মতামত

বিএনপির পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়ার চেষ্টা কেন আওয়ামী লীগের?

বিএনপি সমাবেশ ডাকলেই ওই দিনই আওয়ামী লীগের ‘পাহারা’ কর্মসূচি দেওয়া প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাাঁড়াচ্ছে।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রতি বছর ১০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী অঙ্গসংগঠনগুলো উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করে থাকে। এই দিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা সভা-সমাবেশও করে থাকে। এবারও নিশ্চয়ই তারা সেটি করবে। কিন্তু ১১ জানুয়ারি ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগ কেন মাঠে থাকার কর্মসূচি নিয়েছে, সেটা বোধগম্য নয়। দলীয় নেতা-কর্মীদের হত্যা ও জেল-জুলুমের প্রতিবাদে ২৪ ডিসেম্বর বিএনপি সারা দেশে গণমিছিলের কর্মসূচি নিয়েছিল। কিন্তু ওই দিন ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন থাকায় বিএনপি তাদের ঢাকার কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয় এবং ৩০ ডিসেম্বর সেটি পালন করে।

এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির নেতাদের প্রতি ২৪ তারিখে ঢাকার কর্মসূচি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। বিএনপি তাদের সেই অনুরোধ রক্ষা করে ঢাকায় কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তন করে। যুধ্যমান রাজনীতিতে এটিকে দেশবাসী ব্যতিক্রমী ভালো দৃষ্টান্ত হিসেবে নিয়েছিল। ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণমিছিলের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবেই অনুষ্ঠিত হয়। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। রীতি অনুযায়ী তারা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বা ডিএমপির অনুমতিও নেয়। ওই দিন বিএনপির পাশাপাশি তাদের সমমনা কয়েকটি দল ও জোট গণমিছিলের আয়োজন করে। কোনো সমস্যা হয়নি। যদিও জামায়াতে ইসলামী পুলিশের ভাষায় বিনা অনুমতিতে মিছিল করলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশ জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারও করে।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেওয়া হয় এবং সেই জোটের অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি দল আলাদা জোট গঠন করে, যাতে জামায়াতে ইসলামী নেই। বিএনপির নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামী নামে কোনো দল তাদের জোটে নেই।

বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট যেদিন ঢাকা শহরে গণমিছিলের আয়োজন করে, সেদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও মাঠে ছিল। তারা ঢাকার দুটি স্থানে গণসমাবেশ করেছে। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীরাও পাড়ায় পাড়ায় পাহারা দেওয়ার কাজ করেছেন। তাদের ভাষায় বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা যাতে কোনো রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে না পারে, সে জন্যই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা পাহারায় ছিলেন।

তাঁদের এই পাহারা কর্মসূচি কয়েক মাস আগে থেকেই চলে আসছিল। এমনকি ১০ ডিসেম্বর এই পাহারার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকায় সড়কের মোড়ে মোড়ে চৌকি বসিয়ে পথচারীদের মুঠোফোন তল্লাশি করেছে। যাঁদের মুঠোফোনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বার্তা দেখেছেন, তাঁদের ‘শাস্তি’ও দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী অঙ্গসংগঠনের নেতারা এসব করেছেন, জননিরাপত্তার দোহাই দিয়ে। অর্থাৎ জনগণের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব তাঁরা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন। জননিরাপত্তার কাজ যদি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা করে থাকেন, তাহলে দেশে সরকার, জনপ্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কী প্রয়োজন? তাঁদের এসব কর্মকাণ্ড কেবল আইনের বরখেলাপ নয়, সরকারের প্রতিও চরম অনাস্থারই প্রকাশ।

আমাদের ধারণা ছিল, ১০ ও ৩০ ডিসেম্বরের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এ রকম আত্মঘাতী ও জনগণের জন্য বিরক্তিকর কর্মসূচি নেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো সংগঠনের অধিকার আছে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার। সমাবেশের নামে কেউ শান্তি বিঘ্নিত করলে, তার বিরুদ্ধে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অতীতে ক্ষমতাসীনেরা যে ধরনের অগণতান্ত্রিক ও হঠকারী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছে, তারাও সেই একই পথে হাঁটছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়ে জনগণকে শিক্ষা দেওয়ার পথই বেছে নিয়েছে।

বিএনপির গণ-অবস্থানের কর্মসূচি আগেই ঘোষণা করা হয়েছে ১১ জানুয়ারি। আওয়ামী লীগও চাইলে অন্য দিন তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতে পারে। এটাই গণতন্ত্রের রীতি। কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি সেটা না করে ১১ জানুয়ারিতে পাহারা কর্মসূচির জন্য গো ধরে বসে থাকে, সেটা হবে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করা। একই দিন আওয়ামী লীগের কর্মসূচির দুটি উদ্দেশ্য হতে পারে। প্রথমত, ওই দিন বিএনপি ও তাদের সহযোগীদের সঙ্গে নিজেরাও আলোচনায় থাকা। সংবাদমাধ্যমে কাভারেজ পাওয়া। ক্ষমতাসীন দল তো সব সময়ই মিডিয়া কাভারেজে এগিয়ে। তাদের উপজেলা পর্যায়ের নেতা বক্তব্য দিলেও সেটি গণমাধ্যমে আসে। সে জন্য বিএনপির কর্মসূচির দিনই কেন বেছে নিতে হবে?

দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হলো, বিএনপি বা বিরোধী দলের কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করা। একই শহরে দুই বড় দলের পাশাপাশি বা কাছাকাছি কর্মসূচি থাকলে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। এসব ক্ষেত্রে সরকার বা প্রশাসনের একটিই কাজ হয়, দুই পক্ষকেই কর্মসূচি থেকে বিরত রাখা। স্থানীয় পর্যায়ে এ রকম ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। কিন্তু ঢাকায় একটি বড় দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে তার পুনরাবৃত্তি কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না।

গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকলে আওয়ামী লীগের ১১ তারিখ কোনো কর্মসূচি নেওয়া উচিত হবে না। কারণ এতে জনশান্তি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাদের উচিত, কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেওয়া। তা ছাড়া কর্মদিবস হিসেবে ১১ জানুয়ারি অফিস আদালত সবই খোলা, এমন দিনে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিলে কোনো অঘটন ঘটলে  তার দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।

আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, বিএনপি ১১ জানুয়ারি যে অবস্থান কর্মসূচি নিয়েছে, সেটি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে দেওয়া। আওয়ামী লীগ চাইলে অন্য দিন কর্মসূচি পালন করুক। গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকলে আওয়ামী লীগের ১১ তারিখ কোনো কর্মসূচি নেওয়া উচিত হবে না। কারণ এতে জনশান্তি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাদের উচিত, কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেওয়া। তা ছাড়া কর্মদিবস হিসেবে ১১ জানুয়ারি অফিস আদালত সবই খোলা, এমন দিনে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিলে কোনো অঘটন ঘটলে  তার দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।

একটানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে একটুকু রাজনৈতিক পরিপক্বতা আশা করা নিশ্চয়ই দুরাশা হবে না।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি।

    ইমেইল: sohrabhassan55@gmail.com