আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটা সতর্কবার্তা। এই সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার মোট সাত কিস্তিতে দেওয়া হবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। আগামী ফেব্রুয়ারিতে মিলবে প্রায় আধা বিলিয়ন।
বাকিটা আধা বিলিয়নের একটু বেশি করে ছয় কিস্তিতে দেওয়া হবে। এটি এমন সময়ে ঘটল, যখন বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে, যা সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করতে পারে। মাত্র কয়েক মাস আগেই তা ছিল ৪০ বিলিয়ন, যা দিয়ে ছয় মাসের ব্যয় মেটানো যেত।
পরিমাণের বিচারে এটি শৈবালদিঘিতে একবিন্দু শিশিরের মতো। বছরে মিলবে গড়ে এক বিলিয়ন ডলারের একটু বেশি, যা আমদানি ব্যয়ের ৮০ ভাগের ১ ভাগ কিংবা রপ্তানি আয়ের ৫০ ভাগের ১ ভাগ কিংবা প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের ২৪ ভাগের ১ ভাগ। তাই পরিমাণের বিচারে এটি তবারক বা প্রসাদের সমতুল্য। কিন্তু এটিকে এভাবে দেখলে ভুল হবে।
এর মূল গুরুত্ব অর্থনৈতিক নীতিমালা ঠিক করার চাপের মধ্যে নিহিত। আইএমএফের ঋণ আসলে সরকারি নীতিপ্রণেতাদের পাঠ্যপুস্তকের অর্থনীতি শিক্ষায় ফিরিয়ে আনার এক উদ্যোগ। দীর্ঘদিন না হলেও পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে তাঁদের নীতিগুলো ভুল পথে চলছে এবং মাশুল দেওয়ার পালা শুরু হয়েছে। বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করা—সেখান থেকে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন আহরণ করা—এবং তাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে গর্ব করা একটা রাষ্ট্র হঠাৎ তাবৎ অবাজারীয় নীতিবৈচিত্র্যে আক্রান্ত হলো কেন, মূলত এ প্রশ্ন ও শঙ্কাই আইএমএফকে ঋণ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ ঋণ বড়শির টোপের মতো বাংলাদেশকে ‘ব্যাক টু ট্র্যাক’-এ আনার অব্যর্থ কৌশল।
এটি কৌশলগত ঋণ, যার আরেক নাম ‘লেভারেজ লোন’ বা চাড়ি দেওয়া ঋণ। একটা সামান্য বাঁশ ব্যবহার করে বিশাল ওজনের গাছের কাণ্ড চাড়ি দিয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সরানো হয়। চাপকলের হাতলেও এই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির নিচের গভীর স্তর থেকে পানি তুলে আনা হয়। আইএমএফের ঋণ আসলে এই বাঁশ বা চাপকলের হাতলের সমতুল্য, যা দিয়ে তাঁরা ভেতরের নীতিকাঠামো মেরামত করবেন। তাঁরা চাইছেন সুদের হার ও বিনিময় হার, যেগুলো এখন কার্যত অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্ব-উৎপাদিত তত্ত্ববলে সচিবালয়ে ঠিকঠাক করা হয়, সেগুলো যথাস্থানে অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক, যাতে তাঁরা বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে এসব ঠিক রাখতে পারেন।
তা না হলে দেশ সংকটে পড়বে। বর্তমানের ডলার-সংকট গত পাঁচ বছরের অবাজারীয় বিনিময় হারের খেসারত। এর দায় কোভিড বা পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের ওপর চাপালে হিসাবের ভুল হবে। কৃত্রিমভাবে টাকার উচ্চমান ধরে রাখার ফলে ২০১৬ থেকে চলতি হিসাবের ঘাটতি বাড়তে থাকে, যা উপেক্ষা করে হয়েছে।
আইএমএফের ধার দেওয়াকে ঋণ না বলে অর্থনীতির পাঠ্যবই পড়ার পরামর্শ বলা যেতে পারে। এ ঋণ ওদের শর্ত মানার বিমা। রাহুল আনন্দের টিম কিছুটা নিরানন্দ দিয়ে গেল নীতি গোঁয়ার্তুমির পরিমণ্ডলে। এ ঋণ পরিমাণে কম হলেও নীতিপ্রহরায় প্রবল হয়ে থাকবে আগামী চার বছর। ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে একটু কাজ করতে দিন, খেলাপি নিরসনে আন্তরিক হোন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান দুর্বলতা তথা বিশ্বখ্যাত রাজস্ব অক্ষমতা মোচনের দিকে নজর দিন। না হলে বিপদ আসতে কতক্ষণ?’—এটাই ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দলের বিদায়বেলার শেষ গান।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ঋণ যেভাবে চেয়েছি, সেভাবে পেয়েছি। মনে হলো আইএমএফ হঠাৎ ‘কল্পতরু’ হয়ে গেল—একেবার শর্তহীন ঋণ দিয়ে দিল! আইএমএফের সদস্য ১৯০টি দেশের কোনো অর্থমন্ত্রীর বচনে এমন তৃপ্তির বন্দনা শোনা যায়নি। এই সংস্থা যতটা না ঋণ দেয়, তার চেয়ে বেশি দেয় শর্তের শিকল। কারণ, তার কাজই হচ্ছে মুদ্রাব্যবস্থাকে ঠিক করা। মুদ্রা বিতরণ নয়। অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কিনস এ চিন্তা থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এটি গড়ে তুলেছিলেন। আজ পর্যন্ত এটি সেই মৌলিক লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি। এটি একটি গবেষণা ও জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। তাই এটি স্বল্পকালীন রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে ঘন ঘন নীতি বদলায় না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিনিয়োগ ও নিয়োগ বৃদ্ধির একটা সদিচ্ছা থেকে নয়-ছয়ের একটা সুদহার বেঁধে দেন। তিনি বুঝতে পারেন যে ব্যাংকগুলো জনগণের টাকা নিয়ে অত্যধিক মুনাফা করছে। অর্থনীতি ওঠে-নামে। নামার সময় পেশাদার খেলাপিরা ঋণ ফেরত দেয় না। সচিবালয় সন্তুষ্ট করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘাড় ধরে নানা সুবিধা ও দায়মুক্তি আদায় করে নেয়। এই চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যেও বিশেষত প্রাইভেট ব্যাংকগুলো গড়ে ১৫ ভাগের ওপর মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে।
কারণ, তাদের ঋণের হার থাকে ১০-এর ওপর। কিন্তু আমানত হার পারলে ৫-এর নিচে ঠেলে দেয়। ফলে এই মধ্যবর্তী ব্যবধান বা স্প্রেড ৭ থেকে ৮ ভাগে পৌঁছে যায় বলেই ব্যক্তিব্যাংকের মুনাফা এত বেশি। প্রধানমন্ত্রী এই স্প্রেড কমানোর জন্যও এটিকে ৩ থেকে ৪ ভাগের মধ্যে সীমিত রাখতে চেয়েছিলেন। একজন গভর্নরের কাজ করে দিতে হলো প্রধানমন্ত্রীকে।
আজ থেকে তিন-চার বছর আগের পরিপ্রেক্ষিতে পদক্ষেপটি যথার্থ ছিল। কারণ, তখন ৪ থেকে ৫ ভাগের মূল্যস্ফীতি কোনো সমস্যার বিষয় ছিল না। ৯ শতাংশ হারে ঋণ দিয়েও ব্যাংকগুলো ৪ ভাগের মতো প্রকৃত সুদ অর্জন করত। এখন ১০ ভাগ মূল্যস্ফীতির যুগে ৯ ভাগের ঋণহার প্রকৃত সুদহারকে ঋণাত্মক করে ফেলেছে। ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যে ধনিকশ্রেণি স্বল্প সুদে ঋণ পাচ্ছে, তাদের মওকা। খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তারা কখনোই ৯ ভাগের সুবিধা পান না। প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা এখন আর সেভাবে পূরণ হচ্ছে না।
অন্যদিকে, মুদ্রানীতির প্রথম কৌশল হিসেবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রধান ওষুধ হচ্ছে সুদের হার বাড়িয়ে আপাতত ঋণপ্রবাহ কমানো এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বিনিয়োগ দুর্বল করা। এতে বাজারে মুদ্রার জোগান কমে ও মূল্যস্ফীতি নেমে আসে। তখন আবার সুদ কমিয়ে ঋণপ্রবাহ ও বিনিয়োগ চাঙা করা যায়।
মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতির দৈত্যকে বাড়তে না দেওয়া এবং সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। অনেকটা উপোস থেকে শরীরের মেদ–মাংস কমিয়ে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে এনে তারপর ভালোমন্দ খাওয়া। তাই সরকারের আরোপিত ৯ ভাগ সুদমাত্রিক ছাদের তলায় আটকে থাকলে অর্থনীতির ক্ষতি করা হবে।
আইএমএফ সেই টুপি সরিয়ে দিতে বলেছে দুটো কারণে—১. বাজার অর্থনীতিতে ঋণটুপি পরানো স্ববিরোধী, ২. মুনাফাখোরেরা ঋণটুপির সুবিধা নেবে এবং মূল্যস্ফীতির অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেবে। শাস্তি পাবে জনগণ। এতে সরকারও অজনপ্রিয় হয়ে পড়বে। কারণ, জনগণ দুর্বল মুদ্রানীতি বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্ব-আবিষ্কৃত ‘সুদহার অস্পৃশ্য রেখে মূল্য নিয়ন্ত্রণের নবতত্ত্ব’-এর ধার ধারে না। ওরা চায় স্বস্তি। চায় না দামের আগুন।
যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ১০ ভাগে পৌঁছেছিল। স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত পাঁচ মাসে ক্রমাগত সুদহার বাড়িয়ে গেছে। কোনো কিছু তোয়াক্কা না করেই অনেকটা ‘টেইলর রুল’ অনুসরণ করেছে। মধ্যবর্তী কংগ্রেস নির্বাচন সামনে থাকায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন চাইছিলেন না উচ্চ সুদহার, যা বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি কমায়। করোনার পর কোটি কোটি ক্রেতা বাড়ি কিনতে চাইছেন। ব্যবসায়ীদেরও মরা গাঙে বান ডেকেছে। কেউ চান না উচ্চ সুদ। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তা জেরোমি পাওয়েল তাঁর শপথবাক্য রেখেছেন—তিনি দেখবেন রাষ্ট্রের স্বার্থ, কোনো দলীয় বা গোষ্ঠীর স্বার্থ নয়। তিনি স্বাধীন। খোদ প্রেসিডেন্টও তাঁকে সরাতে পারেন না।
শেষে ফেডারেল রিজার্ভের নীতি কাজ দিচ্ছে। কয়েক দিন আগের হিসাবে যে–ই না মূল্যস্ফীতি প্রায় ৭ দশমিক ৫ ভাগে নেমেছে, অমনি শেয়ারবাজারে দর উত্থানের মহোৎসব। আইএমএফ এবার বোঝাতে এসেছিল যে অর্থনীতির তত্ত্বগুলো অত ফেলনা নয়। তাই ঋণহারের টুপি আপাতত সরাতে হবে। সঞ্চয়পত্রে সুদের হার যৌক্তিক করতে হবে। তেলের দামকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে নাচানাচি করাতে হবে। বিনিময় হারকে উদ্ভট পঞ্চবিভূতি থেকে উদ্ধার করে বাজারভিত্তিক একক হারে আনতে হবে। এতে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়বে। ডলারের মজুতের দ্রুত ক্ষয় এভাবে রোধ না করলে দেশ সংকটে পড়বে।
তাই আইএমএফের ধার দেওয়াকে ঋণ না বলে অর্থনীতির পাঠ্যবই পড়ার পরামর্শ বলা যেতে পারে। এ ঋণ ওদের শর্ত মানার বিমা। রাহুল আনন্দের টিম কিছুটা নিরানন্দ দিয়ে গেল নীতি গোঁয়ার্তুমির পরিমণ্ডলে। এ ঋণ পরিমাণে কম হলেও নীতিপ্রহরায় প্রবল হয়ে থাকবে আগামী চার বছর।
‘কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে একটু কাজ করতে দিন, খেলাপি নিরসনে আন্তরিক হোন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান দুর্বলতা তথা বিশ্বখ্যাত রাজস্ব অক্ষমতা মোচনের দিকে নজর দিন। না হলে বিপদ আসতে কতক্ষণ?’—এটাই ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দলের বিদায়বেলার শেষ গান।
ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ।