সিন্ডিকেট ভিমরুলের চাক, কেউ খোঁচা দিতে চায় না

সিন্ডিকেট একটি মারাত্মক বস্তু। এই জিনিস নিরাকার; কিন্তু বেজায় শক্ত। সবাই মুখে বলে ‘ভাঙব’, কিন্তু আদতে কেউ তা ভাঙে না। ভাঙতে পারে না। কারণ সিন্ডিকেট হলো রুল না মানা ভিমরুলের চাক টাইপের একটি সমবায়ী কনসেপ্ট। এই জিনিসে কেউ খোঁচা মারতে চান না।

তারপরও গত ২৯ আগস্ট মঙ্গলবার অগ্রজ সাংবাদিক ও দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে ভিমরুলের চাকে ছোটখাটো একটা ঢিল ছুড়েছেন।

ওই দিন তিনি প্রশ্নোত্তর পর্বে ডিম, মরিচ, পেঁয়াজসহ জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর পেছনে সিন্ডিকেট কাজ করে বলে অনেকটা নালিশ করার মতো করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাচ্ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে সাইফুল আলম বলেন, ‘দুজন মন্ত্রী বলেছেন, সিন্ডিকেট আছে। সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না।’

প্রধানমন্ত্রী: কে বলেছে?
সাইফুল আলম: বাণিজ্যমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী: বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন! আমি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরব তো!
সাইফুল আলম: তিনি (বাণিজ্যমন্ত্রী) বলেছেন, সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না।
প্রধানমন্ত্রী: ঠিক আছে, আমি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরতেছি। ওখানে হাত দেওয়া যাবে না, কে বলেছে?
সাইফুল আলম: বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী: ঠিক আছে। আমি তাহলে দেখব।

এরপর প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের খাদ্যপণ্য নিয়ে কয়েকটা হাউস আছে, তারা ব্যবসা করে। তো যখনই তারা আর্টিফিশিয়ালি দাম বাড়ায়, তখন আমরা তো সাথে সাথে...সেটা আমদানি করি বা বিকল্প ব্যবস্থা এমনভাবে করি যাতে তারা বাধ্য হয় দাম কমাতে। সাথে সাথে ব্যবস্থা তো নিই। কাজেই সিন্ডিকেট থাকলে সিন্ডিকেট যে ভাঙা যাবে না, এটা তো কোনো কথা না! কে কত বড় শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে, আমি জানি না। কিন্তু ঠিক আছে, আমি দেখব।’

খোদ প্রধানমন্ত্রী যে মুহূর্তে বললেন, ‘আমি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরব তো!’ কথাটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনে হয়েছে, এবার সম্ভবত সিন্ডিকেট একটু হলেও চাপে পড়বে। মনে হয়েছে, এবার সম্ভবত সিন্ডিকেটে কেন হাত দেওয়া যাবে না, তা বাণিজ্যমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খুলে বলতেই হবে।

অবশ্য বাণিজ্যমন্ত্রী এ নিয়ে তাঁর পজিশন অনেক আগেই পরিষ্কার করে রেখেছেন।

ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে গিয়ে শের-এ-মহীশূর টিপু সুলতানকে জান দিতে হয়েছিল। আমাদের সিন্ডিকেট বাহিনী যে সেই ব্রিটিশ বেনিয়া বাহিনীর চেয়ে কম না, তা সম্ভবত টিপু মুনশি জানেন। সম্ভবত সে কারণেই তাদের তিনি ঘাঁটানোর পক্ষে নন।

ডিমের ডজন ১৮০ টাকায় ওঠার জের ধরে দেশজুড়ে হাউকাউ শুরুর পর গত ১১ আগস্ট ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক ছায়া সংসদে গিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এভাবে দাম বাড়ানোর কাজ যে সিন্ডিকেট করে, তা তাঁরা জানেন; কিন্তু পাবলিকের কষ্ট বাড়াতে চান না বলেই তাঁরা সিন্ডিকেটে হাত দেন না। তিনি বলেছিলেন, ‘ধরুন আমরা সিন্ডিকেট বন্ধ করে দিলাম, তারা (সিন্ডিকেট চক্র) বাজারে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিল। তখন ভোক্তারা পণ্য পেল না। এ জন্য আমাদের সবদিকে খেয়াল রাখতে হয়।’

আমরা সবাই মোটামুটি জানি, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এক জোট হয়ে আইন ভেঙে মাল মজুত করে; কখন কতটুকু পণ্য বাজারে ছাড়তে হবে, আড়তে কত টাকা দাম ধরতে হবে, খুচরায় কত বেচতে হবে, সব তারাই ঠিক করে। এটি ঘোর অন্যায়।
যেভাবে পুলিশ ও প্রশাসন আর পাঁচটা অপরাধ মোকাবিলা করে, এই ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটার কথা ছিল না। কিন্তু ব্যত্যয় ঘটছে।

আমাদের খাদ্যপণ্য নিয়ে ব্যবসা করা যে ‘কয়েকটা হাউস’ আইন ভাঙে ও ‘আর্টিফিশিয়ালি দাম বাড়ায়’, তাদের যেখানে শ্রীঘরে থাকার কথা; সেখানে তাদের ভিআইপি মর্যাদা দিয়ে বৈঠকের কক্ষে ডাকার কী কারণ এবং তাতে কাজের কাজ কতটুকু হয় বা হয়েছে, সে এক বিরাট প্রশ্ন।

সরকার নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য মজুত করলে দেশের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের বিধান আছে। আজ পর্যন্ত মজুতদারির জন্য কোনো ব্যবসায়ীকে এই সাজা দেওয়া হয়েছে বলে কেউ কখনো শুনেছে বলে মনে পড়ছে না। বরং সিন্ডিকেটের শয়তানি বন্ধ না করে বিকল্প হিসেবে আমরা সেই পণ্য ‘আমদানি করি বা বিকল্প ব্যবস্থা এমনভাবে করি যাতে তারা বাধ্য হয় দাম কমাতে।’

গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী ‘আমি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরব তো!’ বললেও, তার পরের দিন বুধবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘ইউএস-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার পর প্রায় দেড় ঘণ্টা তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে ছিলাম। তখন তিনি এ বিষয়ে কিছু বলেননি।’

যে সিন্ডিকেট এক কেজি কাঁচা মরিচের দাম পাঁচ শ টাকা, একটি ডাবের দাম দেড় শ টাকা, এক ডজন ডিমের দাম ১৭০ টাকা বানিয়ে ফেলে, সেই সিন্ডিকেটকে কান ধরে ওঠবস না করিয়ে ভোক্তাকে কম দামের সময় কাঁচা মরিচ শুকিয়ে রেখেডিম সিদ্ধ করে ফ্রিজে সংরক্ষণের পরামর্শ দেওয়াটা যে কারও কাছে হালকা আলাপ বলে মনে হতে পারে। এতে সিন্ডিকেটের মতো বেআইনি ও অপরাধমূলক একটি সাংগঠনিক অস্তিত্বকে এক ধরনের পরোক্ষ বৈধতা দেওয়া হয়। এতে সিন্ডিকেটকে ‘ধরা’ সম্ভব হয় না।

শেষ কথা:
গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী ‘আমি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরব তো!’ বললেও, তার পরের দিন বুধবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘ইউএস-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার পর প্রায় দুই ঘণ্টা তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে ছিলাম। তখন তিনি এ বিষয়ে কিছু বলেননি।’

আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্যমন্ত্রীকে ‘ধরার’ আগেই বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটকে ধরুন। কারণ প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেনই ‘সিন্ডিকেট থাকলে সিন্ডিকেট যে ভাঙা যাবে না, এটা তো কোনো কথা না! ’

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    sarfuddin2003@gmail.com