জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন হওয়া উচিত

সম্প্রতি ১৯ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত একটি সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তির (ইপিএ) শর্তাবলি নিয়ে ঢাকায় জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি মূলত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিরই (এফটিএ) এক ধরন।

২০২৬ সালের নভেম্বরে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় বাংলাদেশের উত্তরণের (এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন) প্রেক্ষাপটে এই চুক্তি বাংলাদেশ ও জাপান উভয়ের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হলে বাংলাদেশ জাপানের বাজারে বর্তমানে পাওয়া শূন্য শুল্ক রপ্তানি সুবিধা হারাতে পারে। ফলে জাপানে বাংলাদেশি রপ্তানি ১৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কের সম্মুখীন হতে পারে।

বর্তমানে বাংলাদেশের জাপানে রপ্তানির প্রায় ৭৩ শতাংশ এলডিসি বিশেষাধিকারের কারণে শুল্কমুক্ত। জাপান বাংলাদেশের ১২তম বৃহত্তম রপ্তানি বাজার এবং আমদানির সপ্তম বৃহত্তম উৎস। গত অর্থবছরে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি এবং ২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার আমদানিতে পৌঁছেছে। একইভাবে জাপানি বিনিয়োগ বাংলাদেশে ন্যায্য পরিবেশে ব্যবসা করতে পারা জাপানের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশ ও জাপানের ইপিএ সম্পাদনের এই প্রয়াস।

জাপান-বাংলাদেশ যৌথ স্টাডি গ্রুপ দ্বারা আলোচনার জন্য চিহ্নিত ১৭টি সেক্টরের মধ্যে প্রতিযোগিতা নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এই নিবন্ধ জাপান-বাংলাদেশ ইপিএতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা নীতির অবস্থান কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে আলোচনা করবে।

প্রথমেই, প্রতিযোগিতার নীতি আসলে কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। প্রতিযোগিতার নীতি হচ্ছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একে অপরের সঙ্গে ন্যায্যভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিশ্চিত করার নীতি। এর মাধ্যমে বাজারে উদ্ভাবন বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পণ্য উৎপাদনকারী বা সেবা প্রদানকারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে বাজারে ভোক্তারা পছন্দমতো বেছে নেওয়ার জন্য একই মানের অনেক বিকল্প পায়, যা বাজারে পণ্য বা সেবার মূল্য কমাতে সাহায্য করে।

দেখা গেছে ভিন্ন ভিন্ন দেশের প্রতিযোগিতা নীতি ভিন্ন। এতে কোনো দেশ অন্য দেশের পণ্য বা সেবাকে যে ধরনের সুরক্ষা দেয়, অন্য দেশে সেই দেশের পণ্য একই রকম সুরক্ষা না–ও পেতে পারে। ধারণা করা যায়, বাংলাদেশে জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনালের (জেটিআই) সাম্প্রতিক খারাপ অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে জাপানের জন্যও আলোচ্য এই ইপিএ খুব অর্থপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটেই ইপিএ বা এফটিএতে প্রতিযোগিতা নীতিসংক্রান্ত অধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পাদিত বেশির ভাগ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিগুলোতে (এফটিএ) প্রতিযোগিতা নীতিসংক্রান্ত বিষয়ে আলাদা করে অধ্যায় থাকছে। এফটিএ বা ইপিএতে প্রতিযোগিতা নীতি–সংক্রান্ত অধ্যায় মূলত চারটি উদ্দেশ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। প্রথমত, এর মাধ্যমে নিজ দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো, যারা অন্য দেশে ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের ভিন্ন দেশে ওই দেশের বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে রক্ষা করা যায়।

দ্বিতীয়ত, এর মাধ্যমে উভয় দেশেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করা যায়। তৃতীয়ত, চুক্তিভুক্ত দুই দেশেই প্রতিযোগিতা আইনের বৈষম্যমূলক প্রয়োগ রোধ করা যায়।

সর্বশেষ, এফটিএগুলো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার আইনগুলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সাহায্য করে, যাতে বিরোধ এবং বাণিজ্যযুদ্ধের ঝুঁকি হ্রাস পায়। এর মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ দুই দেশ একে অপরের প্রতিযোগিতা আইনের কাঠামো ও প্রয়োগ থেকে শিখতে পারে, যাতে দুই দেশের অর্থনৈতিক খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধি পায় এবং প্রতিযোগিতা আইনের আরও কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়।

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনকে স্বচ্ছন্দ করতে বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে ব্যাপকভাবে বিদেশি বিনিয়োগকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতাবিরোধী কার্যকলাপের ভুক্তভোগীদের জন্য পর্যাপ্ত প্রতিকার প্রদান করা নিশ্চিত করা বাংলাদেশে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ সুরক্ষা প্রদান করার জন্য অপরিহার্য। এই প্রবন্ধ জাপান-বাংলাদেশ ইপিএতে প্রতিযোগিতা নীতি অধ্যায় আলোচনার সময় বাংলাদেশ দল যে নীতিগত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করবে।

এখন পর্যন্ত, বাংলাদেশ ৩৪টি দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি (বিআইটি) এবং ১টি এফটিএ স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তিগুলো সাধারণত সব দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বা তাদের পণ্য বা সেবার সঙ্গে সমান আচরণ করার (মোস্ট ফেভারড নেশন বা এমএফএন) এবং বিদেশি ব্যবসার সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসার (ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট বা এনটি) মতো একই আচরণ করার ধারাগুলো অন্তর্ভুক্ত করে, যা সাধারণভাবে বিদেশিদের সঙ্গে বৈষম্য না করার অঙ্গীকার সম্পর্কিত।

তবে উল্লেখ্য, অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো বাণিজ্যিক চুক্তিতে কখনোই প্রতিযোগিতা নীতির ধারা বা অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সেদিক থেকে জাপানের সঙ্গে আলোচ্য ইপিএ–ই সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি হতে যাচ্ছে, যাতে প্রতিযোগিতা নীতিসংক্রান্ত অধ্যায় থাকতে পারে।

বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আইন বিশ্বমানের নয়; এই আইনের কার্যকরণেও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন বেশ সমস্যার সম্মুখীন হয়, এবং ভুক্তভোগীদের কখনো কখনো ঝামেলা পোহাতে হয়, যদিও তারা কোনো যথাযথ প্রতিকার লাভ করতে পারেন না। জাপান-বাংলাদেশ ইপিএ সম্পাদনের উপলক্ষেই বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আইনকে বিশ্বমানে উন্নীত করে নেওয়া যেতে পারে।

অন্যদিকে জাপানের বেশির ভাগ বিআইটি বা ইপিএতে প্রতিযোগিতা নীতিসংক্রান্ত অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতার ইতিহাসের ভিত্তিতে এ ধরনের চুক্তিগুলোতে প্রতিযোগিতা নীতির নকশাও ভিন্ন। জাপানের ইপিএগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায় যে সাধারণত চুক্তিসংশ্লিষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া থেকে প্রতিযোগিতা নীতিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে ন্যায্যতা এবং স্বচ্ছতা সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো তাদের ইপিএগুলোতে বিদ্যমান (থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে জাপানের চুক্তিতে দেখা যায়)।

বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আইনের কাঠামো ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বিদ্যমান বেশ কিছু কার্যধারা এসব নীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে প্রতিযোগিতা কমিশন একজন সদস্যের (আইন) উপস্থিত ছাড়াই রায় ঘোষণা করছে এবং একই সংস্থা তদন্ত করা ও তার ভিত্তিতে বিচার করার কাজ করছে। উপরন্তু অর্থনৈতিক হিসাব–নিকাশের জন্য ওপর বিশেষজ্ঞ মতামত ব্যবহার করছে না। প্রতিযোগিতা আইনের আওতায় বিচারপ্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না।

