কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মতামত

শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ রক্ষা হবে কি

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পর একজন শিক্ষার্থীর প্রধান কাজ হলো ‘পড়াশোনা’ করা, বিশ্বমানব হিসেবে নিজেকে মেলে ধরার জন্য ‘প্রস্তুতি’ গ্রহণ করা। কিন্তু আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কাজটি করতে এসে ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে কখনো সরকারি চাকরিতে ‘বয়স বাড়ানোর’ সংগ্রাম করতে হচ্ছে, আবার কখনো কোটা সংস্কারের আন্দোলন। আর এসব করতে গিয়ে কখনো তাঁদের শরীরে রক্ত ঝরছে, আবার কখনো মানসিক নির্যাতন।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ‘সাধারণ শিক্ষার্থীরা’ সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার পরিবর্তন (সংস্কার) চেয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। শেষ পর্যন্ত তা ‘রক্তপাতে’ গড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকেরা রাতের আঁধারে মারধরের শিকার হয়েছেন। আহত হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন অনেকেই।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর, দেশের উচ্চশিক্ষালয়ে এই চিত্রের যে পরিবর্তন হয়নি, তার দায়দায়িত্ব যে–ই নিক না কেন, আমাদের বাচ্চাদের মনে যে ঘৃণাবোধ জন্ম নিচ্ছে, তার দায় অন্তত এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকারকে নিতেই হবে।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর তিন অস্ত্রধারীর গুলি। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে

যদিও এই সব রক্তপাত-সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে ‘দাবি’ আদায়ের ‘কৌশল’ বহু পুরোনো; কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্বের এই সময়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের যেখানে দেশ নিয়ে ভাবার কথা, বৈশ্বিক ক্ষেত্রে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার লড়াই করার কথা, সেখানে এই শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামতে হচ্ছে, সেটা ভাবতেই কষ্ট লাগছে। তরুণ প্রজন্মের মনটা বিষিয়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু কেন এমন হবে? কেন আমাদের ছেলেমেয়েদের বারবার রাজপথে নামতে হবে?

ভোটের বিতর্ক যেটাই হোক, সংবিধানের ধারাবাহিকতায় এই দেশে ‘সংসদ’ সচল রয়েছে। সাড়ে তিন শ সংসদ সদস্য দেশের আইনপ্রণেতা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু কখনোই তাঁরা আমাদের তরুণ প্রজন্মের দুঃখের কথা, দুর্দশার কথা সংসদে গিয়ে বলেন না। সেখানে গিয়ে তাঁরা দাবি তোলেন না যে চাকরিব্যবস্থায় আমাদের একটি ‘আদর্শিক-দৃঢ়’ নীতির প্রয়োজন। কোনো সংসদ সদস্যই শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি সেজে তাঁদের আক্ষেপগুলো সংসদে শোনাতে পারেননি, সরকারকে সম্পৃক্ত করাতে পারেননি।

জনগণের করের টাকায় চলা সংসদের তাহলে কী নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত?

বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে, আন্দোলন-সংগ্রাম না করলে কোনো যৌক্তিক দাবিই পূরণ হয় না। আর এসব দাবি পূরণে তাই সরকারপ্রধানের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। এবারও সেটাই ঘটেছে।

নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা

কোটা সংস্কারের দাবিতে ছয় বছর আগে শিক্ষার্থীরা যে দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন, সেই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ক্ষতি করে দাবি আদায় করেছিলেন, সেই দাবিটিকে অসাড় করে দিয়ে ফের কেন তাঁদেরকে রাস্তায় নামতে হলো? শিক্ষার্থীরা তো কোটা বাতিল চাননি। কোটা বাতিল হয়েছিল সরকারপ্রধানের নির্বাহী আদেশে। সেই আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। সেখান থেকেই নতুন করে জটিলতার শুরু।

বাস্তবতা হচ্ছে, কোটাব্যবস্থার যে একটি সংস্কার প্রয়োজন, এ নিয়ে খুব মতভেদ আছে বলে মনে হয় না। এখন কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় তা করা হবে, সেই পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা নীতিনির্ধারকদের থাকা উচিত। আমাদের মনে রাখা উচিত ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারের ভোটের একটি বড় অংশ ছিল ‘তরুণ’। এই তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, এই তরুণেরা জাগ্রত থেকে ২০১৩ সালে রাজাকার-আলবদরের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার ছিল। এই তরুণেরা এখন দেশের বিভিন্ন দায়িত্বে। ক্রমেই এই তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাওয়ার কথা।

নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কিন্তু ‘চাক্ষুষ-বৈষম্যের’ জাঁতাকলে পড়া এখনকার তরুণদের নিজেদের ‘রাজাকার’ ট্যাগ লাগানো, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা কিংবা ‘পক্ষ’ বানিয়ে ফেলার দায় তাহলে কার? এই তরুণদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা কতটা জরুরি ছিল?  

মনে রাখতে হবে, আজকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে রাস্তায় নেমেছেন মূলত ‘বেকারত্ব’ ঘোচানোর জন্য।

সরকারি চাকরিতে বৈষম্য দূর করতে একটি ঐক্য তৈরিতে তাঁরা সফল হয়েছেন, এই বিষয়টি আমাদের শাসকগোষ্ঠীর মানা উচিত। এই শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বোঝার সক্ষমতা সরকারের থাকা উচিত।

বিরোধী দলের মতো শিক্ষার্থীদের যে প্রতিপক্ষ বিবেচনা করা উচিত নয়, সেই বোধ থাকা দরকার।  

প্রজন্মের এই রূপান্তরে ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের’ শক্তিশালী করার দায়িত্ব যদি সরকার নিয়ে ফেলে, তাহলে মনে রাখতে হবে, আমাদের মহান স্বাধীনতার স্বপ্ন তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বা দিচ্ছে। জাতিগত বিভেদ আর আদর্শিক বিভেদের মতো তফাতটা আমাদের জানতে হবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ক্ষমতাসীনেরা যদি মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মানের জন্য যদি তাঁদের নাতি-পুতিদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে, ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি’ শক্তিশালী হবে, তা হলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী চাকরিক্ষেত্রে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নামতেন না।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যে শক্তিশালী করা যাবে না, সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। এর বদলে তাঁদের যোগ্যতাভিত্তিক (মেধা শব্দটি বেমানান) সরকারি চাকরির সম–অধিকার ফেরাতে কোটা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা জরুরি।

কোটা সংস্কারের জন্য কমিশন করুন, আলোচনা করুন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আর নারীদের অবস্থান নিশ্চিত করে কোটা সংস্কার জরুরি, তা মস্তিষ্ক দিয়ে বিচার করুন।

মনে রাখতে হবে, বল প্রয়োগে যে ক্ষয় হবে বা হচ্ছে, তাতে কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা বলবান হচ্ছে। এখন সিদ্ধান্ত আপনাদের হাতে, আপনারা রক্তপাত করে তরুণদের মনকে আরও বিষিয়ে তুলতে চান, নাকি তাঁদের চিন্তাচেতনায় সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশকে রাখতে চান।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

    ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com