মতামত

শিশু রিফাতের কাছে জাতীয় মাছ কেন পাঙাশ?

ক্লাসরুমে শিক্ষকের প্রশ্নে সরলমাখা চেহারার রিফাতের আত্মবিশ্বাসী ভুল উত্তর নেট দুনিয়ায় মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। সেই ভুল উত্তরে লুকিয়ে আছে দেশের আর্থ–সামাজিক পরিস্থিতির কঠিন এক বাস্তবতা
ছবি: ফেসবুক ভিডিও থেকে সংগৃহীত

গ্রামের নিতান্ত সাধারণ শিশু রিফাতের সরলতায় অনেকেই মুগ্ধ হয়েছেন, কারও চোখে পানি এসেছে! দেশের সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকার বাজেটে তার মতো মাদ্রাসাপড়ুয়া প্রায় ১৪ লাখ কওমি, হাফেজি, নুরানি ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য মোট বরাদ্দকৃত অর্থ শূন্য টাকা। কওমি শিক্ষার উচ্চ স্তরের ‘নামমাত্র’ স্বীকৃতি সেখানে রাজনীতির উপস্থিতিকে জানান দিলেও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার দিক থেকে বিষয়টি লাখ লাখ শিশুর ভাগ্য নির্ধারণে সরকার ও রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিকেও নির্দেশ করে।

ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে শিশু রিফাতকে ক্লাসে শিক্ষক প্রশ্ন করছেন, আমাদের জাতীয় মাছ কী? রিফাত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চিৎকার করে উত্তর দিচ্ছে, জাতীয় মাছ পাঙাশ! ছোট্ট হয়েও শিশুটি সবচেয়ে যৌক্তিক উত্তরই দিয়েছে। দেশের ধনবৈষম্য আমাদের গরিবদের এমন প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে, যাদের কাছে ইলিশ, গরু, মুরগিসহ প্রাণিজ প্রোটিন আজ সোনার হরিণ অর্থাৎ ‘ফার বিয়োন্ড লাক্সারি’। রিফাতদের আমিষের একমাত্র উৎস পাঙাশই, ফলে তাঁর চোখে যৌক্তিকভাবেই পাঙাশ জাতীয় মাছ হওয়ার দাবিদার!

জাতিসংঘের চরম দারিদ্র্য ও মানবাধিকারবিষয়ক স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার অলিভিয়ার ডি শুটার বলেছেন, ‘বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্যের সূচকগুলো সমাজের পুরো চিত্রকে তুলে ধরছে না। এখানে আয়বৈষম্য বাড়ছে। সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন দরিদ্র।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বাজেটের একটা বড় অংশ সরকারি কর্মচারীদের পেনশনে ব্যয় করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চরম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসা অনেক মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার সামান্য ওপরে উঠেছে। হঠাৎ কোনো বিপদ এলে সেটা মোকাবিলা করার মতো অবস্থা তাদের নেই। অনেক পরিবার, দারিদ্র্যসীমার ঠিক ওপরে উঠে এলেও তাদের টিকে থাকার সামর্থ্য নেই। তাদের অর্থ সঞ্চয় করা বা পুঁজি জমানোর সক্ষমতা নেই। ধাক্কা সামলানোর মতো কোনো সম্পদ তাদের নেই। তাদের আমিষ কেনার সামর্থ্য নেই। ফলে, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভঙ্গুর।’ মি. শুটার মনে করেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উঠে আসার ধাক্কা সামলাতে বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল পরিবর্তন করা উচিত। (বিবিসি বাংলা, ৩০ মে ২০২৩)।

বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাস্থ্য ব্যয়ে বিপর্যস্ত হয়ে; পুষ্টিহীনতায় পড়ে; বন্যা, খরা, ঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুজনিত ফসলহানি ও বাস্তুচ্যুতিতে পড়ে, বেকারত্ব দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ জ্বালানির মূল্যের কারণে বাংলাদেশে মানুষ নতুন করে দরিদ্র্য হচ্ছে। নতুন দারিদ্র্যকে মোকাবিলায় সরকারের ৬০০ থেকে ৯০০ টাকার মাসিক ভাতা (বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, বিধবা, হিজড়া, শিক্ষা উপবৃত্তি) অকার্যকর।

নতুন বাজেটে ভাতায় টাকার পরিমাণ ১৫০, ১০০ এবং ৫০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে, তথাপি দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল হিসেবে এটা অকার্যকরই থেকে যাবে। এক বছরে জ্বালানির দাম বাড়ানো হলো ৪৫ থেকে ৬০ শতাংশ, অন্যদিকে মাসিক ভাতা বৃদ্ধি করা হলো মাত্র ৫০, ১০০ বা ১৫০ টাকা—এর মাধ্যমে কি ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ জ্বালানি এবং নিম্ন ক্রয়ক্ষমতা’র বিপরীতে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব? এটা দিয়ে মাসে সর্বোচ্চ একবেলা আমিষ কেনা যায়, তাতে পুষ্টির সংকট কমবে না। এর ফলে শিশুশ্রমও বাড়বে, এটিই বাস্তবতা। সেখানে শিক্ষা উপবৃত্তিও কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কারণ শিক্ষা উপবৃত্তির টাকার হার শিশুশ্রমের ২০ ভাগের ১ ভাগ। ফলে স্কুল থেকে ঝরে পড়া রোধ কতটা সম্ভব সেটিও আমাদের ভাবতে হবে।

নতুন শতাব্দীতে গণচীন দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বের সফলতম দেশ। চীনে নতুন দারিদ্র্যকে (নিউ পভার্টি) মোকাবিলায় আবাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মের চাহিদাকে শতভাগ চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে আছে ‘টার্গেটেড পভার্টি এলিভিয়েশন প্রোগ্রাম’, পভার্টি ট্র্যাকিং এবং দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার জন্য আছে ইকোলজিক্যাল মাইগ্রেশন। পরিবেশ সুরক্ষার প্রোগ্রাম, যাতে পরিবেশ বিপর্যয়ে নতুন দারিদ্র্য তৈরি না হয়। আছে রাসায়নিক চাষের একচেটিয়া নির্ভরতার বিপরীতে ফসলি জমির মান সুরক্ষার উদ্যোগ। আছে কর্মদক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা, উৎপাদনমুখী শিল্প কর্মসংস্থান। এর বাইরেও আছে আঞ্চলিক কৃষি–হস্ত–ক্ষুদ্রশিল্পের পণ্য জাতীয় স্তরে পৌঁছানোর ই-কমার্স এবং সাপ্লাই-চেইন।

বিপরীতে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল স্বল্পচিন্তিত, অগভীর এবং অটেকসই। ৬০০ থেকে ৯০০ টাকার ভাতার বাইরে এখানে আছে ‘আলট্রাপুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম’ এবং সম্পদ হস্তান্তরের নামে উচ্চ সুদের ক্ষুদ্রঋণ। এসব মডেল আবেদনহীন এবং নতুন দারিদ্র্যের বিপরীতে অকার্যকর।

নতুন দারিদ্র্যকে মোকাবিলায় আমাদের দরকার নতুন কৌশল। আমাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নীতিনির্ধারকেরা দারিদ্র্য তৈরির ‘নতুন অনুষঙ্গ’, জলবায়ু–দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যদারিদ্র্য, শিক্ষাদারিদ্র্য, জ্বালানিদারিদ্র্য এবং চক্রাকার দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র বোঝেন না বলেই প্রতীয়মান। তাঁরা ক্রমাগত ধনীবান্ধব কর ও শুল্কনীতির মাধ্যমে, বেদরকারি ভর্তুকি ও শুল্কায়ন চালু রেখে দরকারি ভর্তুকি বন্ধ করে ‘নতুন দারিদ্র্য’ তৈরি করেছেন।

আগের দিনে প্রাকৃতিক উৎস থেকে ফ্রি আমিষ ভোজন করা যেত। ক্ষুদ্রঋণের বিস্তারে কিস্তির জ্বালায় ডিম, দুধের স্বাদ ভুলেছে গরিব মানুষ। জনসংখ্যার চাপে গৃহে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালাও এখন বিলাসিতা। হ্যাঁ, ক্ষুদ্রঋণ গরিবদের ‘এক্সেস টু ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম’–এর সুবিধা দিয়েছে, মহাজনের বিপরীতে ‘ফিন্যান্সিয়ালি এম্পাওয়ার’ করেছে, তথাপি এসব মৌলিক প্রয়োজনে রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিকে জানান দেয়। সেকেলে এসব মডেল ‘নিউ পভার্টি’ এবং ‘মাল্টি ডাইমেনশনাল পভার্টি’ মোকাবিলায় অক্ষম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের খানা আয় ও ব্যয় জরিপমতে, দারিদ্র্য কমলেও, বৈষম্য বেড়েছে। গ্রামে এখন দারিদ্র্যের হার সাড়ে ২০ শতাংশ, শহরে এই হার ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। যেখানে সব কটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা  করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্য বৃদ্ধির তথ্য দিয়েছে, সেখানে বিবিএস দারিদ্র্য কমিয়েছে। ফলে বিবিএসের এসব পরিসংখ্যানের ওপর কোনো ভরসা করা যায় না। কারণ, বিবিএসের তথ্যের গুণমান আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নযুক্ত। দারিদ্র্যের হার নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সরকারি হিসাবেই দেখা যায়, তিন থেকে চার কোটি মানুষ দরিদ্র। দুই কোটি লোক অতি দরিদ্র, যা নেপাল ও শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার সমান। এই দরিদ্র অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চীনের আদলে মহা কর্মযজ্ঞ প্রয়োজন।

বর্তমান উচ্চ জ্বালানি মূল্য, চরম মূল্যস্ফীতি এবং ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস বিশালসংখ্যক মানুষের দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসার নতুন অনুষঙ্গ তৈরি করেছে, তারা সরকারি পরিসংখ্যানে দরিদ্র না হয়েও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে আছেন। ঝুঁকিপূর্ণ অদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া দরকার।

পেনশন, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদ, কুটির শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণের জন্য কৃষি ভর্তুকি ও সুদের ভর্তুকি যোগ করে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট জিডিপির আড়াই শতাংশ দেখায়। বাস্তবে, জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ দরিদ্রদের জন্য ব্যয় হচ্ছে এবং জিডিপি তথ্য বর্ধিত বলে এই হার প্রকৃত হিসাবে আরও কম। দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের ব্যয় জিডিপির অনুপাতে একেবারেই অপ্রতুল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বাজেট মানুষের ভবিষ্যৎ আয় তৈরির অনুকূল বিনিয়োগ নয়।

বাংলাদেশে বার্ষিক রাজস্ব আয়ের মাত্র দশমিক ৫ শতাংশের কম আসে সম্পদ কর থেকে। অর্থাৎ এখানে কর কাঠামো ধনীকে কর দিতে বাধ্য করে না। বরং শুল্ক ও  ভ্যাটের মাধ্যমে ধনী-গরিব সবার কাছ থেকে একই হারে কর আদায় হয়। ধনীদের অধিকারে থাকা সম্পদের ওপর কর প্রযুক্ত হচ্ছে না বলে একদিকে করব্যবস্থা দারিদ্র্য তৈরি করে, অন্যদিকে দারিদ্র্য বিমোচনের বরাদ্দ কম থাকে। এতে বৈষম্য উত্তরোত্তর বাড়ছে। দেশের বর্তমান জিনি সহগ প্রায় শূন্য দশমিক ৫, এটা প্রকট বৈষম্য নির্দেশ করে, যেখানে অর্ধেক মানুষ গরিব বা প্রায় গরিব। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে, পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে গরিবের পাতে আমিষের অভাব রয়েছে।

ছোট্ট রিফাত নির্মম সত্যটাই বলেছে। বৈষম্যের দেশে শুধু তো রিফাত নয়, বেশির ভাগ মানুষের পাতেই ইলিশ, গরু, মাংসসহ প্রোটিন জোটে না। জাতীয় মাছ তো সেটাই, যেটা সহজলভ্য ও আমজনতার প্রোটিনের উৎস। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, এই পাঙাশ মাছও কিন্তু এখন গরিবের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

নতুন দারিদ্র্যকে মোকাবিলায় আমাদের দরকার নতুন কৌশল। আমাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নীতিনির্ধারকেরা দারিদ্র্য তৈরির ‘নতুন অনুষঙ্গ’, জলবায়ু–দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যদারিদ্র্য, শিক্ষাদারিদ্র্য, জ্বালানিদারিদ্র্য এবং চক্রাকার দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র বোঝেন না বলেই প্রতীয়মান। তাঁরা ক্রমাগত ধনীবান্ধব কর ও শুল্কনীতির মাধ্যমে, বেদরকারি ভর্তুকি ও শুল্কায়ন চালু রেখে দরকারি ভর্তুকি বন্ধ করে ‘নতুন দারিদ্র্য’ তৈরি করেছেন।

অথচ দরকার একদিকে চীনা দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল থেকে শেখা, পাশাপাশি দেশে ঠিক কীভাবে নতুন দারিদ্র্য তৈরি হয়, তার গভীর জ্ঞান অনুসন্ধান করা।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য। faiz.taiyeb@gmail.com