বিশ্লেষণ

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে কেন এত প্রশ্ন

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ৫৭ ধারা দিয়ে শুরু; এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ‘সংস্করণ’ সাইবার নিরাপত্তা আইন,২০২৩; বিগত স্বৈরাচারী শাসনামলের বিভিন্ন সময়ে এই আইনগুলো হয়ে উঠেছিল সাইবার স্পেসে মানুষের মতপ্রকাশের জন্য বড় বাধা বা হুমকি এবং ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে লিখেছেন মনজুরুল ইসলাম

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শাসনের পতন হয় এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সরকারের পক্ষ থেকে বহুল আলোচিত–সমালোচিত, দমন-পীড়নমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইনটি বাতিলের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে সরকার আগের আইনটি বাতিল করে নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ পাস করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এরই মধ্যে ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদে অধ্যাদেশটির খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে।

এ অধ্যাদেশে প্রত্যাশা অনুযায়ী বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে এমন কিছু বিষয় অপরিবর্তিত রয়ে গেছে এবং নতুন যুক্ত করা হয়েছে, যা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষকে আশঙ্কামুক্ত করতে পারেনি।

ইতিবাচক পরিবর্তন

প্রথম উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন হলো, উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত অধ্যাদেশে ‘সাইবার সুরক্ষা’ হিসেবে নাগরিকদের সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে [ধারা ২(ভ)]। তবে এ অধিকার ক্ষুণ্ন হলে কোথায়, কীভাবে প্রতিকার পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। কেউ যদি কারও অধিকার ক্ষুণ্ন করে, তাহলে কী শাস্তি হবে, সেটাও এখানে উল্লেখ নেই। এ ক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া এবং কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তির বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা জরুরি ছিল।

নতুন অধ্যাদেশের (ধারা ২০) সাইবার স্পেসে জুয়াখেলার অপরাধ ও দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জুয়াখেলার জন্য কোনো অ্যাপ, ডিভাইস তৈরি বা খেলায় অংশগ্রহণ বা সহায়তা করলে এবং উৎসাহ দিতে বিজ্ঞাপনে অংশ নিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

আরেকটি ইতিবাচক পরিবর্তন হলো, সাইবার নিরাপত্তা আইনের বেশ কিছু বিতর্কিত ধারা এ অধ্যাদেশে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ড (ধারা ২১); পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণ (ধারা ২৪); আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি (ধারা ২৫); অনুমতি ব্যতীত পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার ইত্যাদির দণ্ড (ধারা ২৬); মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার ইত্যাদি (ধারা ২৯) এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো ইত্যাদির অপরাধ ও দণ্ড (ধারা ৩১)।

এই ধারাগুলো ছিল অস্পষ্ট ও বিস্তৃত। এসব ধারায় বৈধ মতপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল এবং স্বেচ্ছাচারীভাবে তা প্রয়োগ করা হয়েছিল। বিগত সরকারের আমলে এসব ধারায় মামলা করে বিরোধী মত দমন করার বহু উদাহরণ রয়েছে। রাজনীতিক, অ্যাকটিভিস্ট, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অনেকেই এসব মামলায় ভুক্তভোগী ছিলেন।

বিতর্কিক যে ধারাগুলো বহাল রইল

বিতর্কিত বেশ কিছু ধারা বাতিলের পাশাপাশি পুরোনো কিছু ধারা সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে বহাল রাখা হয়েছে, যেগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনেও ছিল। এই ধারাগুলো বহাল থাকায় তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ রকম কয়েকটি ধারা হলো—

‘কতিপয় তথ্য-উপাত্ত অপসারণ ও ব্লক করার ক্ষমতা’

বাতিল হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৮(১) ধারার মতো সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ৮(১) ধারায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরোধে বিটিআরসিকে (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) যেকোনো কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করবার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ৮(২) ধারা অনুসারে, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা এর কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহলে এমন কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করা যাবে।

কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করার যে কারণগুলো এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তা অস্পষ্ট ও বিস্তৃত। ফলে এগুলোর অতিরিক্ত ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা দেশের সংহতির মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করায় তা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) অনুমোদিত সীমার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়নি। এ ধারার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে একতরফা কনটেন্ট ব্লক করা এবং অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কী কারণে কোন কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করা হচ্ছে, সেই বিষয়ে বিচারিক পর্যালোচনা, জবাবদিহি ও পরিসংখ্যান প্রকাশের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কনটেন্ট ব্লক বা অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হলে অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করার বিষয়টি শুধু একটি স্বাধীন সংস্থার (আদালত বা বিচারিক সংস্থা) সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এবং সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত আইন অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া উচিত। শুধু গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে এটি সীমাবদ্ধ থাকা উচিত।

এ ধারা সাংবাদিকতা, অনলাইন অ্যাকটিভিজম এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এ ধারা বহাল থাকলে ব্লকিং, ফিল্টারিং ও সেন্সরশিপকে উৎসাহিত করবে।

‘সাইবার সন্ত্রাসী কার্য সংঘটনের অপরাধ ও দণ্ড’

বাতিল হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৭ ধারাটি প্রায় হুবহু সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ২৩ ধারায় প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধু দণ্ডের পরিমাণ অনধিক ১৪ বছর থেকে কমিয়ে ১০ বছর করা হয়েছে।

এ ধারা সাইবার স্পেসে সন্ত্রাসবাদ সংঘটিত করা সম্পর্কিত। এখানে যেভাবে ‘সাইবার সন্ত্রাস’কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা অত্যন্ত বিস্তৃত এবং জনগণের বোধগম্যতার জন্য যথেষ্ট সুস্পষ্ট বা নির্ভুল নয়। ফলে তারা কীভাবে তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে, তা বুঝে ওঠা কঠিন। এ ধারার ভাষা সন্ত্রাসবাদের প্রতিরোধের জন্য সাধারণভাবে ব্যবহৃত ভাষার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।

‘সাইবার বুলিং, ব্ল্যাকমেলিং বা অশ্লীল বিষয়বস্তু প্রকাশ–সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ড’

বাতিল করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারার সঙ্গে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ২৫ ধারার ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও মর্মগতভাবে তেমন কোনো পার্থ্যক্য নেই। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে নতুনভাবে ব্ল্যাকমেলিং বা অশ্লীল বিষয়বস্তু প্রকাশের বিষয়টি সংযোজন করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় ‘কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয়প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার’ করাকে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছিল। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে প্রায় একই রকম কথা রয়েছে।

নারী ও শিশুদের সুরক্ষার জন্য এ ধারায় ‘সাইবার বুলিং’কে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে—এমনটা দাবি করেছেন সরকারসংশ্লিষ্ট কেউ কেউ। ‘সাইবার বুলিং’—এর আওতার মধ্যে যেসব কাজকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেগুলোকে সুবিধামতো ব্যাখ্যা করার সুযোগ এই ধারায় রয়েছে। এতে অনেক ধরনের সমালোচনাকেই ‘সাইবার বুলিং’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যাবে। ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে যেমন কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয়প্রতিপন্ন করার অভিযোগে মানুষকে নিপীড়ন ও হযরানি করা হতো, একইভাবে ‘সাইবার বুলিং’– এর অভিযোগে মানুষকে নিপীড়ন ও হয়রানি করবার সুযোগ তৈরি হবে।

এ ধারায় ব্ল্যাকমেলিং বা অশ্লীল বিষয়বস্তু প্রকাশের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ‘ব্ল্যাকমেলিং’-এর একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও ‘অশ্লীল’ বিষয়বস্তুর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ‘অশ্লীল’ বা ‘অশ্লীলতা’ খুবই আপেক্ষিক বিষয়। দেশ-কাল-সংস্কৃতিভেদে ‘অশ্লীল’ বিষয়বস্তু একইরকম হয় না। ফলে এটা নিয়ে ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে।

‘ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতিতে আঘাত...’

প্রায় একই রকম একটি ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় ছিল। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ২৬ ধারায় কিছু শব্দ সংযোজন-বিয়োজন এবং ভাষাগত পরিবর্তন করে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে বা সাইবার স্পেসে ছদ্মপরিচয়ে নিজের বা অন্যের আইডিতে প্রবেশ করিয়া ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে সাইবার স্পেসে এইরূপ কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত করে তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’

আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত চুক্তি অনুযায়ী এ ধারায় প্রয়োজনীয় স্পষ্টতার অভাবে রয়েছে। ধর্মীয় বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার ঘটনাগুলোকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হলে তা অবশ্যই বৈষম্য, শত্রুতা বা সহিংসতায় প্ররোচনার উচ্চমাত্রায় পৌঁছাতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ধর্মীয় নেতাদের সমালোচনা বা ধর্মীয় মতবাদের ওপর মন্তব্য প্রতিরোধ বা শাস্তি দেওয়ার জন্য সীমাবদ্ধ করা উচিত নয়।

পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’-এর মতো ধারা সাধারণত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে হয়রানি করার জন্য ব্যবহার করা হয়। গত সরকারের আমলে এ রকম বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এ রকম বিধান ব্যক্তিগত সহিংসতাকে বৈধতা দেওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করে। অধ্যাদেশের এ ধারা আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার–সম্পর্কিত চুক্তি এবং নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

‘পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়নায় তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের বিষয়টি ছিল। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশেও (ধারা ৩৫) পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতা একইভাবে বহাল রাখা হয়েছে। তবে এখানে নতুন একটি উপধারা যোগ করে গ্রেপ্তারের পর গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে অনতিবিলম্বে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেট বা ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটির জন্য কোনো সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি।

এ ধারায় পুলিশ কর্মকর্তার ‘বিশ্বাস করিবার কারণ থাকে’—এ রকম কথা বলে তাঁকে ‘অসীম স্বাধীনতা’ দেওয়া হয়েছে। বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক কাউকে হেনস্তা করার সুযোগ থাকে। পুলিশ কর্মকর্তার এই ‘অসীম স্বাধীনতা’ সেই সুযোগ আরও বৃদ্ধি করবে। এ ধারা আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার–সম্পর্কিত চুক্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

‘অজামিনযোগ্য অপরাধ ও বিচার–পূর্ব আটক’

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ৪৬ ধারায় এ অধ্যাদেশের অধীন কোন অপরাধসমূহ জামিনযোগ্য ও অজামিনযোগ্য তা উল্লেখ করা হয়েছে। খসড়া অধ্যাদেশ অনুসারে, ধারা ১৭, ধারা ১৮–এর উপধারা (১)-এর দফা (গ), ধারা ১৯, ধারা ২২, ধারা ২৩–এ উল্লেখিত অপরাধসমূহ অজামিনযোগ্য। এই অপরাধসমূহের ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিচার-পূর্ব আটকের বিকল্প কোনো সুযোগ থাকে না। অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিচার-পূর্ব আটক রাখা হয়।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে বিচার-পূর্ব আটক কোনো নিয়ম বা চর্চা হওয়া উচিত নয়, বরং ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। একইভাবে এটি অভিযুক্তদের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত নয়, বরং এটি একটি মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত। মূল্যায়নে এটি নির্ধারণ করতে হবে যে কাউকে আটক রাখা যুক্তিসংগত ও প্রয়োজনীয় কি না। কারও পালানোর ঝুঁকি, সাক্ষ্য-প্রমাণে হস্তক্ষেপ বা অপরাধ পুনরাবৃত্তি রোধ করার মতো কারণ না থাকলে তাঁকে বিচার-পূর্ব আটক রাখা উচিত নয়।

অধ্যাদেশ অনুমোদনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের পক্ষ থেকে আগের আইনটি বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করা হয়েছে এবং এরই মধ্যে তা উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু অনুমোদিত এই খসড়াতেও বেশ কিছু বিতর্কিত ধারা বহাল থাকায়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

লক্ষণীয় হলো, অধ্যাদেশের খসড়া ওয়েবসাইটে দিয়ে তা নিয়ে মতামত জানানোর জন্য মাত্র তিন দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে গভীর পর্যালোচনা এবং আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে যথাযথভাবে ও অর্থবহ সংলাপ বা মতবিনিময় হয়নি। ফলে এই অধ্যাদেশ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়েছে কি না, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।