একই সঙ্গে প্রতিযোগিতা আইনের যথাযথ প্রয়োগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—সংশ্লিষ্ট বাজার নিরূপণের কোনো মানদণ্ড নির্ধারণ করে কোনো বিধি প্রণয়ন করা হয়নি, বাজারে কর্তৃত্বময় অবস্থানের সীমা নির্ধারিত হয়নি। কাজেই জাপানি আলোচকেরা যদি প্রক্রিয়াগত ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার ওপর জোর দেন, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্য নীতিনির্ধারণী বিষয়ে পরিণত হতে পারে।

জাপানের সঙ্গে কিছু দেশের এফটিএতে এমন বিধান আছে যে অন্য দেশকে তাদের প্রতিযোগিতার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিযোগিতা আইন গ্রহণ করতে হবে বা বিদ্যমান আইনকে সংস্কার করতে হবে (যেমন জাপান-মালয়েশিয়া ইপিএ ২০০৩)।

একটি জাপানি ইপিএতে (যেমন ইইউ-জাপান ইপিএ) প্রতিযোগিতা কর্তৃপক্ষকে সরকার থেকে কার্যকরীভাবে স্বাধীন হওয়ার শর্তারোপ করে। বর্তমান আইনি কাঠামোর অধীনে এটি বাংলাদেশ সরকারের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়। এই বিষয়গুলো জাপানের সঙ্গে আলোচনার সময় বিতর্কের বিষয় হতে পারে।

একই সঙ্গে বলতেই হবে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আইন বিশ্বমানের নয়; এই আইনের কার্যকরণেও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন বেশ সমস্যার সম্মুখীন হয়, এবং ভুক্তভোগীদের কখনো কখনো ঝামেলা পোহাতে হয়, যদিও তারা কোনো যথাযথ প্রতিকার লাভ করতে পারেন না। জাপান-বাংলাদেশ ইপিএ সম্পাদনের উপলক্ষেই বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আইনকে বিশ্বমানে উন্নীত করে নেওয়া যেতে পারে।

কাজেই দেখা যাচ্ছে যে জাপানের প্রতিযোগিতা নীতিসংক্রান্ত বিধানসংবলিত অধ্যায় তৈরি এবং আলোচনার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ একেবারেই অভিজ্ঞতাশূন্য। তাই বাংলাদেশি সরকারের জন্য ইপিএতে এই নীতিগুলোর প্রভাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করা অপরিহার্য। তবে সরকারি উদ্যোগে এ–সংক্রান্ত কোনো গবেষণার সন্ধান মিলে না।

যাহোক, এখনো সময় আছে, কারণ এই আলোচনাগুলো সাধারণত এক বা দুই বছর স্থায়ী হয়। একই সঙ্গে বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তিতে প্রতিযোগিতার নীতির অবস্থান কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নীতি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এই গবেষণা ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে এফটিএ সম্পাদনের ক্ষেত্রেও কাজে আসবে। কারণ, সব উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশই এফটিএ সম্পাদনের সময় নিজ দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ভিন্ন দেশে সুরক্ষা প্রদান করতে প্রতিযোগিতা নীতিসংক্রান্ত অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করতে চাইবে।

পরিশেষে বলতে চাই, চলমান ইপিএ সম্পাদন সংক্রান্ত আলোচনায় বাংলাদেশকে অবশ্যই তার দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলো মাথায় রাখতে হবে। সম্ভাব্য জাপান-বাংলাদেশ ইপিএতে প্রতিযোগিতা নীতির বিষয়ে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান বাংলাদেশের স্থানীয় ব্যবসায়গুলোকে তাদের জাপানি সমকক্ষদের সঙ্গে সমান তালে প্রতিযোগিতা করতে পারার ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে জাপানি বিনিয়োগের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।

  • আজহার উদ্দিন ভূঁইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক