মতামত

গ্যাস উত্তোলনে পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত?

গ্যাসের চাহিদা মেটাতে উচ্চ মূল্যের এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা যে আর্থিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, সে আশঙ্কা আগে থেকেই করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর প্রভাবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এবং রিজার্ভ-সংকট ইতিমধ্যে জনসাধারণ ও সরকার—উভয়ের জন্যই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দামের ওঠা ও নামা জ্বালানি খাতে বিশ্বব্যাপী অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী। বাংলাদেশ ২০১৮ সালে যখন এলএনজি আমদানি শুরু করে, তখন এর দাম তুলনামূলক কম ছিল, কিন্তু গত বছর নাগাদ এর দাম এতটাই বেড়ে যায় যে বাংলাদেশ স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার সামর্থ্য হারায়।

এ কারণে গ্যাস-সংকটে দেশে যে লোডশেডিং হয়, তার অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই হয়েছে।

উচ্চ মূল্যের এলএনজির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে দেশের নিজস্ব গ্যাস সম্পদ সর্বোচ্চ সক্ষমতায় উত্তোলন ও তার ওপর নির্ভর করার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এ বিষয়ে আগে থেকেই বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তাঁদের মতে, ভূতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশ গ্যাসের জন্য যথেষ্ট সম্ভাবনাময়, কিন্তু গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে অবহেলা ও দুর্বল উদ্যোগের কারণে গ্যাস–সংকট আজ এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর মাত্র একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়, গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, এমন দেশগুলোর মধ্যে অনুসন্ধানের এ হার বিশ্বে ন্যূনতম।

তবে দেরিতে হলেও আশার কথা হচ্ছে সম্প্রতি দেশের নিজস্ব গ্যাসসম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি জরুরি ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে পেট্রোবাংলা ২০২৫ সালের সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এর মধ্যে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ, ১২টি উন্নয়ন কূপ ও ১৭টি ওয়ার্কওভার কূপ অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশে গড় সাফল্যের হার বেশি এবং তা হলো, তিনটি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে একটিতে সাফল্য। সেই হিসাবে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে তার এক-তৃতীয়াংশ সফল হতে পারে এবং গ্যাস প্রাপ্তির প্রাক্কলন সেভাবেই করা উচিত। সব কটি কূপে সাফল্য ধরে যে পরিমাণ উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। এরপরও বলি, নতুন গ্যাস কূপ খননের যে উদ্যোগ পেট্রোবাংলা নিয়েছে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। গ্যাস অনুসন্ধানে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে যথেষ্ট মাত্রায় কূপ খনন করা হলে বর্তমান গ্যাস-সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

পেট্রোবাংলার আশা, এসব কূপের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে কমবেশি এ পরিমাণ গ্যাস এলএনজি আমদানির মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, পেট্রোবাংলার পরিকল্পনাটি কতটা সন্তোষজনক এবং এর মাধ্যমে প্রত্যাশা অনুযায়ী গ্যাস তোলার সম্ভাবনা কতটুকু?

সাধারণ পাঠকদের জন্য বোঝার জন্য বলছি, ‘অনুসন্ধান কূপ’ অজ্ঞাত স্থানে খনন করা হয় এবং গ্যাস পাওয়া গেলে তা দেশের গ্যাস মজুত বাড়ায়। ‘উন্নয়ন কূপ’ হচ্ছে ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন কূপ খনন। আর ‘ওয়ার্কওভার কূপ’ নতুন কূপ নয়; বরং আগে খনন করা ও পরিত্যক্ত কূপে মেরামত বা কোনো যন্ত্রাংশ সংযোজনের মাধ্যমে সেখানে রয়ে যাওয়া বা ফেলে আসা গ্যাস তোলার চেষ্টা করা।

পেট্রোবাংলা গত আগস্টে যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে তা সংশোধন করেছে। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪৬টি কূপ খননের কাজ ২০২৫ সালের পরিবর্তে ২০২৪ সালের মধ্যেই শেষ করা হবে। অর্থাৎ, তিন বছরের পরিবর্তে এখন দুই বছরের মধ্যেই ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এ সময়ে যে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করার কথা, এর ৬টি ২০২৩ সালে এবং ১১টি ২০২৪ সালে খনন করা হবে। কেবল এই অনুসন্ধান কূপগুলো বিবেচনায় নিয়ে পরিবর্তনের যৌক্তিকতা বিচার করে দেখা যেতে পারে।

বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্স তার বর্তমান লোকবল ও রসদ সামর্থ্য নিয়ে বছরে দুই থেকে তিনটি অনুসন্ধান কূপ খনন করতে পারে। সেই বিবেচনায় ২০২৩ সালে ৬টি অনুসন্ধান কূপ খননের পরিকল্পনাই উচ্চাভিলাষী। আর ২০২৪ সালে ১১টি অনুসন্ধান কূপ খনন করার পরিকল্পনাকে বলতে হয় অতি উচ্চাভিলাষী।

