২৩ অক্টোবর ২০২২। সকাল সাড়ে ৯টা। রবিবার, হাটবার। দূর-দূরান্ত থেকে শত শত নৌকায় কেনাবেচার জন্য আসছেন হাঁটুরেরা। বসে কয়েক বর্গ কিলোমিটারব্যাপী হাট। লোকে লোকারণ্য। দেখার মতো দৃশ্য। চিলমারীর হাট বলে বিখ্যাত এই হাটে হাটের দিন ১৪০-১৬০ টাকায় রসগোল্লা পাওয়া যায়। বিরল সব ফসল আর কৃষিপণ্যে ভরপুর। কবুতর থেকে শুরু করে মহিষ, মরিচের চারা থেকে বটের চারা। তিল-তিসি থেকে শুরু করে ভুট্টা পর্যন্ত। রুমাল থেকে শুরু করে খাট-পালঙ্ক। মোড়ে মোড়ে হকার আর হকার।
যাব শাখাহাতি চরে। মোনাজাত উদ্দিনের ‘চিলমারীর একযুগ’-এর শাখাহাতী চরে। খেয়াভাড়া ৪০ টাকা। শ খানেক যাত্রী পারাপারে সক্ষম বড় নৌকা। আসা-যাওয়ায় বড়জোর লাগে দেড় লিটার ডিজেল। ইজারাদারি না থাকলে জনপ্রতি ভাড়া পড়ত দেড় টাকা। লাভের গুড় খায় ইজারাদার আর ইউনিয়ন পরিষদ। ১৫/২০ মিনিট নৌকা চলার পর আমাদের নামিয়ে দিল শাখাহাতী চরে। শাখাহাতী, বৈলমন্দিয়ার খাতা, মনতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরাও এসেছেন। শিক্ষকদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় পাশ। ঢাকা, জগন্নাথ, বেগম রোকেয়া ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের।
চরে নামতেই শ খানেক লোক পাটকাঠি (সিনটা), ধনচে, পাট, মুরগি, হাঁস, মাথায় করে হুড়োহুড়ি করে নৌকায় উঠছে। হাটের দিন এক ঘণ্টা পরপর নৌকা। হাটের দিন চরগুলোয় উৎসব নামে। সারা সপ্তাহের সদাই কেনা হয়। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করা হয়। কিশোরেরা বাপের সঙ্গে হাটে যায়। কিশোরীরা বাপের অপেক্ষায় থাকে।
মাস ছয়েক হলো চরে বিদ্যুৎ এসেছে। চর ভাঙছে। ইলিশ ধরা নিষিদ্ধের মেয়াদ তখন। ব্রহ্মপুত্রে পানিও বেড়েছে। কাছার থেকে ফুট তিনেক নিচে পানি। দুই পাশে নানান ফসলের খেত। কালাই, বাদাম, ধান। অযত্নে বেড়ে ওঠা বরইগাছগুলোয় মুকুল এসেছে। চরের ছেলেমেয়েদের কুড়িয়ে পাওয়া ভিটামিন। বিদ্যুতের রাস্তার লাইন ধরে গেছে। ফলে রাস্তার পাশের গাছগুলোর মাথাকাটা।
যাওয়ার পথে চরশাখাহাতী স্কুলের সামনে দেখা হলো মিনারা বেগমের (৩৫) সঙ্গে। তিন সন্তান তাঁর। নদীর ও পাড়ে রমনায় মাদ্রাসায় পড়ুয়া সন্তানের জন্য দুধ কিনে আনছিলেন। তাঁর স্বামী জেলে, অন্য সময় ইটের ভাটায় কাজ করেন। একজনকে রমনায় নানির বাড়িতে রেখে হেফজে পড়ান। সেখানে বেতন দেন ৫০০ টাকা।
আরেক ছেলে স্থানীয় মাদ্রাসায়, তাকে ৫০০ টাকা বেতনে পড়াচ্ছেন। সবচেয়ে ছোটটির বয়স চার বছর। তিনি জানান, ‘আগে এহনা দাম কম আছিল, তাতে এহনা খরচ করছিলাম। আর কাপড়চোপড় করি কেমন করি, ছাওয়াপোয়াক পড়ালেখা করা নাগে, কামাই কম হয়।’
মহিষের পাল নিয়ে মাঠে যাচ্ছিলেন সুজন মিয়া। বলেন, সারের দাম, তেলের দাম বাড়ায় মাঠে-ঘাটে ফসল নাই, গরু-মহিষের খাবার মিলছে না। দুধও কম কিনছে মানুষ।দুপুরের রোদে একই জায়গায় ঘরের কাজ করছিলেন জাহের হোসেন। তিনি কেমন আছেন, জানতে চাইতেই বলেন, ‘খুব কষ্ট হইতেছে। কামাইটামাই নাই। মনে করেন সারের দাম বেশি, খাদ্যের দাম বেশি।
তেল কিনবের গেইলে যে ৫০০ টাকাত কামলা দেই, ৫০০ টাকা আমার হয়ই না। মনে করেন লাগে দিন দুই হাজার টাকা, তবে সংসারটা চলে। আমার সংসারে খুব টান বাজি গেইছে। মনে করেন ডিজেল আগে ছিল ৮০ টাকা, এখন হৈছে ১২০ টাকা আর তারপরে হৈল সয়াবিন তেল। আগে কিনছিলাম হামরা ৮০ টাকা লিটার, এলা কত নেয় তোমরায় জানেন।’
জাহের হোসেন বলে যান, ‘হামার ব্যবসায় হৈলো কৃষি। কৃষিকাজ করি। আট শ টাকার সার এখন বারো শ টাকা। সউগ (সব) সারের দাম বাইড়ছে। খুব কষ্টে আছি। ঋণ নিয়ে, গরু বেচে চলছি। আগে ছিল জমা, এহন ঋণ করি চলছি। জমি ১০ বিঘার জায়গাত ২ বিঘা আবাদ করছি। কামলা নিবারে পাই না। কাইও কাইও (কেউ কেউ) এবার ভুট্টার দাম ভাল পায়া সউগ জমিত ধান থুইয়ে ভুট্টা আবাদ কইরছে। শুনছি, দেশত দুর্ভিক্ষ আইসপে, এদিকে তো সগাই ভুট্টা নাগাছি। কী যে হৈবে!’
