এবার চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারটা এল একটা বিদঘুটে বিষয়ে। প্রাচীন ডিএনএ-এর গবেষণা বা পেলিওজেনেটিকসে কাজ করে শরীরবিদ্যায় ২০২২ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডিশ বিজ্ঞানী সোয়ান্তে প্যাবো। আজ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিয়ানডার্থাল মানুষের জেনেটিক কোড নিয়ে তিনি নাড়াচাড়া করেন। নিজের কাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্যাবো উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন, ‘আপনারা যেমন অতীত সম্পর্কে জানার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করেন, তেমনি আমরা মানুষের জিনোমে একধরনের খোঁড়াখুঁড়ি করি।’ প্রাচীন জিনোম খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে তিনি একটি বিলুপ্ত ও অজানা হোমিনিনের (আধুনিক মানুষ ও তাঁর দ্বিপদবিশিষ্ট বিলুপ্ত পূর্বপুরুষের অন্তর্ভুক্ত) সন্ধানও পান। যার নাম রাখা হয় ডেনিসোভা।
প্যাবোর উদ্ভাবিত কৌশলের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা আধুনিক মানুষের জিনোমের সঙ্গে বিলুপ্ত নিয়ানডার্থাল ও ডেনিসোভান মানুষের জিনোমের তুলনা করতে সক্ষম হয়েছেন। নোবেল কমিটির ভাষায়, ‘বিলুপ্ত হোমিনিনদের জিনোম এবং মানববিবর্তনের বিষয়ে আবিষ্কারের জন্য’ তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
প্রাচীন ডিএনএ নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানী প্যাবোকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। কারণ, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য মানববিবর্তনের প্রাচীন ইতিহাসের সুলুক সন্ধানও যে জরুরি, তা তিনি প্রমাণ করেছেন। আধুনিক মানুষের নিকটাত্মীয় নিয়ানডার্থাল মানুষ চল্লিশ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও প্যাবো ও তাঁর দল আফ্রিকার বাইরের মানুষদের মধ্যে ১-২ শতাংশ নিয়ানডার্থাল জিনের সন্ধান পেয়েছেন। এ রকম তথ্য এই আভাস দেয় যে নিয়ানডার্থাল মানুষ বিলুপ্ত হওয়ার আগে আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্সদের সঙ্গে সহাবস্থান করেছে, পারস্পরিক মিলনের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদন করেছে। এ কারণে প্যাবো বলেছেন, ‘নিয়ানডার্থালরা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি, আমাদের কারও কারও মধ্যে তারা কিছুটা পরিমাণে বেঁচে আছে।’
নিয়ানডার্থালরা কখনো আফ্রিকায় ছিল না বলে আফ্রিকার মানুষের মধ্যে নিয়ানডার্থালদের জিন পাওয়া যায়নি। প্যাবো ও তাঁর সহকর্মীরা দেখিয়েছেন, যেসব মানুষের মধ্যে নিয়ানডার্থালদের জিন আছে, তারা ‘কোভিড ১৯’ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ভেন্টিলেশন অর্থাৎ কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রয়োজন হয়েছে বেশি। এ বছর এক বক্তৃতায় প্যাবো বলেছেন, এবার করোনাভাইরাসে ১০ লাখের বেশি লোক মারা গেছেন নিয়ানডার্থাল জিন বহনের কারণে।
প্যাবোর গবেষণার ভিত্তিমূলে আছে বিবর্তনতত্ত্ব। পদার্থবিজ্ঞানে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব যেমন একটি মৌলিক তত্ত্ব, জীববিজ্ঞানে ডারউইনের তত্ত্ব তেমনি একটি মৌলিক তত্ত্ব। চার্লস ডারউইন ও তাঁর সমসাময়িক আলফ্রেড ওয়ালেস সম্পূর্ণ আলাদাভাবে কাজ করেও প্রাণীর বিবর্তন সম্পর্কে একই ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছান বলে বিবর্তনতত্ত্বকে ডারউইন-ওয়ালেস তত্ত্বও বলা হয়। অসংখ্য জীববিজ্ঞানী এই বিবর্তনতত্ত্বকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন দেড় শতাধিক বছর ধরে।
বিজ্ঞান এভাবেই এগোয়। একজন বিজ্ঞানীর নির্মিত ভিত্তির ওপর উত্তরসূরি বিজ্ঞানীরা একের পর এক নতুন ও উন্নততর ইমারত গড়ে তোলেন। জেনেটিকসের উন্নতি ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্বকে অকাট্য বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে। বিজ্ঞানী প্যাবোর কাজ বিবর্তনতত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি সুরম্য সৌধ। নোবেল পুরস্কার এ কাজের একটি বড় ধরনের স্বীকৃতিমাত্র। তবে এই নোবেল পুরস্কার বিবর্তনবিজ্ঞানের জন্য যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি, তেমনি বিবর্তনবিরোধী ‘ক্রিয়েশনিস্ট’ বা সৃজনবাদীদের জন্য তা বেশ বিব্রতকর।
পাশ্চাত্যের সব দেশেই ডারউইনের মতবাদ যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়। কিন্তু তার মানে অবশ্য এই নয় যে এই মতের বিরোধিতা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে নেই। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ধর্মীয়গোষ্ঠী ও দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে বিবর্তনবিরোধীদের একটা অবস্থান আছে। রোনাল্ড রিগ্যানের সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিবর্তনবিরোধী ‘ক্রিয়েশনিজম’ বা সৃজনবাদের পরিকল্পিত ও সংগঠিত উত্থান ঘটে।
বিভিন্ন জরিপে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় আধাআধি লোক সৃজনবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং ২৫-৩০ শতাংশ লোক সুনির্দিষ্টভাবে বিবর্তনবাদের বিরোধী। আমেরিকায় বিবর্তনবাদবিরোধী সৃজনবাদের প্রচারের জন্য হরেক রকম উৎস থেকে প্রচুর টাকা ঢালা হয়। ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’, ‘সায়েন্টিফিক ডিজাইন’, ‘বেসিক টাইপ বায়োলজি’ ইত্যাদি নানা নতুন বোতলে সৃজনবাদের পুরোনো জিনিস ফেরি করা তাদের কাজ। এখন মানববিবর্তনের অকাট্য বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নিয়ে কাজ করা একজন বিজ্ঞানীর নোবেলপ্রাপ্তি তাদের উৎসাহে কতটুকু জল ঢালে, তা দেখার বিষয়।
প্যাবোর কাজ নিয়ে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সৃজনবাদীরা আগেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। প্যাবো তাঁর বিখ্যাত ‘নিয়ানডার্থাল ম্যান: ইন সার্চ অব লস্ট জিনোম’ বইতে লিখেছেন, একদল মার্কিন খ্রিষ্টান মৌলবাদী তাঁকে বলেছেন যে ‘নিয়ানডার্থালরা তো আধুনিক মানুষেরই বর্তমানে বিলুপ্ত একটি গোত্রমাত্র। তারা বাইবেলে বর্ণিত টাওয়ার অব বেবেল-এর পতনের পর নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সুতরাং আধুনিক মানুষের (হোমো স্যাপিয়েন্স) সঙ্গে তাদের মিলনে তো বাধা নেই।’ আবার এসব মৌলবাদীর অন্য এক দল মনে করেন নিয়ানডার্থালরা ছিল বটে, তবে তারা মানুষ ছিল না, তারা ছিল পশু। এই পশুদের সঙ্গে মানুষের মেলামেশার যে তথ্য প্যাবোর দল আবিষ্কার করেছিল, তা তাঁদের পছন্দ হয়নি। যাদের কোনো বক্তব্য বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করার দায় নেই, যেকোনো বিষয়ের মনগড়া হাস্যকর ব্যাখ্যা দিতে তাদের ঠেকায় কে?
বিজ্ঞানচর্চার ও যুক্তিবাদিতার বেহাল অবস্থার কারণে বিশ্বের অনেক দেশে ডারউইনের মতবাদকে অনেকটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
সৌদি আরব, ওমান, আলজেরিয়া ও মরক্কোয় বিবর্তনবাদ পড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। লেবাননেও ধর্মীয় চাপে কারিকুলাম থেকে বিবর্তনবাদ বাদ দেওয়া হয়েছে। জর্ডানে ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যে বিবর্তনবাদ পড়ানো হয়। মিসর ও তিউনিসিয়ায় বিবর্তনবাদকে একটি অপ্রমাণিত হাইপোথিসিস হিসেবে পড়ানো হয়।
এসব দেশের অনেকগুলোতেই বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আনুষ্ঠানিক ফতোয়া দেওয়া আছে। তুরস্ক সেক্যুলার মতাদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্কুল থেকে ডারউইনকে বিদায় করার তোড়জোড় শুরু হয়। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হকের সময় ইন্টারমিডিয়েট ও বিএসসি সিলেবাস থেকে বিবর্তনতত্ত্ব বাদ দেওয়া হয়েছিল। প্যাবোর নোবেল পুরস্কার নিয়ে এসব দেশে কোনো আলোচনা হবে না।
বিবর্তনবাদে আস্থাশীল মানুষের সংখ্যা যতই হোক, বাংলাদেশে ডারউইনের মতবাদ পড়াতে তেমন বাধা ছিল না। যদিও যাঁরা পড়াতেন বা যাঁরা পড়তেন, তাদের অনেকের মধ্যেই একটা খচখচানি থেকে যেত। আবার কেউ কেউ— ‘ডারউইনের তত্ত্ব প্রমাণিত হয়নি’—এই ভ্রান্ত তথ্য আঁকড়ে অস্বস্তি কাটাতে চাইতেন
বিবর্তনবাদে আস্থাশীল মানুষের সংখ্যা যতই হোক, বাংলাদেশে ডারউইনের মতবাদ পড়াতে তেমন বাধা ছিল না। যদিও যাঁরা পড়াতেন বা যাঁরা পড়তেন, তাদের অনেকের মধ্যেই একটা খচখচানি থেকে যেত। আবার কেউ কেউ— ‘ডারউইনের তত্ত্ব প্রমাণিত হয়নি’—এই ভ্রান্ত তথ্য আঁকড়ে অস্বস্তি কাটাতে চাইতেন। এখন দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তির প্রশ্রয় ও উত্থানের এবং পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনার বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে এই সেদিন একজন বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে জেলে যেতে হলো! এর জন্য প্রতিবাদ হয়েছে বটে, কিন্তু মুক্ত বিজ্ঞানচর্চার ও বিজ্ঞানমনস্কতার পক্ষে মুক্তমনের মানুষ ও বিদ্বৎ সমাজের কোনো সংহত অবস্থান এ দেশে তৈরি হয়েছে—এমন বলা যাবে না।
নিউটনের সূত্র ছাড়া যেমন পদার্থবিদ্যাচর্চা সম্ভব নয় তেমনি ডারউইনের মতবাদকে অস্বীকার করে বর্তমান যুগে জীববিজ্ঞানচর্চা অসম্ভব। পাকিস্তানের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী পারভেজ হুদভয় এক লেখায় বলেছেন, নিউটনের সূত্র কেউ অস্বীকার করলেও যেমন মাধ্যাকর্ষণ বল উধাও হয়ে যাবে না, তেমনি ডারউইনের মতবাদ অস্বীকার করলেও বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নতুন ভাইরাসের আবির্ভাব বন্ধ হয়ে যাবে না। বিবর্তনতত্ত্ব ছাড়া বিভিন্ন ‘মাইক্রোবাল হোস্ট ইন্টারেকশন’ কিংবা নানা ধরনের প্যাথোজেনের বিবর্তন বুঝতে পারা কিংবা নতুন ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা সম্ভব হবে না।
আধুনিক বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের সন্তানদের পিছিয়ে রাখতে চাই না, তাই প্যাবোর এই নোবেলপ্রাপ্তির একটি ইতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের বিজ্ঞানচর্চায় আমরা দেখতে চাই। ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। হৃদয় মণ্ডলের মতো বিজ্ঞানের শিক্ষকদের জন্য আরেকটু সহনশীল কাজের পরিবেশ তৈরিতে সোয়ান্তে প্যাবোর সাফল্য আমাদের অনুপ্রাণিত করবে এই প্রত্যাশাই রাখি।
চৌধুরী মুফাদ আহমদ প্রাবন্ধিক