কোয়াড সম্মেলনে বাইডেনের না যাওয়া কী বার্তা দিচ্ছে

২৪ মে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল কোয়াড শীর্ষ সম্মেলন। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জি–৭ সম্মেলন শেষে দেশে ফিরে যাওয়ায় জোটের ভবিষ্যৎ এবং এর উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে ২৪ মে জোট কোয়াডের (কিউইউএডি) শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। এতে উপস্থিত থাকার কথা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। রাষ্ট্রীয় ঋণসীমা নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে সম্প্রতি যে জটিলতা দেখা দিয়েছে, তার অজুহাত দেখিয়ে বাইডেন হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত জি–৭ শীর্ষ সম্মেলন শেষে সোজা দেশে ফিরেছেন তিনি। স্বাগতিক দেশ অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ নিরুপায় হয়ে দুঃখভারাক্রান্ত মনে শীর্ষ সম্মেলন বাতিল ঘোষণা করেন। অথচ এই শীর্ষ সম্মেলনের জন্য তিনি গত অক্টোবর বাজেটে ২৩ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রেখেছিলেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। অস্ট্রেলিয়ার পত্রপত্রিকা প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার—‘মেরিন ওয়ান’–এর ছবি ছেপেছিল। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সফরটি বাতিল হবে—এমনটি কেউ ভাবেননি। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী দেশ পাপুয়া নিউগিনিও হতবাক। বাইডেনের সফর উপলক্ষে সে দেশে এক দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল।

বাইডেনের এই আকস্মিক সিদ্ধান্তের একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থাকতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত নানা জরিপে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে বাইডেনের জনপ্রিয়তা কমছে। সম্ভবত সেটি একটি কারণ হতে পারে। এই যুক্তি সত্যি হলে সেটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও বেশি বিব্রতকর।

জোট চীনবিরোধী রূপ নিয়েছে

যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া—এই চার দেশ ২০০৭ সালে এই জোট গঠন করে । জোট গঠনে তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। তবে পেছন থেকে মূল কলকাঠি নেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জোটটি অনেক দিন নিষ্ক্রিয় ছিল।

কিন্তু ২০১৭ সালে আবে আবার জাপানের প্রধানমন্ত্রী হলে জোটের সদস্যরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সরকারি ভাষ্যমতে বলতে হয়, জোটটির উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নৌ যাতায়াতকে মুক্ত রাখা, গণতন্ত্রের সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়া এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। চীন অবশ্য এই জোটকে এই অঞ্চলে তার ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে সীমিত করার মার্কিন পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইউরোপে সামরিক সংগঠন ন্যাটোর মতো এই জোটও যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে দক্ষিণ এশিয়ায় একই ভূমিকা পালন করবে। চীনের দ্রুত উত্থানকে যুক্তরাষ্ট্র তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। যদিও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ডিয়েগো গার্সিয়াসহ অস্ট্রেলিয়ার পাইন গ্যাপ, ডারউইন, জেরালটনের গোয়েন্দা স্যাটেলাইট স্টেশনের মতো অসংখ্য সামরিক ঘাঁটি চীনকে ঘিরে রেখেছে এবং নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে।

জাপানের শিনজো আবের দল চীনবিরোধী অবস্থানকে তাদের দলের অন্যতম নীতি হিসেবে স্থান দিয়েছে। এই উগ্র চীনবিরোধিতা আবে পেয়েছিলেন তাঁর দাদা নবরু কিশির কাছ থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কিশি চীনের মাঞ্চুরিয়া প্রদেশ দখলে নেতৃত্ব দেন এবং সেখানে গণহত্যায় অংশ নেন। যুদ্ধ শেষ হলে কিশি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হন। তবে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে কাছে টানতে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনেনি। কিশি বা আবে জাপানের ঐতিহাসিক অপরাধের জন্য চীনের কাছে কখনো ক্ষমা চাননি।

মার্কিন কূটনীতির ব্যর্থতা

এই শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা। এতে সবচেয়ে খুশি হয়েছে চীন। চীন এখন বলতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে একটি অকার্যকর দেশ, তার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান অস্থিতিশীল, কংগ্রেস অকার্যকর এবং দলভিত্তিক বিভেদে দ্বিধাবিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্র কোনো নির্ভরশীল মিত্র নয়। সে অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক, যেকোনো কারণেই হোক, মিত্রদেশকে ছাড়তে পারে। সে দেশ নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবে না। নইলে এই গুরুত্বপূর্ণ জোট সম্মেলনকে অবজ্ঞা করে বাইডেন দেশে ফিরতেন না।

অস্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও কোয়াড বাতিল হওয়ার প্রতিক্রিয়া মিশ্র। দেশের অনেকে চায় না, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আর কোনো জোটে অন্তর্ভুক্ত হোক অস্ট্রেলিয়া। ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এএনজেডইউএস নিরাপত্তা চুক্তি করেছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই চুক্তিতে নিউজিল্যান্ডও যোগ দিয়েছিল। পরে অবশ্য নিউজিল্যান্ড তার জলসীমায় মার্কিন পারমাণবিক সাবমেরিনের অনুপ্রবেশে ক্ষুব্ধ হয়ে জোট ত্যাগ করে। এই জোট অস্ট্রেলিয়াকে কতটুকু নিরাপত্তা দিয়েছে, সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। ১৯৯৯ সালে পূর্ব তিমুরে সংকট চলাকালে অস্ট্রেলিয়া মার্কিন সামরিক সহায়তা চেয়েছিল। কিন্তু তারা কোনো সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।

অস্ট্রেলিয়া ১৯৫৪ সালে কমিউনিস্ট দেশগুলোর বিরুদ্ধে সাউথইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন (এসইএটিও) নামের জোটে যোগ দেয়। মাত্র ২৩ বছর পর ১৯৭৭ সালে জোটটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এসইএটিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চীন ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় সমাজতন্ত্রের বিস্তাররোধে। ওই জোটে এশিয়া থেকে কেবল ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড যোগ দিয়েছিল। অন্য এশীয় দেশ হিসেবে ছিল পাকিস্তান। জোটের মূল ক্ষমতা ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার হাতে। এরাই জোটের ৭৫ শতাংশ সামরিক–বেসামরিক ব্যয় বহন করত।

নতুন কোয়াড জোটকেও অনেকটা এসইএটিওর মতো দেখা হচ্ছে। এর পেছনে কোনো আঞ্চলিক সমর্থন নেই, নেই কোনো অভিন্ন লক্ষ্য। কোয়াডের ভাগ্যও এসইএটিওর মতো হতে পারে, তার নানা আলামত বেশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের দিকে দৃষ্টি দিলে সেটা স্পষ্ট।

চার দেশের চারজন নেতা

চীনের শক্তিশালী হওয়াটা নেতিবাচক নয়। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ চীনের শক্তিশালী হওয়াকে নেতিবাচকভাবে দেখে না। তারা মনে করে, চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে তাদের অগ্রগতি সম্পর্কিত। আসিয়ান সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ২০১২ সালে চীনের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২১ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার কোটি ডলারে। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতিটি দেশ আজ চীনের ওপর নির্ভরশীল।

জাপানের সবচেয়ে বড় রপ্তানি পণ্যের বাজার চীন। জাপানের এক–পঞ্চমাংশ রপ্তানি হয় চীনে। চীন অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় রপ্তানির দেশ। অস্ট্রেলিয়ার ৩০ শতাংশ বাণিজ্য নির্ভর করে চীনের ওপর।

অস্ট্রেলিয়ার ৪০ শতাংশ পণ্য চীনে যায় এবং চীনের ২৭ শতাংশ পণ্য আসে অস্ট্রেলিয়ায়। এমনকি দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা সত্ত্বেও চীন হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। ভারতে চীন থেকে আমদানি করা পণ্য যুক্তরাষ্ট্র (দ্বিতীয়) এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত (তৃতীয়) এই দুই দেশের সম্মিলিত রপ্তানির চেয়েও বেশি। নানা সম্পর্কের কারণে ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কও বেশ ঘনিষ্ঠ।

