ভারতে ভাষাবিবাদ কোন দিকে যাচ্ছে

কেন্দ্র’ সবল করতে হবে। তাতে একক চেহারা পাবে পুরো দেশ। সে জন্য সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতির প্রসার দরকার। দমিয়ে আনতে হবে সংখ্যালঘুর ভাষা-সংস্কৃতি।
ছবি : রয়টার্স

জওহরলাল নেহরু ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি দিয়ে ‘ফেডারেল ভারত’কে বাঁধতে চেয়েছিলেন। সেই বাঁধন আলগা হওয়ামাত্র আরএসএস হিন্দুত্ববাদ দিয়ে একই ভূখণ্ড একত্রে রাখতে চাইছে। এ চাওয়ার শক্তিশালী একটি উপাদান ভাষা। ভারতীয় শাসকেরা ভাষা হিসেবে হিন্দির আধিপত্য চাইছে এখন।

এর পার্শ্বফল হিসেবে হিন্দির সঙ্গে সাংস্কৃতিক এক নীরব যুদ্ধ বেঁধেছে অন্যান্য ভাষা-সংস্কৃতির। সেই যুদ্ধের ঢেউ লেগেছে বাংলাভাষী অঞ্চলগুলোতেও। এ ভাষাবিবাদের ভিন্ন এক রাজনৈতিক অভিঘাতের সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন জনমিতি গবেষকেরা, যা ঘটবে ২০২৬–এ।

শিক্ষা ও চাকরির বাজারে হিন্দিকরণ

ভারতজুড়ে বহু ভাষা। ‘দাপ্তরিক ভাষা’ হিসেবে হিন্দি ও ইংরেজির সঙ্গে তালিকাভুক্ত আছে আরও ২০ ভাষা। বহু পণ্ডিত একে দেশটির সৌন্দর্য বলেন। আরএসএস-বিজেপি পরিবার ভাবছে ভিন্ন কথা। কংগ্রেসও একদা ও রকম ভেবেছিল। ‘কেন্দ্র’ সবল করতে হবে। তাতে একক চেহারা পাবে পুরো দেশ। সে জন্য সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতির প্রসার দরকার। দমিয়ে আনতে হবে সংখ্যালঘুর ভাষা-সংস্কৃতি। এ পথে সংখ্যাগুরুর রাজনীতিও বাড়তি বল পাবে। এ লক্ষ্য এগিয়ে নিতে বিজেপি জোরেশোরে শিক্ষা ও চাকরির বাজারের হিন্দিকরণ চাইছে।

বিজেপি যদি ২০২৪–এর লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাহলে সম্ভাব্য ওই বিবাদের সময় অমিত শাহ কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকবেন। এখন হিন্দির পক্ষে নিয়মিত বলতে গিয়ে তিনি হয়তো ২০২৬–এর ওই স্পর্শকাতর সময়ের জন্যই ভারতকে প্রস্তুত করছেন। ঠিক একই কারণে বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গেও হিন্দিকরণের চাপ বাড়তে থাকবে। এক দেশে এক দলের শাসন একচেটিয়া হতে হলে এক ভাষাতেই সুবিধা। এটাই শাহি বিবেচনা।

জন্মহারের সুবিধা পাচ্ছে হিন্দি

ভারতের বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও জাতীয়তাবাদী রেষারেষির বড় এক যুদ্ধক্ষেত্র ভাষা। সেই সূত্রে ভাষাভিত্তিক তথ্য-উপাত্তেরও কদর বাড়ছে। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো এ অঞ্চলে ভাষাতথ্যেরও জনক একজন ‘সাহেব’—জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন। ২০০ বছর আগে বাংলাদেশের রংপুর থেকে শুরু হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার ভাষা নিয়ে এই আইরিশের গবেষণা ও জরিপ। লোকগণনায় আমরা যে এখন ভাষাসংক্রান্ত তথ্য পাই, তা ওই জরিপেরই ধারাবাহিকতা। 

ভারতজুড়ে এ মুহূর্তে অন্তত ৪০টির মতো বেশ প্রভাবশালী ভাষা আছে, যেসবে বহু মানুষ প্রতিদিন কথা বলে। এর বাইরেও স্বল্প পরিসরে শত শত ভাষার সক্রিয় উপস্থিতি আছে। তবে ৫০ কোটির বেশি মানুষের প্রতিদিনের কথায় হিন্দিকে পছন্দ। সমসংখ্যক আবার নিজস্ব পারিবারিক পরিসরে অন্য ভাষায় স্বচ্ছন্দ।

