নিজেদের জয়গান বন্ধ করে আল্লাহর ওয়াস্তে ডেঙ্গু কমান 

রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগিদের ভীড়
ছবি : প্রথম আলো

ডেঙ্গুতে ১৮৫ জনের মৃত্যু ও প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, রোগটি নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞরা আগেই কার্যকর নানা পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি মশার এই আগ্রাসন যে নিয়ন্ত্রণযোগ্য, সে কথাও সরকারের অজানা ছিল না। সমস্যা হলো মশা মারার কাজ যাঁদের, তাঁদের আত্মতুষ্টি আর ওপরমহলের আশকারা। কারণ, কাফনে মোড়া শিশু, মা-বাবার আহাজারি, যন্ত্রণায় কাতর রোগী কিংবা স্বজনদের ভোগান্তি—কোনো কিছুই তাঁদের আর স্পর্শ করছে না। তাঁরা পারস্পরিক পিঠ চুলকানোয় ব্যস্ত।

প্রাদুর্ভাব হওয়ার পর প্রথম আলো ডেঙ্গু পরিস্থিতির নিয়মিত তথ্য প্রকাশের বাইরে বেশ কিছু বিশেষ প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ ছেপেছে। যেমন ‘এডিস মশা ঠেকাতে “বিটিআই” আনছে ঢাকা উত্তর সিটি, এতে কী হবে’, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যেভাবে সফল হয়েছে কলকাতা’, ‘মশা মারতে দুই বছর আগে বিটিআই ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন গবেষকেরা’ ও ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ: কলকাতা ও সিঙ্গাপুর পারলে আমরা কেন পারি না’।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, বছর দুয়েক আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে বিটিআই প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তখনই বিটিআই প্রয়োগ করলে এখনকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি এতটা খারাপ না-ও হতে পারত। বিটিআই প্রয়োগ করতে হয় ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার উৎসস্থলে। এটি মশা, মাছি ও অন্যান্য পতঙ্গের লার্ভা মেরে ফেলে। লার্ভা ধ্বংস হওয়ার কারণে মশার সংখ্যা কমে যায়। মশার বংশবৃদ্ধি না হলে চিকুনগুনিয়া, ইয়োলো ফিভার, ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে আসে।

বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ওয়ার্ল্ড মসকুইটো প্রোগ্রামও ‘ওলবাচিয়া’ নামে একটি পদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা বলেছিল। পদ্ধতিটি যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) অনুমোদিত। ওলবাচিয়া একধরনের ব্যাকটেরিয়া, মশার ডিমে এই ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগ করলে একসময় ওলবাচিয়া মশা এডিস মশাকে প্রতিস্থাপন করে ফেলে। ওয়ার্ল্ড মসকুইটো প্রোগ্রামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিটার রায়ান ই–মেইলে প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৮ সালে তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তারপর এ দুই জায়গায় বিভিন্ন পদে লোকের পরিবর্তন ও কোভিড হয়। কথাবার্তা আর এগোয়নি। ২০২২ সালে আবারও তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ১৯৯৬ সাল থেকে বিটিআই পদ্ধতি চালু আছে। তাদের কমিটিগুলোও সক্রিয়। তারা আর আমাদের মতো ভোগে না, সমস্যাকে সমস্যা বলে স্বীকার না করে স্তুতি আর আশকারার সংস্কৃতিকেও উসকে দেয় না। ‘মেয়ের সৎকার শেষে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে’, কিংবা মৃত মায়ের পায়ের কাছে সন্তানের কান্নার ছবি দেখে যাঁদের মনে ক্ষরণ হয় না, তাঁরা নির্ঘাত প্লাস্টিক হয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁরাও কি বেঁচে আছেন? 

বিশ্বের বহু দেশ ডেঙ্গু সফলভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মোকাবিলা করেছে। কর্তৃপক্ষের তো মানুষের জান বাঁচানো আর ভোগান্তি কমানোর দিকে নজর নেই। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দেখলেই যে কেউ তা বুঝতে পারবে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) হিসাবে ২০১২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬৭১ জন, ২০২২ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪১ হাজার ৪৮১। ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে মৃত্যুর পরিসংখ্যান আছে ২০১৫ সাল থেকে। ওই বছর মারা যান ছয়জন। আর ২০২২ সালে মারা যান ২৮১ জন। এ বছর গত ২৩ জুলাই পর্যন্ত মারা গেছেন ১৮৫ জন। অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর ঝাপটা অব্যাহত থাকবে—জনস্বাস্থ্যবিদেরা আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করে রেখেছেন। আরও কত মানুষ যে স্বজনহারা হবেন, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।

 কিন্তু আপনি যদি সরকারের বয়ান শোনেন, তাহলে মনে হবে, এ জীবন বেশ চলছে, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। গত বছর এত প্রাণহানির পরও স্থানীয় সরকার বিভাগ তাদের আন্তমন্ত্রণালয় সভার কার্যবিবরণীতে লিখেছে, ‘২০১৯ সালে যখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল, তখন মাননীয় মন্ত্রী সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মিত সভা করে ও মাঠ পরিদর্শন করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফলতা অর্জন করেন।’ পরের বছরগুলোতেও নাকি মন্ত্রীর এই সফলতা অব্যাহত ছিল। তিনি ও তাঁর মন্ত্রণালয় যদি সফলই হবে, তাহলে বিফল হলো কারা?

এ বছরও তাদের সফলতার গান বন্ধ হয়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপসও গান করেছেন। মেয়র ৬ জুলাই বলেছেন, ‘ডেঙ্গু রোগ নির্মূল করা যায় না, বরং নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পৃথিবীর কোনো দেশ করতে পারেনি। কিন্তু আমরা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি।’ এ কথা বলে তিনি বিদেশে বেড়াতে চলে গেছেন। আর উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম গুটিগুটি পায়ে বিটিআই আনার চেষ্টা করছেন। এর আগে অবশ্য তিনি মশা মারা শিখতে যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসেছেন। যদিও বিটিআই নিয়ে আগেই এ দেশের বিজ্ঞানীরা কথা বলেছেন।

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালের আগস্টে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে জাতীয় নির্দেশিকা তৈরি করেছিল। ওই নির্দেশিকায় মশার উৎসস্থল ধ্বংসের কথা বলা ছিল। এ কাজে স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বে জাতীয় কমিটি ছাড়াও আরও নয়টি কমিটি এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি উদ্যোগ সম্পর্কেও বিস্তারিত বলা আছে। এর এক বছর পরই ডেঙ্গুতে সর্বাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। এ বছরও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। প্রশ্ন উঠছে, ২০২১ সালের পর সরকার আসলে কী করেছে?

এদের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য যথার্থ। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না।’

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ১৯৯৬ সাল থেকে বিটিআই পদ্ধতি চালু আছে। তাদের কমিটিগুলোও সক্রিয়। তারা আর আমাদের মতো ভোগে না, সমস্যাকে সমস্যা বলে স্বীকার না করে স্তুতি আর আশকারার সংস্কৃতিকেও উসকে দেয় না। ‘মেয়ের সৎকার শেষে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে’, কিংবা মৃত মায়ের পায়ের কাছে সন্তানের কান্নার ছবি দেখে যাঁদের মনে ক্ষরণ হয় না, তাঁরা নির্ঘাত প্লাস্টিক হয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁরাও কি বেঁচে আছেন? 

শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

ই–মেইল: sabiha.alam@prothomalo.com