গত ডিসেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নানা ক্ষেত্রে ২৮টি চুক্তি করেন। এর মধ্যে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর, জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা খাত অন্তর্ভুক্ত। রাশিয়া থেকে ভারত এস–৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা কিনতে চায়। ভারত, ব্রাজিল, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে মিলে ব্রিকস (বিআরআইসিএস) গঠন করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সক্রিয় কোনো ভূমিকা রাখেনি ভারত।

রাশিয়ার নিন্দায় জাতিসংঘের নেওয়া বিভিন্ন প্রস্তাবের পক্ষে ভারত ভোট দেয়নি। সেদিক থেকে ভাবলে এই জোটে ভারতকে বেখাপ্পা দেখায়। ভারতীয় নৌবাহিনী দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নৌবাহিনীকে মোকাবিলা করবে, এমন ধারণা কল্পনা করাও কঠিন। ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন বা ইন্দোনেশিয়ার মতো এশীয় দেশগুলো এই জোটে কেন যোগ দিল না, সেটিও বড় প্রশ্ন। তাদের এই অনীহার অর্থ হতে পারে, এশিয়ার জন্য কোয়াডের মতো একটি জোটের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে তারা মনে করে না। 

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এই জোটের আদর্শ নয়

‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের’ ওপর ভিত্তি করে এই জোট প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে নানা প্রশ্ন উঠতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক একনায়কতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব তার গণতান্ত্রিক বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। জো বাইডেন সৌদি প্রিন্স সালমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। জামাল খাসোগির হত্যার ষড়যন্ত্রে তাঁর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে। এই জোটের অন্যতম সদস্য ভারত গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে কীভাবে এই জোটে যুক্ত হয়, সেটিও প্রশ্নবোধক।

কারণ, হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শের ধারক নরেন্দ্র মোদির শাসনাধীনে ভারতে নাগরিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার ও সংখ্যালঘুর অধিকার পদদলিত হচ্ছে। সুইডেনের ভি-ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের মূল্যায়নে ভারত ‘গণতান্ত্রিক একনায়কতান্ত্রিক দেশ’। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস ভারতকে আংশিক মুক্ত গণতান্ত্রিক দেশ বলে উল্লেখ করেছে। এখানেই কোয়াডের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শেষ নয়। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গণতান্ত্রিক দেশ নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া। তারা এই জোটে কেন যোগ দেয়নি, সেটিও একটি প্রশ্ন।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অশনিসংকেত

কোয়াড জোট অস্ট্রেলিয়াকে অগ্রবর্তী ঘাঁটি হিসেবে ভাবতে চায়। তবে এখানকার জনগণের একাংশ কোয়াডের প্রতি মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে এবং অতিমাত্রায় মার্কিনপ্রীতিসুলভ বৈদেশিক নীতি নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছে। অস্ট্রেলিয়াকে চীনবিরোধী লড়াইয়ে বর্শাফলক হিসেবে পেতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। অস্ট্রেলিয়া তার সামরিক বাহিনীতে মার্কিন অ্যাডমিরালদের প্রচুর বেতন দিয়ে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেছে। তাদের দায়িত্ব পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন কেনার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া।

ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ২০২৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক সাবমেরিন অস্ট্রেলিয়ার উত্তরের ঘাঁটি ডারউইন থেকে দক্ষিণ চীন সাগরে টহল দেবে। যুক্তরাজ্যও একইভাবে টহলের কাজে পারমাণবিক সাবমেরিন ব্যবহার করবে।

মূল উদ্দেশ্য, চারদিক থেকে চীনকে ঘেরাও করে তার ভূকৌশলগত সামর্থ্যকে সীমিত রাখা। বিশ্বরাজনীতি আজ যে ধারায় অগ্রসর হচ্ছে, তাতে পৃথিবীকে বহুমুখী সংঘাতের ক্ষেত্র হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এসব কোনো সুখবর নয়। বিশেষ করে ইন্দো প্যাসিফিক এলাকার জন্য এ সবই অশনিসংকেত।

  • বদরুল আলম খান অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন সিডনি, অস্ট্রেলিয়া