দেশ থেকে বছরে ৭০০ কোটি থেকে ৮০০ কোটি ডলার পাচার হয়। এ কারণে দেশে ডলার–সংকট দেখা দিয়েছে।

দু্ই সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বর্তমান শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের জাতীয় সংসদে দেওয়া তথ্যটি মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেছেন, দেশে এখন শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বন্ধ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৯৭। এর মধ্যে বিসিকের ৩৮২টি, বিসিআইসির ৫টি, বিএসএফআইসির ৬টি চিনিকল, বিএসইসির ৪টি কারখানা। মন্ত্রী অবশ্য বিজেএমসি ও বিটিএমসির অধীন কতগুলো কারখানা সরকার বন্ধ করেছে কিংবা বেসরকারি মালিকদের কাছে লিজ দিয়েছে, তা বলেননি। 

প্রশ্ন হলো, সরকার এই কারখানাগুলো লাভজনক করতে চালু রাখতে পারল না কেন? কাদের স্বজনপ্রীতি, ভুল নীতি, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলো বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকা লোকসান হলো? আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যত আদর্শগত বিবাদই থাকুক না কেন, একটা বিষয়ে অদ্ভুত মিল আছে। লোকসানের দোহাই দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দাও, না হলে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দাও!

ক্ষমতার অপব্যবহার, অদক্ষতা ও দুর্নীতির মিশেলে যে প্রশাসন তৈরি হয়, সেটিতে ‘লোম বাছতে গা উজাড়’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। ওপরের ঘটনায় মাত্র কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান আমলার কথা বলা হয়েছে। 

কিন্তু রাজনীতিকেরা কী করেন, তার কিঞ্চিৎ তথ্য পাওয়া গেছে জাতীয় সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায়। পাঁচ বছরে কারও কারও সম্পদ বেড়েছে তিন হাজার থেকে চার হাজার ভাগ।

সিলেটের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে ছাত্রলীগের নেতা হয়েছেন, এরপর যুবলীগের নেতা হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। তিনি খাসজমি দখল করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করেন, টিলা কাটেন। চিনি চোরাচালানের সঙ্গেও যুক্ত থাকার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। অতীতে ছাত্রাবাস পোড়ানো ও প্রতিপক্ষকে তাড়ানোর অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এই না হলে জনপ্রতিনিধি!

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com