আমাদের মনে আছে, ২০১৬ সালে পেট্রোবাংলা ‘পাঁচ বছরে ১০৮টি কূপ খননের’ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। এর মধ্যে ৫৫টি ছিল অনুসন্ধান কূপ। পাঁচ বছরে তা করতে হলে প্রতিবছর ১১টি খনন করা প্রয়োজন। কিন্তু বাপেক্স পরিকল্পনাটি কার্যকর করতে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

দেশীয় কোম্পানি বাপেক্স যে তার সীমাবদ্ধতার কারণে পেট্রোবাংলার নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে ৬টি ও ২০২৪ সালে ১১টি অনুসন্ধান কূপ খনন করতে পারবে না, তা সহজেই বোঝা যায়।

এ ক্ষেত্রে কূপ খননের জন্য আউটসোর্সিং ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাকে সাধারণভাবে যৌক্তিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা এর সীমাবদ্ধতার দিকটি ও আমাদের সামনে তুলে ধরে। এক বছরে এতগুলো আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার সামর্থ্য কি আমাদের আছে?

কূপ খননে আউটসোর্সিং কোম্পানি ও পেট্রোবাংলার বিরোধ অনেক সময় আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কয়েক বছর আগে সেমুতাং-৫ ও বেগমগঞ্জ-৪ কূপ দুটি আউটসোর্সিং ব্যবস্থাপনায় আজারবাইজানের রাষ্ট্রীয় তেল–গ্যাস কোম্পানি সোকারকে খনন করতে দেওয়া হয়। কিন্তু পেট্রোবাংলার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক বিষয়ে বিরোধ হওয়ার কারণে তারা বেগমগঞ্জ কূপটি খনন না করে চলে যায়। এ জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত বিষয়টির কোনো নিষ্পত্তি হয়নি।

আইনি নিষ্পত্তি না হওয়ায় এখন বেগমগঞ্জ-৪ কূপটি এখন আমাদের বাপেক্সও খনন করতে পারছে না। একইভাবে ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলার জন্য কানাডার অখ্যাত নাইকো কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। নাইকো কূপটিতে দুর্ঘটনা ঘটায় এবং তাতে কূপটি নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে গেছে কিন্তু ১৭ বছরেও তার নিষ্পত্তি হয়নি।

ফলে এ গ্যাস-সংকটের দিনেও ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকেও গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হচ্ছে। এদিকে অনেক কূপ বাপেক্সকে দিয়ে খনন না করিয়ে রাশিয়ার গাজপ্রম কোম্পানির মাধ্যমে করানো হচ্ছে, যেখানে গাজপ্রম প্রতিটি কূপ খননে বাপেক্সের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দাম নিচ্ছে।

বর্তমানে ঘোষিত ৪৬টি কূপ খনন তিন বছরের (২০২৩-২০২৫) পরিবর্তে দুই বছরে (২০২৩-২০২৪) সম্পন্ন করার পরিবর্তিত পরিকল্পনা সুচিন্তিত নয় বলে মনে হয়। মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতাবিহীন প্রশাসনের উচ্চ মহলের সুপারিশে এ রকম সিদ্ধান্ত হয়ে থাকতে পারে। এত বেশিসংখ্যক কূপ তাড়াহুড়ার মধ্যে করতে যাওয়ার যে ঝুঁকি রয়েছে, তা আমলে না নেওয়া অদূরদর্শিতার সাক্ষ্য বহন করে। একটি বছর তেমন বড় কিছু সময় নয়, যেখানে বাংলাদেশ বছরের পর বছর গ্যাস-সংকটে ভুগে আসছে।

অন্যদিকে ৪৬টি কূপ খননের মাধ্যমে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের যে হিসাব করেছে, তা-ও সুচিন্তিত নয়। পেট্রোবাংলার হিসাবে প্রতিটি অনুসন্ধান কূপে সফলতা ও গ্যাসপ্রাপ্তি ধরে কূপপ্রতি ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের কোথাও অনুসন্ধান কূপের প্রতিটি সফল হয় না।

বাংলাদেশে গড় সাফল্যের হার বেশি এবং তা হলো, তিনটি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে একটিতে সাফল্য। সেই হিসাবে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে তার এক-তৃতীয়াংশ সফল হতে পারে এবং গ্যাস প্রাপ্তির প্রাক্কলন সেভাবেই করা উচিত। সব কটি কূপে সাফল্য ধরে যে পরিমাণ উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। এরপরও বলি, নতুন গ্যাস কূপ খননের যে উদ্যোগ পেট্রোবাংলা নিয়েছে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। গ্যাস অনুসন্ধানে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে যথেষ্ট মাত্রায় কূপ খনন করা হলে বর্তমান গ্যাস-সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

  • ড. বদরূল ইমাম অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়