জন্মহারে হিন্দিভাষী অঞ্চল অহিন্দিভাষীদের চেয়ে এগিয়ে। যেমন হিন্দিপ্রধান বিহারে জন্মহার পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে দ্বিগুণ। এ প্রবণতা দীর্ঘ মেয়াদে হিন্দির ‘রাষ্ট্রভাষা’ হওয়ার দাবিকে রসদ জোগাচ্ছে। এর মধ্যে আবার কুলীন সমাজ, কোর্ট-কাচারি এবং নামকরা মিডিয়া চলছে ইংরেজিতে।

পশ্চিমবঙ্গে রাম নবমী যে কারণে হিন্দি উৎসবের চেহারা নেয়

ঘরের ভাষা ইংরেজি—এমন পরিবারের সংখ্যা ভারতে এক শতাংশও নয়। তবে স্বাধীনতার সাত দশক পরও ইংরেজি ভারতের সকাইকে সংযুক্তকারী ভাষা। বিশেষ করে উত্তর-দক্ষিণকে। ভারতের শ্রেষ্ঠ চিন্তাগুলো ইংরেজিতেই প্রকাশিত হচ্ছে। আবার প্রায় সব রাজ্যে দাপ্তরিক ভাষার নিজস্ব তালিকা আছে। বিচিত্র এ অবস্থা রাজনৈতিক ‘এককত্ববাদী’দের পছন্দ নয়। তঁারা এতে বিপদ দেখেন। গান্ধীও দেখেছিলেন। হিন্দিকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে চেয়েছিলেন তিনি সবার ‘চিন্তা বিনিময়ের জন্য’। ইংরেজিকে তিনি দাসত্বের স্মারক ভাবতেন। বিজেপিও তুমুলভাবে হিন্দি চাইছে।

অমিত শাহ ২০১৯ থেকে বলছেন, ‘কেবল হিন্দি ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে।’ কিন্তু তিনি ও তাঁর সহযোগীদের এ রকম চাওয়ায় সাংস্কৃতিক কারণের পাশাপাশি রাজনৈতিক কারণই মুখ্য। সেটা যতটা না তথাকথিত জাতীয় স্বার্থ, তার চেয়ে বেশি দলীয় প্রয়োজন। যেমন পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনে ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’ আওয়াজ আরএসএসের সাজানো ছক ওলট-পালট করে দেয়।

তামিলনাড়ু, কেরালার হিন্দুদের কাছেও স্থানীয় ভাষা-সংস্কৃতির প্রবল আবেদন। বিজেপি এ অবস্থা বদলাতে চায়। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের পাশাপাশি বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ তার দরকার। এ তিন প্রদেশ মিলে লোকসভার আসন বর্তমানের ২৯ শতাংশ থেকে ভবিষ্যতে ৩৩ শতাংশ হবে। সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গকেও উত্তর ভারতীয় চরিত্র দিতে চায় বিজেপি। মার্চ-এপ্রিলে রাম নবমীতে পশ্চিমবঙ্গকে মাতিয়ে তোলে তারা হিন্দি ডিজে গানে।

বাংলার রামের বদলে উদ্‌যাপনের সামনে রাখা হয় উত্তর ভারতের যোদ্ধা রামকে। পশ্চিমবঙ্গের এভাবে হিন্দিকরণের পাশাপাশি অন্য রাজ্যে একই শক্তি বাঙালিদের দেখাতে চায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষ হিসেবে। অর্থাৎ, ‘বাংলা’ যেন ভারতের নয়। যেভাবে ‘তামিল মুভি’কে দক্ষিণের সিনেমা বলা হলেও বলিউডের মুভিকে কখনো ‘উত্তরের সিনেমা’ বলা হয় না। সেটা ভাষা, হিন্দির কারণেই বরাবর ‘ভারতীয় সিনেমা’।

ভাষা যেভাবে ‘নিরাপত্তা ইস্যু’