ফেরার পথে শাখাহাতি চরের ঘাটে বসে আছি। লোকজন হাট থেকে ফিরছে। এগারো শ টাকার চাল সাড়ে তেরো শ টাকায় কিনেছেন। দুই সেরের জায়গায় এক সের কিনে খাচ্ছেন। এমনটা জানালেন হাটফেরতা মহসীন (৭০) ও সুজা (৬০) নামের দুই প্রবীণ।
রুহুক আমিন (৬০), মনজু মিয়া (৫৫) ও আনারুল ইসলাম (৩৫)। বেলা একটা। কয়েকটা বরইগাছের ছায়ায় ৫০/৬০ হাটুরের তিনজন। ঘণ্টাখানেক ধরে খেয়ার অপেক্ষায়।
গত মৌসুমে এনারা কেউ ১০ কাটা, কেউ ২০ কাঠা ভুট্টা করেছিলেন। এবার পাঁচ/ছয় কাঠা করে আবাদ বাড়াবেন। চরের উর্বর জমিতে ভালো ফলন পেয়েছেন। উল্লেখ করার ব্যাপার, কাইম এলাকায় ৬০ শতক মানে স্থানীয় বাহারবন্দ পরগনা হিসেবে ১ বিঘা। মূল ভূখণ্ডে যেখানে হয় ৪০ মণ ভুট্টা, সেখানে চরে হয় ৯০ মণ। এ কারণে ধানসহ অন্যান্য আবাদ কমেছে। বাচ্চার লেখাপড়া নিয়ে সমস্যায় আছেন মনজু মিয়া।
আনারুল ইসলাম জানান, ‘সেই সার আনা লাগিল নাজিম খা (পাশের রাজারহাট উপজেলা) থাকি। তেরো শ টাকা খরচ পড়ি গেল। যাইতে-আসতে লাগে ৯০ টাকা। ইদানীং বাজারে আছে কি না, জানি না। গাইবান্ধা থাকি একবার আনি ভুট্টাত লাগাছি। চিলমারীত সার কিনিয়াও হাটত খাজনা দেও, ঘাটত খাজনা দেও। জীবনেও হাটের দিন ঘাটের খাজনা দেই নাই, এলা মন্ত্রীর লোকরা ইজারা নিয়া ঘাটের খাজনা চালু করছে।’
রুহুল আমিন বলেন, ‘চার/পাঁচ বছর আগে বড় বন্যার সময় এখানে আসি বাস করতেছি। একজনের কাছ থাকি জমি বন্ধক নিছিলাম, তাই (তিনি) টাকা ঘুরি(ফেরত) দিছে। এহন একটু সমস্যাত আছি। এক বিঘা জমি আদি আমন করছিলাম, তার অর্ধেক পানির তলোত চলি গেইছে। ৮/১০ কাঠা আছে। সার দিবের পাইনে। খরচ বেশি, ইনকাম কম। খাওয়া পরা, চলাফিরা খুব কষ্ট। কামও চলে না।’
আবদুস সালাম (৪২) চিলমারীর অষ্টমীরচরের চর নটারকান্দির বাসিন্দা। স্থানীয় হাইস্কুলের অফিস সহকারী। তিনি জানান, ‘দুইটা গরু আছে, তাই লবণ বেশি লাগে। মাসে ১০ কেজি লাগে। পাঁচ/ছয় মাস আগে দাম ছিল কেজি ১৪ টাকা, গত হাটে কিনলাম ২২ টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ার আগে ট্রাক্টরওলা বিঘা নিত ৬০০, এবার ৯০০।
ইরির জমির জন্য ঘণ্টা নিত শ্যালোওলা ১২০ টাকা, এখন নিচ্ছে ২৫০ টাকা। তেলাপিয়া, মৃগেল কিনছি কেজি ১২০ টাকা, এখন ২০০ টাকা। ইরি আগে করেছি ৩ বিঘা, এবার ২ বিঘা। ঘরের ভাত এবার হবে না।’
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
nahidknowledge1@gmail.com