সাপের কামড়ে মৃত এক ব্যক্তিকে ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে জীবিত করার আয়োজন করে টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে যান এক কবিরাজ। ২৯ জুন, গাজীপুরের কালিয়াকৈর।
সাপের কামড়ে মৃত এক ব্যক্তিকে ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে জীবিত করার আয়োজন করে টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে যান এক কবিরাজ। ২৯ জুন, গাজীপুরের কালিয়াকৈর।

চন্দ্রবোড়া কি সরকারের টনক নড়াতে পারল

চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার, গোখরা (খইয়া গোখরা ও গোখরা বা জাতি সাপ) ও কালকেউটে সাপের কামড়ে আমাদের দেশে প্রতিবছর বহু মানুষ মারা যান বা প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। এর মূল কারণ সর্পদংশনে মারা যান গ্রামের গরিব মানুষ। সর্পদংশনে সচ্ছল পরিবারের কারও মারা যাওয়ার নজির প্রায় নেই। বিষয়টি নিয়ে তাই সরকারের বা জাতীয়ভাবে আমাদের মাথা ঘামানোর বিশেষ কারণ নেই। 

আজকাল মুঠোফোন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবরও আমরা জেনে ফেলি। সে কারণে চন্দ্রবোড়াজনিত কাণ্ডে সরকারসহ সবাই বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন। 

সাপবহুল এলাকায় মানুষ, চিকিৎসক ও সরকারের কী কী করণীয়, প্রথম আলোর ২৩ জুন সংখ্যায় ফরিদ আহসান খুবই সময়োপযোগী তথ্য দিয়ে তা জানিয়েছেন। আশা করি আমাদের চিকিৎসকেরা সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা দিতে ভালো প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাঁরা প্রস্তুত। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে এ কথা মাথায় রাখতে হবে যে সময়টা অনেক পাখি, ইঁদুর ও টিকটিকির প্রজননকাল। এগুলোর প্রতিটিই চন্দ্রবোড়াসহ বহু সাপ, অন্যান্য শিকারি প্রাণীর প্রধান খাবার। ফলে এ সময় এ ধরনের প্রাণীর সক্রিয়তা হঠাৎ করে বেড়ে যায়।

অতিমাত্রায় কীটনাশক ও ইঁদুরের বিষ ব্যবহারের ফলে সাপ ও ইঁদুর ধরে খাওয়ার মতো শিকারি পাখি, শিয়াল, বেজি ও গুইসাপও চাষাবাদের জমি থেকে বিলীন হয়েছে। আগে গ্রামে বা খেতখামারের আশপাশে যেসব উঁচু গাছ ছিল, সেসব ব্যাপকভাবে কাটা হয়েছে। ফলে শিকারি পাখিদের উঁচু গাছে বসবাস করার এবং সেখানে বসে খেতখামার থেকে সাপ বা ইঁদুর ধরে খাওয়ারও কোনো বাস্তব অবস্থা নেই।

এই নতুন পরিস্থিতির জন্য তাই আমাদের প্রস্তুতি রাখতে হবে। চন্দ্রবোড়াসহ অন্যান্য সাপের সংখ্যা বৃদ্ধির সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার কাছাকাছি হাসপাতালে বা চিকিৎসাকেন্দ্রে সাপের বিষের প্রতিক্রিয়া রোধক অ্যান্টিভেনিন বা অ্যান্টিভেনমের পর্যাপ্ত মজুত থাকা দরকার।

গ্রামগঞ্জে সর্পদংশনে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় যাতে সাপুড়ে, ওঝা বা হাতুড়ে ডাক্তারেরা যুক্ত হয়ে পড়েন, এ জন্য ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচারণা দরকার। নির্দেশনা অমান্য করলে শাস্তির ব্যবস্থাও করতে হবে।

সবচেয়ে ভালো হয় সাপের কামড় ঠেকানো গেলে। এ জন্য কৃষকদের আরও সচেতন করা প্রয়োজন। মাঠে কাজ করার সময় তাঁরা যদি গামবুট ও দস্তানার সঙ্গে লুঙ্গির বদলে ট্রাউজার পরেন, তাহলে সাপ কামড় দিলেও তার বিষদাঁত পায়ের ত্বকে ঢোকার আশঙ্কা বিপুলভাবে হ্রাস পাবে। 

বর্তমান পরিস্থিতিতে বন্য প্রাণী সুরক্ষা বা সংরক্ষণ আইন থেকে চন্দ্রবোড়া সাময়িকভাবে তালিকামুক্ত করা উচিত, যাতে আতঙ্কবশত সাপ মারলে সংরক্ষিত প্রজাতি হত্যার দায়ে শাস্তি পেতে না হয়। তবে এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন চন্দ্রবোড়াবহুল অঞ্চলে ঢালাওভাবে সাপ না মেরে তা ধরার ব্যবস্থা করা।

কারণ, দু-একটি প্রজাতির বিষধর সাপ ছাড়া বাকি সব সাপই মানুষের, বিশেষ করে কৃষকের উপকার করে থাকে। ইঁদুর যে ফসলের কী ব্যাপক ক্ষতি করে, ভুক্তভোগী কৃষকমাত্রই তা জানেন। ইঁদুরখেকো সাপ কৃষকের পরম বন্ধু।

জনসাধারণকে চন্দ্রবোড়াসহ অন্যান্য সাপের বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সর্পবিজ্ঞানী, সাপের বিষ প্রতিরোধী ওষুধের গবেষক এবং সাপ উদ্ধারকারীদের এতে কাজে লাগানো সম্ভব। সর্পবহুল অঞ্চলে বন বিভাগ বা যৌথভাবে বন বিভাগ ও কৃষি বিভাগ বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা তাঁদের আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। দেশের গণমাধ্যমেরও এখানে ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। সাপের কামড়ে বা বন্য প্রাণীর আক্রমণে মৃত্যু বা ক্ষয়ক্ষতির জন্য স্বল্প কিস্তির বিমাও চালু করা যেতে পারে। 

বর্তমান পরিস্থিতিতে দুটি বিষয় সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের যথাযথভাবে প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়ত, দেশেই চন্দ্রবোড়া, দুই প্রজাতির গোখরা ও দু-তিন প্রজাতির কালকেউটের বিষ প্রতিরোধী অ্যান্টিভেনম তৈরি করা। নিজেরা তৈরি করতে পারলে সারা দেশে এটি সহজলভ্য করা যাবে। 

এ নিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে কাজ করার সুযোগ আছে। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি এসব সাপ উদ্ধার করে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে বা এ রকম কোথাও একটি সর্পখামার স্থাপন করা যায়। তাহলে সেখানে সব সাপ, বিশেষ করে চন্দ্রবোড়া সংরক্ষণ ও প্রজনন করা যেতে পারে। এসব সাপের বিষ হতে পারে অ্যান্টিভেনম তৈরির উপাদান। এমনকি সংগৃহীত বিষ দিয়ে বিদেশের সঙ্গে অ্যান্টিভেনম বিনিময় করাও সম্ভব।

সাপে কাটা রোগীদের নিয়ে বাংলাদেশে অনেক বিভ্রাট আছে। তার কিছু ধারণা ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলাদেশের সাপ নামের বইটিতে আমি দিয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ১. সাপে কাটলেই মানুষ ভাবেন, তাঁকে বিষধর সাপে কেটেছে। ২. সাপে কাটা সব মানুষ ভাবেন, তাঁর বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। ৩. সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রথমে খোঁজা হয় সাপুড়ে, ওঝা বা হাতুড়ে ডাক্তারদের। ৪. চিকিৎসার জন্য ঝাড়ফুঁক, পানি পড়া ইত্যাদি স্থানীয় চিকিৎসার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন। ৫. সাপে কামড়ানো রোগীকে রেখে অনেকে সাপ মারার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ৬. রোগীকে ঘিরে অনেকেই নানা মুখরোচক গল্পে জড়িয়ে পড়েন। রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা কমতে থাকে। 

বর্তমান পরিস্থিতিতে দুটি বিষয় সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের যথাযথভাবে প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়ত, দেশেই চন্দ্রবোড়া, দুই প্রজাতির গোখরা ও দু-তিন প্রজাতির কালকেউটের বিষ প্রতিরোধী অ্যান্টিভেনম তৈরি করা। নিজেরা তৈরি করতে পারলে সারা দেশে এটি সহজলভ্য করা যাবে। 

কেবল চিকিৎসক নন, স্বাস্থ্যকর্মীদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তাঁরাও সাপে কাটা রোগীকে প্রাথমিকভাবে কয়েক ডোজ অ্যান্টিভেনম দিতে পারেন। পাশের দেশ মিয়ানমারে গ্রামীণ পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের সেভাবেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে তাঁরাই তিন-চার বোতল অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে পারেন। রোগী এরপর হাসপাতালে পৌঁছালে অবস্থা বুঝে বাকি দায়িত্ব চিকিৎসক নেন। মিয়ানমার তাদের দেশি চন্দ্রবোড়ার অ্যান্টিভেনম হিসেবে তরল অ্যান্টিভেনম তৈরি করেছে। ভারতে তৈরি চার প্রজাতির সাপের অ্যান্টিভেনম ভায়ালে বা বোতলে ভরা পাউডার হিসেবে পাওয়া যায়। মিয়ানমারের মতো আমরাও তরল অ্যান্টিভেনম উৎপাদন করলে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা সহজ হবে। 

ড. রেজা খান দুবাই সাফারির প্রধান বন্য প্রাণিবিশেষজ্ঞ