রাশিয়ার পুতিনবিরোধীদেরও ভয় পায় ইউক্রেন

রাশিয়ার বর্তমান প্রধান বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনি
ছবি: এএফপি

রাশিয়া গত বছর ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা চালানোর পর থেকেই যে অতি পুরোনো বিতর্কটি আবার সামনে এসেছে। সেটি হলো সোভিয়েত–পরবর্তী রুশ আগ্রাসনের বিষয়ে রাশিয়ার সরকারবিরোধীদের অবস্থান কী হবে? রাশিয়ার বিরোধী আন্দোলনকর্মীরা এবং কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, দেশটির বিরোধী দলের নেতৃত্বে সরকারের পতন ঘটানোই রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদী প্রবণতাকে ঠেকানোর একমাত্র উপায়।

তবে ইউক্রেন এবং সোভিয়েত-উত্তরকালে রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদের শিকার হওয়া অনেক দেশ এই তত্ত্বের সঙ্গে একমত নয়। তারা রাশিয়ার বিরোধী দলকে এবং আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে রাশিয়ার বর্তমান প্রধান বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনিকে শান্তির ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তাদানকারী হিসেবে মনে করেন না। কেন মনে করেন না, তা ব্যাখ্যা করার জন্য নাভালনির আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবকদের (যাঁদের একসময় ‘নাভালনিস্ট’ বলা হতো) সঙ্গে আমার মতবিনিময়ের একটি ঘটনার কথা বলতে চাই।

২০১৪ সালে ইউক্রেনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং তার জের ধরে রাশিয়ার আগ্রাসনের ঘটনার পর যুক্তরাজ্যে একটি ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে আমার একজন ইউক্রেনীয় সহকর্মী ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাশিয়া থেকে দুজন ‘নাভালনিস্ট’ এসেছিলেন। অনুষ্ঠানে তাঁদের সঙ্গে আমার এবং আমার সেই ইউক্রেনীয় সহকর্মীর মতবিনিময় করার সুযোগ হয়।

আলোচনার একপর্যায়ে আমরা ওই দুজনের কাছে জানতে চাইলাম, রাশিয়া অবৈধভাবে ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার পর নাভালনি যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন, সে বিষয়ে তাঁরা কী মত পোষণ করেন। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার, ২০১৪ সালের অক্টোবরে মস্কোর একটি রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাভালনি মস্কোর ক্রিমিয়া দখলকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন’ বলে স্বীকার করলেও ক্রিমিয়া ভবিষ্যতেও ‘রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ থাকবে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি এ–ও বলেছিলেন, ‘ক্রিমিয়া কখনোই ইউক্রেনের অংশ হবে না।’

‘আপনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে ফেরত দেবেন কি না’ এ প্রশ্নের জবাবে নাভালনি সরাসরি ‘না’ বলেননি। তিনি রাজনৈতিক বাকচাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে কৌশলী জবাব দেন, ‘এটা কী বলেন? ক্রিমিয়া কি স্যান্ডউইচ যে একবার এর হাতে আরেকবার তার হাতে যাবে?’ অর্থাৎ তাঁর কথায় পরিষ্কার হয়েছিল, তাঁরা মনে করেন, ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের হাতে আর ফেরত দেওয়া হবে না।

লক্ষ করার বিষয় হলো, রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতা বরিস নেমৎসভ ক্রেমলিনের অদূরে গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার এবং তাঁর জায়গায় নাভালনির স্থলাভিষিক্ত হওয়ার ছয় মাসের কম সময় পর আমরা ওই দুই নাভালনিস্টের সঙ্গে কথা বলছিলাম। নেমৎসভ নিহত হওয়ার আগে বেশ জোরালোভাবে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের বিরোধিতা করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ওই সময় ভ্লাদিমির পুতিনের আরেক প্রতিপক্ষ মিখাইল খোদোরকোভস্কি লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলেন এবং রুশ রাজনীতি থেকে একেবারে দূরে ছিলেন।

ওই সময় এটি ধরে নেওয়া অযৌক্তিক ছিল না যে রাশিয়ায় যদি সরকার পরিবর্তন হয়, তাহলে যাঁর নেতৃত্বে হবে, তিনি হলেন নাভালনি। সে কারণে আমরা জানতে চেয়েছিলাম, পুতিন-পরবর্তী রাশিয়ার কাছ থেকে ইউক্রেনীয়রা কী আশা করতে পারে?

জবাবে নাভালনিপন্থী দুই রুশ বলেছিলেন, যদিও মস্কো অবৈধভাবে ক্রিমিয়াকে দখল করে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করেছে, তথাপি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অধীনস্থ মস্কো ক্রিমিয়াকে নিজের করেই রাখতে চাইবে। এর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তাঁরা বলেছিলেন, রাশিয়ার বেশির ভাগ মানুষ চায় ক্রিমিয়া রাশিয়ার থাকুক। সেই কারণে সেই গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের চাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবে।

এই যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে আমরা বলেছিলাম, রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল তো পশ্চিম কোনো দিনই মেনে নেবে না; এ ছাড়া ক্রিমিয়াকে রাশিয়া ইউক্রেনের হাতে ফেরত দিলে একদিকে পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের উন্নতি হবে, অন্যদিকে ইউক্রেনের সঙ্গেও রাশিয়ার ভালো বোঝাপড়া হবে। কিন্তু ওই দুই রুশ ভিন্নমতাবলম্বী বলেছিলেন, ভবিষ্যতের সেই রাশিয়া ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের হাতে তুলে না দিয়ে কীভাবে পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে পারে, তার উপায় খুঁজবে।

রাশিয়ার উপনিবেশ মানসিকতা পুতিনপন্থীদের মতো পুতিনবিরোধীদের কাছেও সমান জনপ্রিয়। তারা যে–ই ক্ষমতায় যাক, সে–ই ইউক্রেনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ভূখণ্ডকে কুক্ষিগত করে রাখতে চাইবে।

আজ এত দিন পরও মনে হচ্ছে আসলে ইউক্রেন পুতিনের সরকারের বর্তমান শিকার হলেও ভবিষ্যতের পুতিনবিহীন রাশিয়ার হাত থেকেও দেশটি রেহাই পাবে না। কারণ, রাশিয়ার উপনিবেশ মানসিকতা পুতিনপন্থীদের মতো পুতিনবিরোধীদের কাছেও সমান জনপ্রিয়। তারা যে–ই ক্ষমতায় যাক, সে–ই ইউক্রেনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ভূখণ্ডকে কুক্ষিগত করে রাখতে চাইবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • আন্তন শেখোভৎসভ সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক ইন্টেগ্রিটির পরিচালক