সারা ভারতের হিন্দিকরণে আপত্তিতে বাংলার পাশাপাশি বেশি সোচ্চার মালয়লাম ও তামিলভাষীরা। দক্ষিণাঞ্চলের আপত্তি নতুন নয়; বরং ইদানীং যে পশ্চিমবঙ্গও এ বিষয়ে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে, সেটা নয়াদিল্লিতে সবার নজর কাড়ছে। দক্ষিণে, ভারত স্বাধীন হওয়ার ১০ বছর আগে, ১৯৩৭–এ হিন্দির বিরুদ্ধে প্রথম আপত্তি ওঠে, যখন স্কুলে হিন্দিকে বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে বলা হয়।

১৯৬৫ সালে এ নিয়ে দাঙ্গায় প্রায় ৭০ জন মারা যান। এর ফল হিসেবে ওই অঞ্চলে দ্রাবিড় পছন্দ আঞ্চলিক রাজনীতির উত্থান ঘটে। এসব ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার পরও বিজেপি নেতৃত্ব, বিশেষ করে অমিত শাহ পুরো ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে হিন্দিকরণ করতে নেমেছেন জোর কদমে। এর বিরোধিতাকারীদের যুক্তিও অকাট্য। গুজরাটে ২০১২ সালে হাইকোর্ট ইংরেজিকে ওই রাজ্যের বিবেচনায় ‘বিদেশি ভাষা’ হিসেবে অভিহিত করে।

এ তথ্য তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্রসহ আরও কয়েক রাজ্য থেকে বলা হচ্ছে, যে যুক্তিতে মোদি ও অমিত শাহর গুজরাটে ইংরেজি বিদেশি ভাষা, সেই একই যুক্তিতে ভারতের বহু রাজ্যে হিন্দিও তাই।

ভাষাবিবাদে ভারতে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক দিক—স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত অমিত শাহ হিন্দির পক্ষে সবচেয়ে বেশি বলেন। তাঁর এ রকম অবস্থানে প্রশ্ন উঠেছে, ভাষা কি তবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যু? জনসংখ্যা নিয়ে যাঁদের গবেষণা, তাঁদের কাছে প্রশ্নটি অমূলক নয়।

তিন বছর পরই ভারতজুড়ে নতুন করে লোকসভার আসন পুনর্বিন্যাস ও পুনর্বণ্টন হবে। ১৯৭১–এর পর এ কাজ আর হয়নি। হিসাব দেখাচ্ছে, জনসংখ্যার ভিত্তিতে নতুন করে আসন নির্ধারণ করতে গেলে উত্তর প্রদেশ, বিহারসহ আশপাশের এলাকা এখনকার চেয়ে অন্তত ৩২ আসন বেশি পাবে।

কারণ, হিন্দিভাষী উত্তরে জন্মহার বেশি। কেবল এ শক্তিতে বিহার ও উত্তর প্রদেশে ২১টি আসন বাড়বে। অন্যদিকে অহিন্দিভাষী দক্ষিণে আসন কমতে পারে ২৪টির মতো।

বিষয়টা এমন দাঁড়াচ্ছে, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি ভালোভাবে বাস্তবায়নকারী অঞ্চল রাজনৈতিক শাস্তি পাবে। আর হিন্দিভাষী অঞ্চলের শক্তিশালী রাজনৈতিক দল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুরস্কৃত হবে। জন্মহারের সঙ্গে যুক্ত হলেও পুরো ঘটনার বাস্তব সুবিধা যাচ্ছে হিন্দির দিকে। এ নিয়ে হিন্দি ও অ-হিন্দি অঞ্চলের মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদও বাড়তে পারে।

বিজেপি যদি ২০২৪–এর লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাহলে সম্ভাব্য ওই বিবাদের সময় অমিত শাহ কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকবেন। এখন হিন্দির পক্ষে নিয়মিত বলতে গিয়ে তিনি হয়তো ২০২৬–এর ওই স্পর্শকাতর সময়ের জন্যই ভারতকে প্রস্তুত করছেন। ঠিক একই কারণে বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গেও হিন্দিকরণের চাপ বাড়তে থাকবে। এক দেশে এক দলের শাসন একচেটিয়া হতে হলে এক ভাষাতেই সুবিধা। এটাই শাহি বিবেচনা।

  • আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক