কার স্বার্থে মনজুর আহমেদ চৌধুরীকে সরানো হলো

মনজুর আহমেদ চৌধুরী
মনজুর আহমেদ চৌধুরী

ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে ‘জনস্বার্থে’ অপসারণ করা হয়েছে। ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে এই পদে বসানো হয়েছিল ৩৬ মাসের চুক্তিতে। তিনি কাজ করেছেন মাত্র ১৯ মাস। এই সময়ে জনস্বার্থবিরোধী কোনো কাজ তিনি করেছেন, এমন অভিযোগ শোনা যায়নি। তবু ‘জনস্বার্থের’ কথা বলে তাঁকে সরানো হলো। এ পদক্ষেপের সঙ্গে তাঁর সম্মানহানি করার ইঙ্গিত আছে।

হাইকোর্ট বলেছিলেন, নদীর অভিভাবক জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। মনজুর আহমেদ চৌধুরী দেশের নদ-নদী-খালবিল-জলাশয় রক্ষায় কমিশনের অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কাজটি কঠিন ও জটিল। কমিশনের আইনগত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন কিছুটা কঠোর। সারা দেশের অসংখ্য নদ-নদী-খালবিল-জলাশয় দখলদার এবং তাদের সহযোগী রাজনৈতিক শক্তি ও আমলাতন্ত্র মনজুর আহমেদ চৌধুরী উদ্যোগকে সহজভাবে নেয়নি।

মনজুর আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। দুই মাস আগে কমিশনের সবচেয়ে দক্ষ দুই কর্মকর্তাকে ‘স্ট্যান্ড রিলিজ’ করা হয়। এ বিষয়ে মনজুর আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নদী ও জমির আইনকানুন এই দুই কর্মকর্তা অনুপুঙ্খ বুঝতেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাঁদের বদলি করলেও পেছনে ছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। মাঠপর্যায়ে কমিশনের কাজে সহায়তাদানকারী কয়েকজন কর্মকর্তাকেও শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে।

কর্ণফুলী, মেঘনা ও আড়িয়ল খাঁর অবৈধ দখল উচ্ছেদে তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এসব নদী অবৈধভাবে দখলকারী লুটেরা ব্যবসায়ী, তাঁদের সহায়তাকারী আমলা এবং তাঁদের পেছনে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের কথা মনজুর আহমেদ চৌধুরী জনসমক্ষে বলেছেন। প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে তিনি বলেছেন, প্রতিটি অভিযোগের তথ্যপ্রমাণ কমিশনে আছে।

যাঁরা নদী দখল করেছেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন, কর্ণফুলী নদীকে টুকরা টুকরা করে ইজারা দিচ্ছেন, তাঁরা মনজুর আহমেদ চৌধুরীকে শত্রু হিসেবে নিয়েছেন। তাঁদের স্বার্থকেই কি সরকার ‘জনস্বার্থ’ বলছে? তাঁদের স্বার্থ রক্ষা হলে দেশের নদ-নদী-খালবিল-জলাশয় আরও দ্রুত দখল হয়ে যাবে। সরকার কার স্বার্থকে গুরুত্ব দিল?

বোমা ফাটিয়েছিলেন ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী রক্ষা দিবসের অনুষ্ঠানে। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী নদী টুকরা টুকরা করে অবৈধভাবে লিজ দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের কাছে। এই কাজে সহায়তা করছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

একই অনুষ্ঠানে তিনি আঙুল তুলেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির দিকে। তিনি শিক্ষামন্ত্রীর নাম উল্লেখ করেননি। তিনি বলেছিলেন, মেঘনা নদী থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের পেছনে আছেন চাঁদপুরের এক নারী মন্ত্রী। চাঁদপুরে দীপু মনি ছাড়া আর কোনো নারী মন্ত্রী নেই।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা সচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বা অন্য কেউ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যানের এ অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দেননি। গতকাল শনিবার মনজুর আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যে অভিযোগগুলো তুলেছি, সরকারের উচিত হবে তার তদন্ত করে দেখা। জনস্বার্থেই এর তদন্ত হওয়া দরকার।’

মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সময়কালে নদ-নদীর অভিভাবক হিসেবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন অন্যান্য কাজের পাশাপাশি দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। দেশের নদ-নদীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এই তালিকা পূর্ণাঙ্গ বা চূড়ান্ত নয়। দালিলিক প্রমাণ সাপেক্ষে নদ-নদীর সংখ্যায় পরিবর্তন হতে পারে, পরিবর্তন হবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নদীর একটি সংজ্ঞা দিয়েছে। এই সংজ্ঞাও সবার মনঃপুত হয়নি। সাধারণ মানুষ, কবি-সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, পানিবিশেষজ্ঞ, নদীবিশেষজ্ঞ—একেকজনের কাছে নদীর গুরুত্ব, প্রয়োজন, অর্থ একেক ধরনের। কমিশনের দেওয়া সংজ্ঞায় সবার মন রক্ষা হয়নি।

নদীর সংখ্যা ও সংজ্ঞার ভিত্তি হচ্ছে হাইকোর্টের রায়, অর্থাৎ আইন। নদীর সংজ্ঞা ঠিক না হলে কাকে নদী বলা হবে, নদীর দৈর্ঘ্য কতটা, কতটা নদীর জমি, নদী কতটা দখল হয়েছে, তার কোনো কিছুই নিরূপণ করা যাবে না। অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করার উপায় আছে নদীর সংজ্ঞায়। এটা অসাধুজনের পছন্দ হয়নি।

বহু বছর ধরে নদী-পানি নিয়ে কাজ-গবেষণা করছেন, এমন বিজ্ঞানী-গবেষকেরা নদীর সংজ্ঞা তৈরির উদ্যোগ নেননি, সংখ্যা নির্ধারণে কাজ করেননি। তাঁরা মনজুর আহমেদ চৌধুরীর কাজকে স্বাগত জানাননি। যাঁরা নদী দখল করেছেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন, কর্ণফুলী নদীকে টুকরা টুকরা করে ইজারা দিচ্ছেন, তাঁরা মনজুর আহমেদ চৌধুরীকে শত্রু হিসেবে নিয়েছেন। তাঁদের স্বার্থকেই কি সরকার ‘জনস্বার্থ’ বলছে? তাঁদের স্বার্থ রক্ষা হলে দেশের নদ-নদী-খালবিল-জলাশয় আরও দ্রুত দখল হয়ে যাবে। সরকার কার স্বার্থকে গুরুত্ব দিল?

  • শিশির মোড়ল প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি