বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানীকে মধ্যরাতে ঘরের দরজা ভেঙে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন বুধবার তিনি আদালতে বলেছেন, তাঁকে থানায় মারধর করা হয়েছে। যেভাবে মারা হয়েছে, ‘চোর–ডাকাতদেরও এভাবে মারতে পারে না পুলিশ’। আদালতে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিতে দিতে কেঁদে ফেলেন তিনি। যে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে তাঁকে মারার অভিযোগ, তাঁরা তাঁকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন আদালতে। শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর আইনজীবীরা তাঁর জামিনের আবেদন করেন।
এমন পরিস্থিতিতে আদালত আসামিকে জামিন দিতে পারেন বা রিমান্ডেও দিতে পারেন। মধ্যবর্তী ব্যবস্থা হিসেবে আসামিকে জেলে পাঠিয়ে দিয়ে সেখানে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দিতে পারেন। পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ থাকলে বা রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করার আশঙ্কা থাকলে আদালত এটা করতেন আগে। কিন্তু এখন আর তা করা হয় না সাধারণত। বিএনপির (বা মাঠের অন্য বিরোধী দলের) কারও রিমান্ড চাওয়া হলে আদালত তাঁকে পুলিশের কাছে রিমান্ডে দেননি—এটি এখন বিরল ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকেও আদালত চার দিনের জন্য রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন।
শহীদ উদ্দীন চৌধুরী বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি দুবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে তাঁর উত্থান, মাঠপর্যায়ের আন্দোলনেও তাঁকে সক্রিয় দেখা যায়। গ্রেপ্তারের আগের দিন তিনি প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। আদালতে তিনি বলেছেন, তাঁকে মধ্যরাতে এভাবে গ্রেপ্তার না করে পুলিশ চাইলে তখনই গ্রেপ্তার করতে পারত।
পুলিশ যে এটা করেনি, এর কারণ বোঝা অবশ্য দুষ্কর নয়। মধ্যরাতে দরজা ভেঙে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর বার্তা আছে, বার্তা আছে আগ্রাসী ভূমিকা গ্রহণের। আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক অচলাবস্থা ঘনিয়ে আসার বর্তমান সময়ে এই বার্তা যে সরকার দিতে চায়, তা আরও কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা সরাসরি বলেছেন, ওয়ারেন্ট বা সুস্পষ্ট মামলা থাকলে পুলিশ ছাড় দেবে না, যত বড় নেতাই হোক, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে।
বড় নেতা যদি মির্জা ফখরুল হয়ে থাকেন, পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল মাত্র গত ডিসেম্বরে। কাজেই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।
গ্রেপ্তার ও হুমকির সঙ্গে চলছে বিএনপি নেতাদের শায়েস্তা করার আরও বিভিন্ন প্রক্রিয়া। নতুন মামলা হচ্ছে, পুরোনো মামলা সচল করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে রয়েছে হাজার হাজার মামলা। প্রথম আলোর খবর অনুসারে, গত পাঁচ দিনে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে আরও ১৪টি মামলা হয়েছে, আসামি করা হয়েছে বিএনপির ৩২৩ জন সক্রিয় নেতা–কর্মীকে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, আগের মতো এগুলোও সাজানো বা গায়েবি মামলা। এ ধরনের গায়েবি মামলা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে পত্রপত্রিকায়। এসব মামলায় যে জায়গার ককটেল বিস্ফোরণ বা অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ করা হয়, স্থানীয় লোকজন সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, এমন ঘটনা ঘটেনি আসলে। তবু অবধারিতভাবে অস্ত্র, বিস্ফোরক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে এসব মামলা করা হয় মূলত জামিন নামঞ্জুর করার জন্য আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে।
ঘটনাদৃষ্টে এটি পরিষ্কার যে সরকার বিএনপির প্রতি আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত প্রশ্নবিদ্ধ মামলা আগেই প্রস্তুত ছিল। শেষ মুহূর্তে বিএনপির আন্দোলনের সম্ভাবনা দমন করতে সরকার এসব মামলায় গ্রেপ্তার ও সাজা দেওয়ার পথে গেছে। অন্যদের মনে আতঙ্কের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বার্তা কি আপসের চাপ সৃষ্টির, নাকি দমনের গর্জন তোলার?
এই চাপ উপেক্ষা করার সুযোগ অবশ্য আইনে রয়েছে। সাজানো হিসেবে প্রতীয়মান বলে এসব মামলায় জামিন দেওয়ার সুযোগ থাকে। মামলায় মৃত, শারীরিকভাবে অক্ষম বা বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিদের আসামি করা হলে ও বিপুলসংখ্যক ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামি রাখলে এর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আদালতের স্বাধীনতা থাকলে দুর্বল ও গৎবাঁধা এসব মামলায় আসামির জামিন না পাওয়ার কথা নয়, এগুলো আদালতে টেকার কথা নয়। কিন্তু তা হচ্ছে না।
বিএনপি নেতাদের বরং এখন সাজা দেওয়া শুরু হয়েছে এ ধরনের কিছু গায়েবি মামলায়। গত ছয় মাসে বিএনপির ৯৬ নেতা-কর্মীর সাজা হয়েছে, গত এক সপ্তাহে সাজা হয়েছে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান, কেন্দ্রীয় নেতাসহ ২৪ নেতা–কর্মীর। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল নিজে কিছুদিন আগে গ্রেপ্তারের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও রয়েছে ময়লার গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের ওপর হামলাসহ শ খানেক মামলা।
এসব ঘটনাদৃষ্টে এটি পরিষ্কার যে সরকার বিএনপির প্রতি আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত প্রশ্নবিদ্ধ মামলা আগেই প্রস্তুত ছিল। শেষ মুহূর্তে বিএনপির আন্দোলনের সম্ভাবনা দমন করতে সরকার এসব মামলায় গ্রেপ্তার ও সাজা দেওয়ার পথে গেছে। অন্যদের মনে আতঙ্কের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বার্তা কি আপসের চাপ সৃষ্টির, নাকি দমনের গর্জন তোলার?
বাংলাদেশে অতীতে ‘আপসে’ নির্বাচন হয়নি, তা বলা যাবে না। ১৯৮৬ সালের নির্বাচন আপসমূলক ছিল—এমন ধারণা করা হয়েছিল। এরপর ১৯৯৬ ও ২০১৪ সালে ক্ষুদ্র দলগুলোকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ানোর লক্ষ্যে কিছু আপস হয়েছিল সম্ভবত। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও আপস হয়েছে শোনা যেত। শোনা যেত, আপস হয়েছে বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীদের ৬০ থেকে ১০০টি আসন ‘ছেড়ে’ দেওয়ার। এই শোনা কথা সত্যি কি না, প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তবে আপস হলেও তা যে রাখা হয়নি, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
নৈতিকভাবে এ ধরনের আপস গ্রহণযোগ্য নয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পর আপসের আর কোনো সুযোগও সম্ভবত নেই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জীবন বাঁচাতে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর শর্তে আপসের কথা হয়তো বিএনপি ভাবতে পারত। কিন্তু খালেদা জিয়ার নিজেরই এ ধরনের কোনো আপসে সম্মতি দেওয়ার কথা নয়।
ওয়ান-ইলেভেন আমলে ভোগান্তি এড়াতে তাঁর বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ ছিল, কয়েক বছর আগে আদালতের রায় ঘোষিত হওয়ার আগে বিদেশে সফরকালেও তিনি চাইলে সেখানে থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বিএনপির তাঁকে নিয়ে দর-কষাকষির সুযোগ নেই।
বিএনপিকে তাই তার প্রত্যাশামাফিক তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি অর্জন করতে হলে আন্দোলনের দিকে যেতে হবে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বিএনপি সে রকম ঘোষণাও দিয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে, আমরা হয়তো সরকার আর বিরোধী দলের মুখোমুখি কোনো অবস্থানের দিকে যাচ্ছি। এই মুখোমুখি সংঘাত দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। এমনিতেই আমরা অর্থনৈতিকভাবে নাজুক অবস্থানে রয়েছি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপে মানুষ আছে দিশাহারা অবস্থায়।
আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বিপুল অঙ্কের বিদেশি ঋণ পরিশোধের দায় ঘাড়ে এলে এবং রেমিট্যান্স অব্যাহতভাবে কমতে থাকলে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠবে। বিদেশি মহলগুলো এর সুযোগ আরও শক্তভাবে নিতে পারবে। একতরফা নির্বাচন হলে সুযোগ নেওয়ার নৈতিক গ্রহণযোগ্যতাও সৃষ্টি হবে।
আমরা সবাই এসব আশঙ্কার কথা জানি। তারপরও একটা অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাতের দিকে যাচ্ছি। নির্বিচার মামলা, গ্রেপ্তার ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে সরকার এ পরিস্থিতির উদ্দীপনা সৃষ্টি করছে। এ সংঘাত না হলে ভালো। বরং সমঝোতার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য একটা সরকারের অধীন নির্বাচন হলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। মানুষের ভোটাধিকার অর্জিত হলে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে, দেশে গণতন্ত্র (অন্তত ১৯৯১-২০১৩ মাপের) ফিরে এলে, আমাদের বহু সংকট প্রশমিত করার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
আমরা আশাবাদী হতে চাই। ভালো হয়, যদি আশাবাদ নিজের কাছেই অবাস্তব মনে না হয়।
● আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক