মিয়ানমারের এমন আচরণে বাংলাদেশ কি চুপ থাকবে

কয়েক দিনের ব্যবধানে দুবার মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল বাংলাদেশের ভেতরে এসে পড়েছে
কয়েক দিনের ব্যবধানে দুবার মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল বাংলাদেশের ভেতরে এসে পড়েছে

মিয়ানমার থেকে আবারও গোলা এসে পড়েছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতরে। গতকাল শনিবার মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর দুটি গোলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকার জনবসতিহীন পাহাড়ে বিস্ফোরিত হয়েছে।

এর আগে গত ২৮ আগস্ট দুটি মর্টারের গোলা নাইক্ষ্যংছড়ির উত্তর ঘুমধুমপাড়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এসে পড়েছিল। তবে গোলা দুটি বিস্ফোরিত হয়নি। শনিবার মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর যুদ্ধবিমানও বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর সঙ্গে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে। মাঝেমধ্যে যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টারগুলো বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে গুলিবর্ষণ করছে।

এতে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকার ঘুমধুম ইউনিয়নের বাসিন্দাদের পাশাপাশি শূন্য রেখার আশ্রয়শিবিরে থাকা চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আতঙ্কে দিনযাপন করছে। সীমান্তবর্তী রবারবাগানের শ্রমিকেরা আতঙ্কে স্থানীয় বাজারের দিকে চলে এসেছেন।

এসব ঘটনা তখনই ঘটছে, যখন মাত্র ১০ দিন আগে আরাকানে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনযজ্ঞ এবং নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়নের পাঁচ বছর পার হলো। ২০১৭ সালের ২৫ ও ২৬ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশের গণহত্যার মুখে প্রাণ বাঁচাতে আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

আগে আসা ৩ লাখসহ সাকল্যে ১১ লাখ বিতাড়িত রোহিঙ্গা কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত শরণার্থীশিবিরগুলোয় এবং তার আশপাশে গাদাগাদি করে অবস্থান করছে। এসব সবার জানা কথা। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর নিষ্ফল চেষ্টার বিষয়েও সবাই অবগত। তড়িঘড়ি যে প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়েছিল মিয়ানমারের সঙ্গে বা চীনের মধ্যস্থতায় যে ত্রিপক্ষীয় সংলাপ হয়েছিল, রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার বিষয়ে তাতে তিলমাত্র অগ্রগতি হয়নি। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দুটি মামলা চলমান। আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, আর এর ফলাফলের বিষয়েও কখনো নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।

টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরগুলোয় ক্রমবর্ধমান অপরাধ বাংলাদেশের জন্য সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। মাদক পাচারের অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে শিবিরগুলো।

সশস্ত্র অপরাধী দলগুলো নিয়মিত সংঘাতে লিপ্ত হয়, খুনখারাবি প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা। মানব পাচারও চলছে। তাদের এসব কার্যকলাপ পরোক্ষভাবে মিয়ানমার জান্তারই পক্ষে যাচ্ছে। এসব অপকর্মে স্থানীয় অপরাধীচক্রও জড়িত। রাজনৈতিক সংযোগের কারণে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।

ইচ্ছাকৃত হোক বা না হোক, এসব ঘটনায় মিয়ানমার জান্তার অবহেলাপূর্ণ মনোভাব বেশ স্পষ্ট। তারা ধরেই নিয়েছে যে এ রকম কিছু ঘটলে বাংলাদেশ কূটনৈতিক প্রতিবাদের বাইরে আর কিছু করবে না। এই ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে তাদের স্থানচ্যুত করা প্রয়োজন। ছোটখাটো কিছু পাল্টা ব্যবস্থা তাদের এ রূপ কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখতে পারে। আমার বিশ্বাস, শম্বুকগতিসম্পন্ন রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বরং খানিকটা শক্তি প্রদর্শন, প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার জান্তার চরম নির্লিপ্ততায় হয়তো কিছুটা তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল মানবিক বিবেচনায়। সেই আশ্রিত রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের জন্য বহুমুখী সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শরণার্থীশিবিরের রোহিঙ্গাদের সবার মধ্যে গ্রহণীয় কোনো নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি।

মোটাদাগে দুভাগে ভাগ হয়ে আছে তারা। এক অংশ চায় প্রত্যাবাসন, আরেক অংশ চায় বর্তমান অবস্থা বহাল থাকুক। এই দ্বিতীয় অংশের নেতৃত্ব চলে গেছে সশস্ত্র অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে। সন্ধ্যা নামলেই এরা প্রায় সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে ক্যাম্পগুলোয়, এমনই প্রচলিত বিশ্বাস।

১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সংঘটিত অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনী মিয়ানমারের সর্বময় ক্ষমতা দখল করে। সেই বছর এপ্রিলে সেখানকার গণতান্ত্রিক শক্তি বিকল্প সরকার হিসেবে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করে। এ সরকারের মূল অংশীদার অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। তবে এর সঙ্গে ছোট ছোট কিছু দল এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা ও বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী দলও যোগ দিয়েছে। ৩ জুন ২০২১ তারিখে এই সরকার ‘পলিসি পজিশন অন দ্য রোহিঙ্গা ইন রাখাইন স্টেট’ নামে একটি অবস্থানপত্র প্রকাশ করেছে।

এ অবস্থানপত্র সরাসরি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে উদ্দেশ করে প্রণীত হয়েছে। এই প্রথম মিয়ানমারের কোনো সংগঠন রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা নামে সম্বোধন করেছে। যেখানে সেনাদের অত্যাচারে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় এবং নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবর্তনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। সবশেষে এ সরকার এবং অন্য সবার সঙ্গে যোগ দিয়ে সামরিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে অবদান রাখার জন্য রোহিঙ্গাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

আশ্চর্যজনকভাবে শরণার্থীশিবিরের রোহিঙ্গা কোনো নেতা বা ডায়াসপোরার কোনো প্রতিনিধি এ আহ্বানের বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। মিয়ানমারে দেশব্যাপী যে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যত বিলম্বেই হোক, তা একসময় নিষ্পত্তি হবে সব পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে।

সে আলোচনায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তির একমাত্র সম্ভাবনা, যদি তারা জাতীয় ঐক্যের সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। বাংলাদেশের পক্ষে এ বিষয়ে সরাসরি কোনো ভূমিকা গ্রহণ সম্ভব নয়। তবে এ বিষয়ে রোহিঙ্গাদের উদ্বুদ্ধ করা এবং প্রয়োজনে সহায়তা প্রদান কার্যকর হতে পারে। মিয়ানমার জান্তার এতে ক্ষুব্ধ হওয়া সম্ভব, তবে তাদের তোষণ করেও তো গত পাঁচ বছরে কোনো ফায়দা হয়নি।

২৮ আগস্ট গোলা এসে পড়ায় ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। এর আগেও মিয়ানমারের সামরিক বিমান বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে এবং যথারীতি বাংলাদেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে একটা সেমিনার হয়েছিল রোহিঙ্গা প্রশ্নে।

আমি বলেছিলাম যে দুবার সতর্ক করার পর তৃতীয়বারে অনুপ্রবেশকারী একটি বিমানকে গুলি করে ফেলে দেওয়া উচিত মিয়ানমারকে একটি বার্তা দেওয়ার জন্য। উপস্থিত একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা আমার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন যে মিয়ানমার ঠিক এটিই চাইছে, যাতে সমস্যাটিকে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সংঘাত হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।

১৯৭১ সালের ২৪ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় বিবৃতিতে বলেছিলেন যে ভারত কখনোই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায়নি, কিন্তু শরণার্থী পরিস্থিতির ফলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এখন ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ঠিক একই কাজ করেছে মিয়ানমারের জান্তা।

তাদের জাতিগত সংঘাতকে বাংলাদেশের সমস্যায় পরিণত করেছে গণহত্যামূলক কাজের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে। বাংলাদেশ এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়, যাতে রোহিঙ্গারা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে জান্তা প্রমাণ করেছে যে শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।

নাইক্ষ্যংছড়িতে কয়েক দিনের ব্যবধানে দুবার গোলা এসে পড়াটা অবশ্যই বিপজ্জনক। এতে প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল। এ ছাড়া মিয়ানমারের সামরিক হেলিকপ্টারও বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।

বাংলাদেশ আবার প্রতিবাদ জানিয়েছে, তবে মিয়ানমার অন্তত দুঃখ প্রকাশ করেছে কি না, তা জানা যায়নি। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেনাদের সঙ্গে স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মির লড়াই চলছে। আরাকান আর্মি জাতীয় ঐক্যের সরকারে যোগ দেয়নি, যেমনটি অন্য অনেক বিদ্রোহী দল দিয়েছে।

তাদের প্রবল মুসলিমবিরোধিতাও সুপরিচিত। চলমান এই সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে এসব গোলা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ে থাকতে পারে। তবে বিষয়টি ইচ্ছাকৃত কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার। সেই সঙ্গে আকাশসীমা লঙ্ঘনের বিষয়টিও আছে।

ইচ্ছাকৃত হোক বা না হোক, এসব ঘটনায় মিয়ানমার জান্তার অবহেলাপূর্ণ মনোভাব বেশ স্পষ্ট। তারা ধরেই নিয়েছে যে এ রকম কিছু ঘটলে বাংলাদেশ কূটনৈতিক প্রতিবাদের বাইরে আর কিছু করবে না। এই ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে তাদের স্থানচ্যুত করা প্রয়োজন। ছোটখাটো কিছু পাল্টা ব্যবস্থা তাদের এ রূপ কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখতে পারে। আমার বিশ্বাস, শম্বুকগতিসম্পন্ন রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বরং খানিকটা শক্তি প্রদর্শন, প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার জান্তার চরম নির্লিপ্ততায় হয়তো কিছুটা তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে।

  • মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব