বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মো. নূরুল হুদা সংবাদ সম্মেলন করেন
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মো. নূরুল হুদা সংবাদ সম্মেলন করেন

মতামত

একজন নুরুল হুদাকে স্বর্ণপদক ফিরিয়ে দিতে হয় কেন

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মো. নুরুল হুদা বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দেওয়া প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক ফিরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

অসামান্য একাডেমিক কৃতিত্বের জন্য তিনি এই স্বর্ণপদক দুটি পেয়েছিলেন। ১৩ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে স্বর্ণপদক ফিরিয়ে দেওয়ার কথা তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন।

মো. নুরুল হুদা বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেন, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে অভিযোগ দাখিলের পরও তিনি আশানুরূপ প্রতিকার পাননি।

তাই অনিয়মের প্রতিবাদে তাঁর অর্জিত পুরস্কারগুলো প্রত্যাখ্যান করছেন। একজন শিক্ষক হিসেবে এই পদক প্রত্যাখ্যানের অভিনব প্রতিবাদের জন্য নুরুল হুদাকে অভিনন্দন জানাই। ছোট পরিসরে হলেও এভাবেই শুরু হোক প্রতিবাদ।

অতীতেও নানা সময় পদক বা পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে প্রতিবাদ দেখেছি। সেসব পুরস্কার প্রত্যাখ্যান সাধারণত রাষ্ট্র কিংবা প্রতিষ্ঠানের অনাচার, নিপীড়ন, অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে অনিয়মের প্রতিবাদে এমন পদক প্রত্যাখ্যান বিরল।

সম্ভবত নুরুল হুদাই প্রথম শুরু করলেন। পুরস্কার ফেরালেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে কিংবা অনেক কিছু অর্জিত হবে, সেটা হয়তো নয়। তবে এর মাধ্যমে বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির একটি স্বরূপ জাতির সামনে উন্মোচিত করেছে, যা শিক্ষাব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও সততা ফিরিয়ে আনতে অবদান রাখতে পারে।

জাতি হিসেবে আমরা এক এবড়োখেবড়ো পথে চলেছি, যেখানে পথের বাঁকে বাঁকে অপরাজনীতি ও দুর্নীতি নামের ধেড়ে ইঁদুরের গর্ত। সেই গর্ত দিয়ে চুঁইয়ে যাচ্ছে আমাদের নীতি, আদর্শ, শিক্ষা ও সততা।

বয়ে যাচ্ছে আমাদের অর্থ সম্পদ, আমাদের ঐশ্বর্য। ক্ষয়ে যাচ্ছে আমাদের মেধা, মনুষ্যত্ব, মানবিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার।

আমাদের সবুজ ঘাস, লতাপাতা বিবর্ণ হয়ে পড়ছে, আমাদের লাল ফুলটি ম্লান হয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। এ রকম একটি গর্তে আটকে যাচ্ছে আমাদের নুরুল হুদার মতো মেধাবী সন্তানেরা। গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তাঁদের স্বপ্ন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির প্রতিবাদ হিসেবে একজন সেরা শিক্ষার্থীর পদক ফিরিয়ে দেওয়া প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু এটি একটি শক্তিশালী, সাহসী ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।

কারণ, এই দুর্নীতি শিক্ষার গুণগত মানকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থায় ফাটল ধরাতে পারে। এর প্রভাব জাতির জন্য সুদূরপ্রসারী।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নুরুল হুদার পদক ফিরিয়ে দেওয়ার এই প্রতীকী প্রতিবাদের মাধ্যমে অসংখ্য মেধাবী বঞ্চিত শিক্ষার্থীর দৃঢ় অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির ফলে সত্যিকার মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষার্থী বঞ্চিত হচ্ছে।

নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্য এবং পক্ষপাতিত্ব প্রার্থীর মেধা, যোগ্যতা ও একাডেমিক সততাকে গৌণ করে দিচ্ছে। নুরুল হুদার বিষয়টি পর্যালোচনা করলে তাঁর সব কটি দৃষ্টান্ত মেলে। তিনি জানিয়েছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বিভাগের নিয়োগে কম যোগ্যতাসম্পন্ন তিনজন প্রার্থী নিয়োগ পেয়েছেন।

তাঁদের একজন পরবর্তী সময় নিয়োগ বোর্ডের একজন সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির সহ-উপাচার্যের মেয়ের জামাই হয়েছেন। অন্যজন একই বিভাগের একজন শিক্ষকের স্ত্রী হয়েছেন।

এই দুজনের কেউই আগের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষক হিসেবে আবেদনেরও যোগ্য ছিলেন না। উল্লেখ্য তদানীন্তন উপাচার্য নিজের জামাতাকে নিয়োগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করেছিলেন।

নতুন নিয়মের অধীন অন্তত ৩৪ জন অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁদের কারওর আগের নিয়মে শিক্ষক হিসেবে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল না।

তাঁদের মধ্যে উপাচার্যের মেয়ে বিভাগে মেধাক্রমে ২২তম এবং জামাতা বিভাগে ৬৭তম অবস্থানে ছিলেন। এই অনিয়ম ২০১৮ সালের। আজ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কাউকে এর জন্য কোনো জবাবদিহির মধ্যে আনা হয়নি কিংবা কারও বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যদিও বিষয়টি নিয়ে একাধিক তদন্ত কমিটি হয়েছে কিন্তু ফলাফল শূন্য।

এখানেই সম্ভবত নুরুল হুদার ক্ষোভ ও হতাশা। আর সে কারণেই তাঁর এই প্রতিবাদ।

বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বা শিক্ষার যেকোনো স্তরে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ-দুর্নীতি একটি গুরুতর উদ্বেগ। কারণ, শিক্ষা খাতের দুর্নীতি জাতিকে মেধাশূন্য করে গভীর অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে। ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে কম যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থী নিয়োগ পাওয়ায় শিক্ষার গুণগত মান কমছে।

এই প্রতিবাদ কর্তৃপক্ষের প্রতি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও জবাবদিহির একটি শক্ত আহ্বান। এই প্রতিবাদ যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার, মেধাভিত্তিক নিয়োগের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে সুশাসন কার্যকর করার পক্ষে সমর্থন।

বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বা শিক্ষার যেকোনো স্তরে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ-দুর্নীতি একটি গুরুতর উদ্বেগ। কারণ, শিক্ষা খাতের দুর্নীতি জাতিকে মেধাশূন্য করে গভীর অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে। ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে কম যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থী নিয়োগ পাওয়ায় শিক্ষার গুণগত মান কমছে।

এই প্রতিবাদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসি এবং জনসাধারণের কাছে যে বার্তাটি পাঠায় তা হলো, শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি মোকাবিলায় অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। যেন আর কোনো নুরুল হুদাকে তাঁর কৃতিত্বের জন্য অর্জিত স্বর্ণপদক ফেরত দিতে না হয়।

  • ড. ফরিদ খান, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
    ই–মেইল: faridecoru@yahoo.co.uk