শিক্ষকরাজনীতি যেভাবে শিক্ষার মানের ক্ষতি করেছে

দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কালের আবর্তে এই গৌরবময় প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিকীকরণ, স্বজনপ্রীতি, দলীয় লেজুড়বৃত্তি, দুর্বল প্রশাসন ও অব্যবস্থাপনার কারণে ক্রমেই তার সেই অর্জন ও গৌরব হারিয়ে ফেলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ মুনির খসরু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩–এর উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন ও মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটাতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু বাস্তবে এ অধ্যাদেশের কারণে যে দলীয় শিক্ষকরাজনীতির সূত্রপাত হয়, তার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিক্ষকতার মান, গবেষণা ও অন্যান্য একাডেমিক কার্যক্রমের ওপর। এ অধ্যাদেশের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রেখে একাডেমিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, যাতে মুক্তচিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তির সহায়ক একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। 

একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে অধ্যাদেশের চতুর্থ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শিক্ষক, প্রশাসক ও নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার স্বাধীনতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হয়েছিল। এর মৌলিক ভিত্তি হওয়ার কথা ছিল শিক্ষকদের পেশাগত ও মেধাগত যোগ্যতা, যাতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়। 

বাস্তবে তা না হয়ে এ অধ্যাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ করার একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপারে তাদের প্রভাব খাটিয়ে মানগত উৎকর্ষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে চলেছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যদিও রংভিত্তিক দল করেন, তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শ সবারই জানা। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নীল দল বলতে আওয়ামীপন্থী ও সাদা দল বলতে বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের বোঝায়। যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের মতাদর্শের অনুসারী শিক্ষকেরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পান, অর্থাৎ উপাচার্য, সহ–উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, হলের প্রভোস্ট ইত্যাদি হন। এখানে শিক্ষকদের পেশাগত ও মেধার যোগ্যতা খুব কমই ভূমিকা পালন করে। একজন শিক্ষক বিশ্বের যত নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা বা অসাধারণ গবেষণার কাজ করেন না কেন, কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য ছাড়া এসব পদে তাঁর আসীন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। 

■ প্রতিটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপারে তাদের প্রভাব খাটিয়ে মানগত উৎকর্ষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে চলেছে। 

■ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেখানে সবচেয়ে বড় মানদণ্ড হওয়ার কথা ছিল শিক্ষাগত যোগ্যতা, মেধা ও মনন, সেখানে তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সম্পৃক্ততার ওপর। 

■ শিক্ষার মানের অবনতি রোধ ও হৃত গৌরব উদ্ধার করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ৭৩ সংশোধন ও সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি। 

শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের মনোবল ও বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং

শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেখানে সবচেয়ে বড় মানদণ্ড হওয়ার কথা ছিল শিক্ষাগত যোগ্যতা, মেধা ও মনন, সেখানে তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সম্পৃক্ততার ওপর। যেমন ২০০৯-১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯০০ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এ ধরনের প্রচলিত মানদণ্ডের নিরিখে। এতে এই সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যতগুলো নির্বাচনভিত্তিক পদ আছে, যেমন অনুষদের ডিন, শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধি—সব কটিই মোটামুটি আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় একই ধরনের ধারাবাহিকতা ছিল, যা গত ১৫ বছর আওয়ামী শাসনামলে প্রকট আকার ধারণ করে। 

এসব কারণে কোনো পদোন্নতি বা প্রশাসনিক পদে নিয়োগ পেতে হলে অনেকটা বাধ্য হয়েই অনেক শিক্ষককে রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত হতে হয়। এ ধরনের অসুস্থ পরিবেশ শিক্ষার মানগত উৎকর্ষ ও পেশাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে একধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির অভাবে নিরপেক্ষ শিক্ষকেরা প্রায়ই কোণঠাসা হয়ে পড়েন, যা থেকে ছাত্রসমাজও মুক্ত নয়। ক্লাস না নেওয়া, গবেষণাকে গুরুত্ব না দেওয়া—এসবের কারণে শিক্ষার্থীরা একটি নিম্নমুখী ও ক্ষয়িষ্ণু শিক্ষার পরিবেশের শিকার হচ্ছেন। 

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শিক্ষকরাজনীতির অন্যতম ভুক্তভোগী হলেন অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় মেধাবী শিক্ষার্থীরা, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। প্রায়ই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট শিক্ষকদের আস্থা অর্জন না করতে পারলে তাঁদের শিক্ষক হওয়ার আশা সুদূরপরাহত হয়ে যেতে পারে। এমনকি এ ধরনেরও অভিযোগ আছে যে কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলকেও আগে থেকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে তাঁদের শিক্ষক হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে রাখা হয়। 

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের নীতিগত ও আদর্শিক ভিত্তি যদি এতই দুর্বল হয়, তাহলে এখানকার শিক্ষার্থীরা কীভাবে তাঁদের শিক্ষকদের ওপর আস্থা ও শ্রদ্ধা রাখবেন? যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এমন সব শিক্ষকের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে উঠেছেন, তাঁদের কাছ থেকে জাতি কী আশা করতে পারে? বিশেষত যেখানে শিক্ষকসমাজের একটা বড় অংশ শিক্ষকের চেয়ে বেশি রাজনীতিবিদদের মতো আচরণ করেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা যথার্থই মন্তব্য করছেন, ‘আমি জানি না, কেন সব শিক্ষকই শুধু উপাচার্য হতে চান।’ 

এই একই অধ্যাদেশের কারণে নতুন নতুন বিভাগ খোলায় বাস্তবে নতুন শিক্ষক নেওয়ার ছত্রচ্ছায়ায় নতুন ভোটার নেওয়াটা অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমিত সম্পদের অপচয় ও শিক্ষকতার মানের অবনতি হচ্ছে। এটা সহজবোধ্য, কেন গত ১৫ বছরে নির্বাচনভিত্তিক সব প্রশাসনিক পদে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। 

বাংলাদেশের একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত বেশির ভাগ গবেষণামূলক প্রবন্ধের মানগত উৎকর্ষ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। একটি রিপোর্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯০ শতাংশের বেশি প্রকাশনাকে ‘ট্রাস জার্নাল’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ১৭টি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঞ্চালক হওয়ার পরিবর্তে এসব জার্নাল মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতির জন্য নিম্নমানের প্রকাশনার একটি মাধ্যমমাত্র।

প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ ও মানগত উন্নয়ন—দুটিতেই পিছিয়ে পড়ছে। কিউএস ওয়ার্ল্ড ইন্টারভার্সিটি র‌্যাঙ্কিংস অনুযায়ী বিশ্বের প্রথম সারির ১ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভারতের আছে ৩১টি, পাকিস্তানের ১০টি আর বাংলাদেশের মাত্র ৩টি। প্রথম ৫০০টির সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের অবস্থা আরও করুণ। এখানে ভারতের আছে ১১টি, পাকিস্তানের ২টি; বাংলাদেশের একটিও নেই। 

একইভাবে টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাঙ্কিংয়ের প্রথম ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভারতের আছে ২২টি, পাকিস্তানের ৯টি; বাংলাদেশের একটিও নেই। বৈশ্বিক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে আছে দুর্বল ও নিম্নমানের গবেষণা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব ও বিদেশি শিক্ষকদের অনুপস্থিতি। যেমন ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের মাত্র ২ দশমিক ১২ শতাংশ গবেষণাকাজে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ধরনের অপ্রতুল অর্থায়নে উচ্চ মানের গবেষণা আশা করা একটি অবাস্তব চিন্তা। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। 

উচ্চশিক্ষার ক্রমাগত অবনতির কারণে বাংলাদেশের সামর্থ্যবান ও মেধাবী বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছাড়ছেন, যার সংখ্যা ২০২৩ সালে ৫০ হাজারের বেশি। একই কারণে বাংলাদেশে আসা বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমছে, যা ২০২০ সালে ২ হাজার ৩১৭ থেকে কমে ২০২২ সালে ১ হাজার ৯৫৭-তে দাঁড়িয়েছে; যার মধ্যে কেবল ২৯ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। 

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি এতই অনিয়ম ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা হয়, তাহলে আমি কেমনভাবে এসবের ঊর্ধ্বে থেকে এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সিনিয়র প্রফেসর হলাম। অতএব এ প্রশ্নের উত্তর না দিলে লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই কোনো ব্যক্তিগত আঙ্গিকে বা স্বার্থে নয়, বরং বাস্তবতার নিরিখে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করছি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পরীক্ষার শেষ দিন, পরীক্ষার হলে আমার বিভাগের এক সিনিয়র শিক্ষক পরীক্ষার পরে তাঁর কক্ষে দেখা করতে বলেন। পরীক্ষা শেষে ওনার কক্ষে গেলে আমি আমার বিভাগের আরও কিছু শিক্ষককে সেখানে দেখতে পাই। পরীক্ষায় ভালো ফলের কারণে আমার শিক্ষক হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। সে জন্য তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই শিক্ষকেরা আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাকে সেখানে ডেকে নিয়েছিলেন। 

সৌভাগ্যক্রমে সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় বিতর্ক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দলনেতা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমার একটা পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল। এ ছাড়া একজন সৎ ও কর্মদক্ষ সচিব হিসেবে সরকারি মহলে আমার প্রয়াত বাবার সুনাম ছিল, সম্ভবত এসব কারণে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির ঊর্ধ্বে থেকে আমি প্রভাষক (লেকচারার) হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের সুযোগ পাই। 

আবার যখন আমার অধ্যাপক হওয়ার সময় আসে, তখন সৌভাগ্যক্রমে এমন তিনজন সৎ, যোগ্য ও সম্মানিত ব্যক্তি ওই নিবার্চন কমিটির সদস্য ছিলেন, যাতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন ছিল। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, যিনি বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা। অন্য দুজনের মধ্যে মরহুম অধ্যাপক হাফিজ জি এ সিদ্দিকী ও মরহুম অধ্যাপক বজলুল মবিন চৌধুরী যথাক্রমে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ছিলেন। 

এ কথাও সত্য, অনাকাঙ্ক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে কলুষিত পরিবেশের মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ভালো শিক্ষক আছেন, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সৎ ও নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমার এই লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, যাতে এ ধরনের শিক্ষকেরা, যাঁরা সত্যিকার অর্থে শিক্ষকতার মহান পেশার ব্রত পালন করে যাচ্ছেন, তাঁরা যেন রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত বা অপদস্থ না হন, সে ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া। 

সময়ের দাবি, অর্থপূর্ণ পরিবর্তন ও সংস্কার

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হওয়া উচিত বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংস্কার আনা, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সব ধরনের নিয়োগ ও পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে থেকে শুধু মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়।

উপাচার্য, সহ–উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, ডিন, চেয়ারম্যান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিয়োগের জন্য দরকার হলে সৎ ও দক্ষ গুণীজনদের নিয়ে সার্চ কমিটি করা যেতে পারে, যেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ বা ক্ষমতার অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকবে না। অন্যথায় উচ্চশিক্ষার যে একটা মানগত ধস নেমেছে, তা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই এবং সারা বিশ্ব যেখানে তরতর করে ওপরে উঠে যাচ্ছে, সেখানে আমরা ক্রমাগতভাবেই একটা নিম্নমুখী অন্ধকার অতল গহ্বরের দিকে উচ্চশিক্ষা খাতকে দায়িত্বহীনভাবে ঠেলে দিচ্ছি। এ অবস্থা থেকে আশু উত্তরণ না হলে কোনো সংস্কার করে আশাপ্রদ ফল পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। 

সত্যি কথা বলতে, আমার মতে, শিক্ষকরাজনীতি ছাত্ররাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকারক ও আত্মঘাতী, যার ফলশ্রুতিতে অনেক প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা রাজনৈতিক কারণে অনৈতিক ও অন্যায় আচরণের শিকার হতে থাকবেন এবং শিক্ষকসমাজের মর্যাদাও ক্রমেই বিলীন হতে থাকবে। এ অবস্থা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং আমরা জাতি হিসেবে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মেরে চলেছি। এখনই সময় আমাদের উচ্চশিক্ষার খাতকে শোধরানোর। অন্যথায় কিছুদিন পর হয়তো দেখা যাবে, বিশ্বের প্রথম এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশর একটিও নেই। 

শিক্ষার মানের অবনতি রোধ ও হৃত গৌরব উদ্ধার করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ৭৩ সংশোধন ও সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে শিক্ষার পরিবেশকে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত করে শুধু মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চার একটি উৎকর্ষসাধন কেন্দ্রে পরিণত করা যায়। বর্তমানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ই গুরুত্বপূর্ণ এ কাজ শুরু করা উচিত। 

এ ব্যাপারে ৭ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যানের শতবর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেন, ছাত্র-শিক্ষক সম্প্রদায় তাদের মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন বুদ্ধিমত্তার চর্চা ফিরে পেয়েছে। তিনি ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রতিদিনের অধ্যয়ন ও গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞান অগ্রগতিতে অবদান রাখার এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা বজায় রাখার আহ্বান জানান। আমরা আশা করি, সংস্কারধর্মী এই সরকার জাতির এ গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যাপারে যথাযথ ও সময়মতো পদক্ষেপ নেবে। 

এখানে উল্লেখ্য, এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও শিক্ষা উপদেষ্টা উভয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র এবং পরবর্তী সময়ে দুজনই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। অতএব এ ব্যাপারে নজর ও যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া তাঁদের দুজনেরই নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি। উল্লেখ্য, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ মোট ২১ উপদেষ্টার মধ্যে অর্ধেকের বেশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। অতএব এ ব্যাপারে এই উপদেষ্টা পরিষদ যদি সক্রিয় না হয়, তাহলে দায়িত্বশীল আর কারা এ ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন? 

অধ্যাপক সৈয়দ মুনির খসরু আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আইপিএজির চেয়ারম্যান