বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখাই কি উদ্দেশ্য

অনেকেই যেমনটি আশঙ্কা করছিলেন, তা-ই ঘটতে শুরু করেছে। বিরোধী দল বিএনপির আন্দোলনের কর্মসূচিগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা যে রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে তুলবে এবং তার কারণে সহিংসতা, অঙ্গহানি ও প্রাণহানির মতো দুঃখজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, সেটি বিবেচনায় নিয়েই নাগরিক সমাজের অনেকেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। সংঘাত হতে পারে—এমন কর্মসূচি এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ধারণা, সম্ভবত পাল্টা কর্মসূচি না দিলে মানুষ তাঁদের ক্ষমতাহীন ভাববে।

রাজনৈতিক সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য আলোচনার আহ্বান উপেক্ষা করে তাই চলছে সমাবেশের পাল্টা সমাবেশ, মিছিলের জবাবে মিছিল। কর্মসূচির জবাবে কর্মসূচি ভিন্ন দিনে, ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন আঙ্গিকে করার সুযোগ থাকলেও তেমনটি হচ্ছে না। উপরন্তু আছে বিরোধীদের কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা; সেটা কখনো মারধর করে, আবার কখনো সুতোর টানে যানবাহন বন্ধ করে দিয়ে; আর উত্তেজনার পারদ চড়ানো ভাষায় বক্তৃতা তো আছেই।

সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা যেটি লক্ষণীয়, তা হলো পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বিরোধীদের ওপর চড়াও হয়। এতে যদি কারও ধারণা হয় যে তারা একযোগে অথবা সমন্বয় করে বিরোধীদের দমন অভিযানে নেমেছে, তাহলে তা কি অযৌক্তিক হবে? লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতার প্রাণহানি, বগুড়া, জয়পুরহাট, কিশোরগঞ্জ, ফেনী, খাগড়াছড়ি, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম ও দিনাজপুরে সহিংসতায় যেসব রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ জখম হলেন, এগুলোর সবই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির হতভাগা শিকার। এসব ঘটনা যে সহজেই এড়ানো যেত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

বছরখানেক ধরে বিএনপি যে আন্দোলন করে চলেছে, তাতে যে বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তা হলো তারা সহিংসতা এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে সচেষ্ট। কোনো ধরনের উসকানিতে বা ফাঁদে পা না দেওয়ার একটা সচেতন প্রয়াস তাদের বিভিন্ন স্তরের কর্মসূচিতেই লক্ষণীয়। তারা সাংগঠনিক অন্তঃকলহে নিজেরা নিজেরা লড়াই করে, খুনখারাবিও করে এবং সেগুলোর কারণে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলন এখন পর্যন্ত এমন জায়গায় যায়নি, যাকে সহিংস বলা যাবে। 

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, মতপ্রকাশ এবং সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদের আশ্বস্ত করার পর সপ্তাহ না পেরোতেই, এমনকি ইইউর প্রতিনিধিদল ঢাকা ছাড়ার আগেই সহিংসতা উদ্বেগজনক রূপ নিয়েছে। এসব সহিংসতায় ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের আগ্রাসী ভূমিকা যেমন প্রকটভাবে দেখা গেছে, তেমনই দেখা গেছে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারমুখী মনোভাব এবং মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের নমুনা। এগুলো সরকারবিরোধীদের যে আরও উত্তেজিত ও ক্ষুব্ধ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, উসকানি দিয়ে বিরোধী দলকে ফাঁদে ফেলা হচ্ছে কি না? 

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক পরিসরে আগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং তারা নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, তখন ক্ষমতাসীন দল কেন আরও অগণতান্ত্রিক ও অসহিষ্ণু আচরণ করছে, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাত করছে এবং সহিংসতা বিস্তারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ইইউ আগেই বলেছে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ না হলে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। যুক্তরাষ্ট্রও ব্যতিক্রম করবে বলে মনে হয় না। তাহলে কি ক্ষমতাসীন দল আসলে একতরফা নির্বাচনের পথেই হাঁটছে? 

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় সে রকম আলামতই দেখা যাচ্ছে। নোয়াখালীতে বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশ কর্মসূচিতে অংশ নিতে যাওয়ার পথে ফেনীতে দলটির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা এবং উল্টো আহত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা দায়েরের আর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? এর আগেও অন্য কয়েকটি জেলায় একই ধরনের ঘটনা অর্থাৎ বিরোধীদের ওপর হামলা এবং তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়েরের অভিযোগ আছে। 

এসব মামলায় যা লক্ষণীয়, তা হচ্ছে আসামির সংখ্যা ডজন নয়, শতকের ঘরে ঠেকে। মামলার আসামিদের তালিকায় থাকেন ওই এলাকায় যাঁদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর ইতিহাস আছে বা সম্ভাবনার কথা শোনা যায়, তাঁরা এবং অনেক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি। সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে অথবা প্রার্থী হলেও আদালতে ব্যস্ত রাখার উদ্দেশ্য থেকে মামলায় জুড়ে দেওয়া হয়। আর অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা থাকেন প্রয়োজন ও সুবিধামতো যে কাউকে গ্রেপ্তার ও হয়রানির জন্য।

সম্প্রতি দুটি ইংরেজি কাগজ ডেইলি স্টারনিউ এজ পুলিশ সদর দপ্তরে বিরোধীদের ধরপাকড়ের একটি পরিকল্পনার খবর প্রকাশ করে। এরপর ১৭ জুলাই ভয়েস অব আমেরিকার ইংরেজি ওয়েবসাইটে একই বিষয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম হচ্ছে: ‘বাংলাদেশি পুলিশ অ্যাকিউজড অব কনস্পায়ারিং অ্যাগেইনস্ট অপজিশন ক্যান্ডিডেটস’। এসব খবরের সূত্র হচ্ছে পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের একটি সভার ফাঁস হওয়া কার্যবিবরণী।

পুলিশের পক্ষ থেকে ওই কার্যবিবরণীর সত্যতা অস্বীকার করে যেমন কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি, তেমনি ভয়েস অব আমেরিকা বিষয়টি সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাইলে পুলিশের তথ্য বিভাগ কোনো মন্তব্য করেনি। এসব খবরে বলা হয়েছে, ওই সভায় আলোচনা হয়েছে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যত মামলা আছে, সব কটি সচল করতে হবে এবং তাঁদের বিচার দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য আদালতগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে পুলিশ নিয়মিত আইন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নেবে। 

ডেইলি স্টার-এ অবশ্য দুটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। ১০ জুলাই তাদের শীর্ষ সংবাদ শিরোনামেই বলা হয় আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে পুরোনো মামলা সচল করার উদ্যোগ। আর পরদিন প্রথম পাতাতেই দ্বিতীয় প্রধান শিরোনামে বলা হয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হাইকোর্টে স্থগিত হয়ে থাকা ২৫টি মামলা বাছাই করেছে এবং সেগুলো তদন্ত কর্মকর্তাদের দ্রুত তদন্ত শেষ করে শুনানির ব্যবস্থা নিতে ডিএমপির ডেপুটি কমিশনারদের নির্দেশ দিয়েছে। এসব মামলায় বিএনপির সব শীর্ষ নেতা আসামি।

এসবের মধ্যে ঢাকা-১৭-এর উপনির্বাচনে যা ঘটে গেল, তার তাৎপর্যও উপেক্ষণীয় নয়। হিরো আলমের ওপর হামলাকারী নৌকার সমর্থকদের মুখে কিন্তু শোনা গেছে, ‘সে করে টিকটক, সে হলো জোকার, সে কেন গুলশান-বনানীর এমপি হতে চায়? এমপির মানে সে জানে?’ এর অর্থ হচ্ছে, এমপি হতে চাওয়ার অধিকার একমাত্র তাঁদের, যাঁরা নৌকা প্রতীক পান।

আবার ভোটকেন্দ্রের ভেতরে হামলার শিকার হলে হিরো আলমকে পুলিশ উদ্ধার করে কেন্দ্রের বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসে। সেখানে অপেক্ষমাণ নৌকার ব্যাজধারীরা যখন তাঁকে মারধর করে, তখন পুলিশ তাঁকে রক্ষায় যেমন ভোটকেন্দ্রের বাইরে বের হয়নি, তেমনি সেখানে টহলরত বর্ডার গার্ডসের ইউনিটও দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। যে প্রার্থী প্রচার শুরুর দিনেই ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন, তাঁর নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা বা বাড়তি সতর্কতা না নিয়ে নির্বাচন কমিশনও যে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।

এসব ঘটনা থেকে যেসব লক্ষণ স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র কাউকেই অধিকারচর্চার কোনো সুযোগ না দিতে মোটামুটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দলীয় আচরণের স্বভাব পরিত্যাগে রাজি নয়। উপরন্তু ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিরোধীদের দমন-পীড়নে অংশ নিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনও স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ ও আচরণবিধি কার্যকর করে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন পরিচালনায় সক্ষমতার কোনো প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। 

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক পরিসরে আগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং তারা নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, তখন ক্ষমতাসীন দল কেন আরও অগণতান্ত্রিক ও অসহিষ্ণু আচরণ করছে, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাত করছে এবং সহিংসতা বিস্তারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ইইউ আগেই বলেছে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ না হলে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। যুক্তরাষ্ট্রও ব্যতিক্রম করবে বলে মনে হয় না। তাহলে কি ক্ষমতাসীন দল আসলে একতরফা নির্বাচনের পথেই হাঁটছে? 

বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অনুপস্থিতিতে কী কী সুবিধা ক্ষমতাসীন দল পেতে পারে, তার নজির তো ২০১৮ সালে আছেই। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল কিছুদিন আগে যে আশঙ্কার কথা বলেছিলেন—সরকার বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চায়, সেটাই কি ঘটতে চলেছে? তা না হলে বিরোধীদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে ক্ষমতাসীনেরা এত কিছু করবে কেন? 

কামালআহমেদ সাংবাদিক