জরুরি মার্কিন সহায়তা হয়তো ইসরায়েলি অর্থনীতির ওপর এ চাপকে কিছুটা শিথিল করবে। কিন্তু অর্থনীতির যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে।
জরুরি মার্কিন সহায়তা হয়তো ইসরায়েলি অর্থনীতির ওপর এ চাপকে কিছুটা শিথিল করবে। কিন্তু অর্থনীতির যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে।

গাজা যুদ্ধ যেভাবে ইসরায়েলকে অর্থনৈতিক চাপে ফেলে দিল

যুক্তরাষ্ট্রের জরুরি সহায়তায় হয়তো সাময়িক স্বস্তি মিলবে ইসরায়েলের। তবে গাজা যুদ্ধের কারণে তাদের যে ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে এবং এ ক্ষতি আরও বাড়বে।
যেকোনো যুদ্ধের ব্যয় নিরূপিত হয় মানুষের জান ও মালের ক্ষতির ওপর। যুদ্ধরত দেশের অর্থনীতির ওপর এ যুদ্ধের প্রভাব কী, তার হিসাব-নিকাশ হয় পড়ে। গাজায় গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল যুদ্ধ ঘোষণার পর দেশটির বিভিন্ন খাত ক্ষতিতে পড়েছে। ইসরায়েল যদি তার সামরিক অভিযান দীর্ঘায়িত করে, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতিও নেতিবাচক ফল ভোগ করবে, অধিকৃত ফিলিস্তিনের কথা না হয় বাদই দিলাম।

অর্থনীতির আকার, মাথাপিছু আয় ও অন্যান্য জরুরি বিষয় বিবেচনায় ইসরায়েলের অর্থনীতি অনেক অগ্রসর বলে বিবেচিত। ২০২২ সালে ইসরায়েলের মোট দেশজ উৎপাদন ছিল ৫২২ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থনীতি মিসর, ইরান, মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়ার চেয়ে বেশি। যদিও এই দেশগুলোয় জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে।

ইসরায়েলের জনপ্রতি দেশজ উৎপাদন ৫৫ হাজার ডলার। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো উন্নত দেশগুলোও জনপ্রতি দেশজ উৎপাদনে ইসরায়েলের চেয়ে পিছিয়ে আছে। এ ছাড়া তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরব, কুয়েত, এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের চেয়েও ইসরায়েল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ।

ইসরায়েলের অর্থনীতিতে বড় উল্লম্ফন ঘটে গত দুই দশকে । চীন ছাড়া দ্রুত বাড়তে থাকা অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ইসরায়েলি অর্থনীতির অবস্থান প্রথম বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এমনকি ২০০০-২২ সাল মেয়াদে ইসরায়েলি অর্থনীতি, মার্কিন, ইউরোজোন ও জাপানের অর্থনীতির চেয়ে দ্রুত এগিয়েছে। গত ২২ বছরে ইসরায়েলের অর্থনীতির আকার তিন গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।

এই উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ প্রযুক্তি খাতে ইসরায়েলের ব্যাপক অগ্রগতি। সিলিকন ভ্যালির পর প্রযুক্তিতে ইসরায়েলই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঞ্চল। ইসরায়েলের প্রযুক্তি খাত দেশটির উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে পঞ্চম স্থানে রয়েছে এবং মোট রপ্তানির ৫০ শতাংশই আসছে এ খাত থেকে। সন্দেহ নেই, যুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে এ খাতেই।

ইসরায়েলের এ যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যয় আছে। প্রত্যক্ষ ব্যয়ের একটি হলো যুদ্ধের কারণে প্রতিদিনকার ব্যয়। এ ব্যয় মেটাতে ইসরায়েল অতি উচ্চ সুদে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চেয়েছে।

যুদ্ধের প্রতিদিনকার ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে অস্ত্রশস্ত্র, গুলি, বোমা, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য রসদ, রিজার্ভ ফোর্সের বেতন-ভাতা (যাঁরা গাজায় যুদ্ধ করার জন্য চাকরি ছেড়ে এসেছেন); ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও উড়োজাহাজের ক্ষতি, অবচয়, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ ইত্যাদি।

যুদ্ধের পরোক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন শিল্প, প্রযুক্তি, পর্যটন ও শ্রমবাজারের ওপর। বৈশ্বিকভাবে প্রতিবছর ইসরায়েল ৮০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের হাইটেক সামগ্রী রপ্তানি করত। এ যুদ্ধ নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
একটা উদাহরণ দিই, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সাড়ে তিন লাখ রিজার্ভ সেনাকে গাজা যুদ্ধে অংশে নিতে ডেকে পাঠিয়েছে। তাঁদের বড় অংশই প্রযুক্তি খাতের কর্মী। তাঁরা এখন তাঁদের নিয়মিত কাজের বাইরে আছেন। অনেক কর্মী ও প্রতিষ্ঠান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। ফলে প্রযুক্তি খাতে কর্মরত এই ব্যক্তিরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারছেন না।

জরুরি মার্কিন সহায়তা হয়তো ইসরায়েলি অর্থনীতির ওপর এ চাপকে কিছুটা শিথিল করবে। কিন্তু অর্থনীতির যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। শেষ কথা হলো, অর্থনীতির বিকাশের জন্য স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা—দুইই প্রয়োজন। এ ক্ষতির বাইরে আরও একটা বড় ক্ষতি হয়েছে—গাজায় নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ, প্রাণী ও অবকাঠামো ধ্বংস করে ইসরায়েল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে তার সুনাম খুইয়েছে।

