বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নারী-পুরুষ প্রায় সমান

বেশির ভাগ এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রামমুখী। সেখানে পুরুষেরা কাজে থাকেন। বাড়ির কাছে হওয়ায় ব্যাংকে যাচ্ছেন নারীরা। আবার প্রবাসী স্বামীর রেমিট্যান্স তুলতেও স্ত্রীরা ব্যাংক হিসাব খুলছেন।

দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং শুরুর ৯ বছরে নারী ও পুরুষ ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা প্রায় সমান সমান। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি গত জুনে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে মোট হিসাবধারীর সংখ্যা ১ কোটি ৮৯ লাখ ৩৪ হাজার ১৫৩। এর মধ্যে প্রায় ৪৯ শতাংশ নারী ব্যাংক হিসাবধারী ও ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ পুরুষ হিসাবধারী। বাকি ১ শতাংশের বেশি হিসাবধারী অন্য লিঙ্গের ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

প্রতিবেদন অনুসারে, আগের ত্রৈমাসিকের (২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) তুলনায় এই ত্রৈমাসিকে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নারী হিসাবধারী ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ফলে পুরুষের সঙ্গে নারী হিসাবধারীর পার্থক্য কমে প্রায় সমান হয়ে গেছে। এক বছরে নারী হিসাবধারী বেড়েছে ২৫ শতাংশ। এই তথ্য বলছে, আনুষ্ঠানিক আর্থিক লেনদেনপ্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।

ব্যাংক এশিয়া ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশে প্রথম মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু করে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে।

এজেন্টরা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, ছোট অঙ্কের ঋণদান, বিভিন্ন সেবার বিল পরিশোধে কাজ করে। পাশাপাশি এখান থেকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর অর্থও তোলা যায়।

দেশে মোট ৬২টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ৩১টি এজেন্ট ব্যাংকিং করছে। সারা দেশে ১৫ হাজার ৪০৯ এজেন্ট ও ২১ হাজার ৯৯ আউটলেট চালাচ্ছেন।

নারী হিসাবধারী কেন বাড়ছে

বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান মো. আহসান উল আলম গত ২৭ জুন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের সামাজিক পরিস্থিতির কারণে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নারী হিসাবধারীর সংখ্যা বাড়ছে। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ব্যাংকিং হওয়ায় যাঁর হিসাব তাঁকে সরাসরি ব্যাংকে যেতে হয়।

আহসান উল আলম বলেন, বেশির ভাগ এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রামমুখী। সেখানে পুরুষেরা কাজে থাকেন। বাড়ির কাছে ব্যাংক হওয়ায় নারীরা লেনদেনে যুক্ত হচ্ছেন। আবার গ্রামে অনেক পুরুষ প্রবাসী, রেমিট্যান্স তুলতে স্ত্রীরা ব্যাংক হিসাব খুলছেন।

‘খয়রাত দেব না, এখন চলে যান’

২০১৪ সালে আলছিন আরিফা (৩০) সিরাজদিখানের রাজানগর ইউনিয়নে বাবার বাড়িতে দুই কক্ষের ঘর তুলে ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিং শুরু করেন। শুরুতে অনেক কষ্ট হয়েছে জানিয়ে গত ২৭ জুন তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিনা পয়সায় ব্যাংক হিসাব খোলার লোক খুঁজে পেতাম না। একবার ব্যাংকের কোট–টাই পরা লোক নিয়ে গেছি। একজন তাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, “খয়রাত দেব না, এখন চলে যান।”’

আরিফা বলেন, শুরুতে ২০ লাখ টাকায় একটি আউটলেট করেন। পরে চিত্রকুট ইউনিয়নের চিত্রকুট গ্রাম ও মরিচাবাজারে আরও দুটি আউটলেট দেন। এখন তাঁর তিনটি আউটলেটে ২ হাজার ২০০ ব্যাংক হিসাব আছে, যার ৭০ শতাংশই নারীদের। এখন তাঁর স্বামী জাকির হোসেনেরও দুটি এজেন্ট ব্যাংক আছে।

উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের নয়ানগর গ্রামের লাবণী আক্তার (৩১) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বছর চারেক আগে আরিফার রাজানগর আউটলেটে হিসাব খোলেন। স্বামী আলমগীর হোসেন মালয়েশিয়ায় থাকতে ওই হিসাবে টাকা পাঠাতেন। তাঁর স্বামী দেশে ফেরার পর তিনি একই আউটলেটে হিসাব খুলেছেন। সম্প্রতি তাঁর স্বামী ঋণও নিয়েছেন। ঘরোয়া পরিবেশ আর মেয়েরা বেশি লেনদেন করেন বলে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

নারীরা ঋণ পাচ্ছেন কম

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে মার্চ পর্যন্ত মোট আমানত প্রায় ৩১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। ঋণ দেওয়া হয়েছে ১১ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। রেমিট্যান্স এসেছে ১ লাখ ২১ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। ৮৬ শতাংশ আউটলেটই গ্রাম এলাকায়। আমানতের ৭৬ শতাংশই আসে গ্রাম থেকে। শহর–গ্রাম মিলে মোট আমানতের প্রায় ৩৫ শতাংশ নারীদের, ৫৭ শতাংশ পুরুষদের এবং বাকি ৮ শতাংশ অন্য লিঙ্গের মানুষদের। আগের তুলনায় এই ত্রৈমাসিকে আমানতের হার প্রায় ৫ শতাংশ বেড়েছে। ঋণ দেওয়ার হার বেড়েছে ১৩ শতাংশ।

তবে নারীদের ঋণ পাওয়ার হার খুবই কম। মার্চ পর্যন্ত মাত্র ১৩ শতাংশ নারীকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, নারীদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো আস্থা পায় না এবং গ্রামীণ উদ্যোগে নারীদের অংশগ্রহণ কম।

ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি মো. আরফান আলী এখন ‘অংকুর’ নামের একটি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। গত ১৮ জুন তিনি মহাখালীর কার্যালয়ে বসে প্রথম আলোকে বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যত বেশি নারী যুক্ত হবেন, তত তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। ব্যাংকিংয়ে মোট হিসাবের ৩৬ শতাংশ এখন এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ও শাখা ব্যাংকসহ মোট হিসাবধারী ছিলেন ১৪ কোটির বেশি (অনেকের একাধিক ব্যাংক হিসাব রয়েছে)। এর মধ্যে নারী হিসাবধারীর আলাদা তথ্য নেই।

এখনো বৈষম্য প্রকট

গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফ) নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কামাল মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা ভাতা তুলতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নারী হিসাবধারীর সংখ্যা বাড়তে পারে। তবে প্রকৃতভাবে নারীর অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির স্বার্থে সেসব ব্যাংক হিসাব নিয়মিত ব্যবহার হতে হবে।

ব্যাংকিংয়ে নারী–পুরুষ বৈষম্য কমাতে এজেন্ট ব্যাংকিং একটা মাধ্যম হতে পারে। এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করে নারী এজেন্ট নিয়োগ, নারী হিসাবধারীর ব্যাংকিং জ্ঞান ও শিক্ষা বাড়ানো, অর্থ লেনদেনে নিজের ব্যাংক হিসাব চালানোর সক্ষমতা বাড়ানো এবং নারীবান্ধব ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলে নারীর অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে হবে।