মাইক্রোসফট, আইবিএম, ইনটেল, গুগলসহ প্রায় ৫০০ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলের টেক-সেক্টরে বিনিয়োগ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ইসরায়েলে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবে কি না, সেটি পুনর্বিবেচনা করতে পারে।

মাইক্রোসফট ইসরায়েল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের মুখ্য বিজ্ঞানী টোমার সিমন সম্প্রতি তাঁর এ উদ্বেগের কথা ইসরায়েলি নিরাপত্তা উপদেষ্টা তাজি হানেগবিকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন। সিমন বলেন, বহুজাতিক সংস্থাগুলোর বিকাশ নির্ভর করছে ইতিবাচক পরিবেশের ওপর। প্রযুক্তি খাতে একটি চাকরির বিপরীতে পাঁচজনের সম্পূরক কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলের শুধু কমলা উৎপাদনকারী অর্থনীতিতে পরিণত হওয়া উচিত হবে না।

সিলিকন ভ্যালি জায়ান্ট ইনটেল প্রথম ১৯৭৪ সালে ইসরায়েলে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। গত জুলাইতে তারা চিপ ও সেমিকন্ডাক্টর তৈরির জন্য ইসরায়েলি কারখানার সঙ্গে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি করেছিল। অস্থিতিশীলতার দরুন এ পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। ইনটেল এখনো এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত আছে। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে চিপ উৎপাদন কমেছে কি না, সে সম্পর্কেও জানায়নি তারা।
সমরাস্ত্রশিল্প বৃহৎ একটি রপ্তানি খাত। এ মুহূর্তে এসব কারখানায় যা কিছু তৈরি হচ্ছে, তার সবটাই চলে যাচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সমরাস্ত্র রপ্তানিতে তারা বড় ধাক্কা খেতে পারে।

তীর্থস্থান হওয়ায় প্রতিবছর হাজার হাজার পুণ্যার্থী খ্রিষ্টীয় ছুটির সময় জেরুজালেমে ভ্রমণে আসেন। ওল্ড সিটি অব জেরুজালেম এখন প্রায় জনশূন্য। বণিকদের কোনো আনাগোনা নেই, কেনাবেচাও নেই। শত শত পর্যটক তাঁদের রিজার্ভেশন বাতিল করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরায়েলে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছে।

অতিমারির সময় যখন সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, ইসরায়েলের অবস্থা তখন এমন হয়েছিল। এল আল ছাড়া অন্য কোনো এয়ারলাইনস বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে ওঠানামা করছে না। এ খাতে যেমন ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা আছে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা, কর ও অন্যান্য আয়ের পথ রুদ্ধ হতে পারে।

৭ অক্টোবরের পর ১ লাখ ২০ হাজার ফিলিস্তিনি কাজ হারিয়েছেন। এই শূন্যতা পূরণে এখন বাইরে থেকে জনশক্তি আমদানি করতে হবে। আগেই ইসরায়েল বলেছে, ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের জায়গায় ভারতীয়দের নিয়োগ দেওয়া হবে। এর অর্থ ইসরায়েলকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান, তাঁদের বাসস্থান ও বিমানভাড়ার ব্যবস্থাও করতে হবে তাদের।

ইসরায়েল বোমা বর্ষণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন জনপ্রতিনিধিরা সামরিক ও অর্থনৈতিক খাতে অর্থ বরাদ্দের দাবি তুলতে থাকে। বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেন ও ইসরায়েলের জন্য ১০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ১৪ বিলিয়ন ডলার যাওয়ার কথা ইসরায়েলে।

বিনিয়োগকারীরা এখন এমন কোনো দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন কি না, যে দেশ গত ১৭ বছরে ছয়টি যুদ্ধে জড়িয়েছে, তা নিয়ে সংশয় আছে।

মার্কিন কংগ্রেসে অনুমোদন ছাড়ের আলোচনায় তীব্র বিতর্ক হয়। কারণ, রিপাবলিকানরা অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধের শর্ত জুড়েছিল অনুদানের সঙ্গে। ডেমোক্র্যাটদের ছোট একটি দল এবং স্বতন্ত্র সিনেটর বার্নি স্যানডার্স এ অনুদানের সঙ্গে গাজায় প্রাণহানি কমানো ও আরও বেশি পরিমাণে মানবিক সহায়তা প্রদানের কথা তোলেন। শর্তগুলোর কোনোটিই গ্রাহ্য করা হয়নি।

যুদ্ধের শুরুর দিকে ইসরায়েলের অর্থ মন্ত্রণালয় ধারণা করেছিল, এ যুদ্ধের খরচ হবে ৫০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু যুদ্ধ যত এগিয়েছে, খরচের আশঙ্কাও তত বাড়ছে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এ খরচ ৪০০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে।

জরুরি মার্কিন সহায়তা হয়তো ইসরায়েলি অর্থনীতির ওপর এ চাপকে কিছুটা শিথিল করবে। কিন্তু অর্থনীতির যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। শেষ কথা হলো, অর্থনীতির বিকাশের জন্য স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা—দুইই প্রয়োজন। এ ক্ষতির বাইরে আরও একটা বড় ক্ষতি হয়েছে—গাজায় নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ, প্রাণী ও অবকাঠামো ধ্বংস করে ইসরায়েল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে তার সুনাম খুইয়েছে।

  • ওয়ালিদ আবু হেলাল অর্থনীতিবিদ ও গবেষক। বিভিন্ন আরব সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যকার

নিবন্ধটি মিডল ইস্ট আইয়ে প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