নরেন্দ্র মোদি একমাত্র রাজনীতিক, যিনি প্রায় সিকি শতক ধরে প্রথমে নিজের রাজ্য গুজরাট ও তারপর গোটা ভারতের রাজনৈতিক নিয়ন্তা হয়ে রয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদি একমাত্র রাজনীতিক, যিনি প্রায় সিকি শতক ধরে প্রথমে নিজের রাজ্য গুজরাট ও তারপর গোটা ভারতের রাজনৈতিক নিয়ন্তা হয়ে রয়েছেন।

মোদির বিস্ময়কর উত্থানের সাতকাহন

নির্দ্বিধায় বলা যায়, নরেন্দ্র মোদির মতো এত আলোচিত, সমালোচিত, নন্দিত, নিন্দিত ও বিতর্কিত প্রধানমন্ত্রী ভারত দেখেনি। তাঁর মতো নির্বাচনী সাফল্যও আর কেউ পাননি। রাজ্য ও কেন্দ্রে এমন দাপটের সঙ্গে টানা রাজত্বও কেউ করেননি। তিনিই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, যিনি ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে দুটি শিবিরে ভাগ করে দিয়েছেন। একদিকে অনুগামীসহ বিরাজমান তিনি নিজে, অন্যদিকে বাকি সবাই।

তিনি অনন্যও। অতীতের কোনো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন শুরুর আগেই নিজের জয় ঘোষণা করেননি। সেই নির্ঘোষে যেমন রয়েছে অহংবোধের বিচ্ছুরণ, তেমনই বুঝিয়ে দেয় নিজের ক্ষমতার প্রতি কী অগাধ আস্থা তাঁর। তিনিই একমাত্র রাজনীতিক, যিনি প্রায় সিকি শতক ধরে প্রথমে নিজের রাজ্য গুজরাট ও তারপর গোটা দেশের রাজনৈতিক নিয়ন্তা হয়ে রয়েছেন। এই প্রবাহের গতি আদৌ রুদ্ধ করা সম্ভব কি না, গোটা দেশ আপাতত সেই চিন্তায় বিভোর। রাজনীতিক মোদির সাফল্য এটাই।

জীবনটা সাদামাটা অথচ বিতর্কে ভরা

নিতান্তই সাদামাটা ছিল তাঁর জীবন। সকাল দেখে সারাটা দিন কেমন যাবে বোঝা গেলেও মোদির জীবনের শুরু দেখে কেউ ভাবেনি একদিন তিনি এমন দোর্দণ্ড প্রতাপ রাজনীতিক হবেন। পড়াশোনায় মন ও মতি কোনোটাই তাঁর ছিল না। প্রচলিত কাহিনি সত্য হলে গুজরাটের ভাডনগর স্টেশনে তাঁর বাবার একটা চায়ের দোকান ছিল।

সেখানে তিনি বাবাকে সাহায্য করতেন। তাঁর জীবন ঘিরে বিতর্কের শুরুও ওই পর্ব থেকেই। চা বিক্রেতার সন্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ভারতীয় গণতন্ত্রের সাফল্যের সেরা বিজ্ঞাপন। তিনি নিজেই বারবার সে কথা নানাভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন। অথচ গুজরাটের ভাডনগর স্টেশন, সেই স্টেশনে মোদির বাবার চায়ের দোকান ও সেই দোকানে কিশোর নরেন্দ্রর সাহায্যের হাত বাড়ানোর মতো জনপ্রিয় আখ্যানের কোনো তথ্য ভারতীয় রেলের কাছে নেই! তথ্য জানার অধিকার আইনে প্রশ্ন করা হয়েছিল।

জবাবে ভারতীয় রেল জানিয়েছে, পশ্চিম রেলের আহমেদাবাদ বিভাগের কাছে এই দাবির সমর্থনে কিছু পাওয়া যায়নি। কোনো তথ্যই নেই। স্টেশন চত্বর ও ট্রেনে উঠে চা বিক্রির লাইসেন্স কিশোর নরেন্দ্রকে দেওয়া হয়েছিল কি না, সেই তথ্যও তাদের নেই।

নরেন্দ্র মোদির জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় গবেষণার কাজে ভাডনগর গিয়ে মোদির বাবার চায়ের দোকানের খোঁজ করেছিলেন। তাঁকেও হতাশ হতে হয়েছিল। সেই সময়ে ভাডনগর ছিল ছোট্ট এক জনপদ। মিটারগেজ লাইন ছিল একটা। দিনে একটা কি দুটো ট্রেন দাঁড়াত। সেখানে চায়ের দোকান ছিল কি ছিল না, প্রবীণদের স্মৃতিতে নেই। হতে পারে স্টেশনের ধারেকাছে কোথাও হয়তো ছিল। অকাট্য প্রমাণ নেই। যদিও আজকের ভাডনগর স্টেশনে মোদির বাবার চায়ের স্টল পর্যটকদের আকর্ষণ। প্রচারে অনেক কিছুই হতে পারে।

ছোট্ট ওই জনপদের স্কুলেই মোদির শিক্ষা লাভ। এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে নিজের শিক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, পড়াশোনা বেশি করতে পারেননি। ছোট থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ও স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে পরিব্রাজক হয়ে গৃহত্যাগ। আশ্রয় নিয়েছেন রামকৃষ্ণ মিশনে। যদিও গৃহত্যাগের আগেই দার পরিগ্রহ। মোদির বিয়ে হয়েছিল যশোদাবেনের সঙ্গে।

যশোদাবেনকে প্রকৃত অর্থে স্ত্রীর মর্যাদা কখনো দেননি। আবার আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদের পথেও হাঁটেননি।

বিতর্ক অন্তহীন

বিতর্ক সেখানেও। আর পাঁচজনের মতো বিবাহিত জীবন তিনি কাটাননি। সংসারধর্ম পালন করেননি। যশোদাবেনকে প্রকৃত অর্থে স্ত্রীর মর্যাদা কখনো দেননি। আবার আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদের পথেও হাঁটেননি। রাজ্যস্তরে নির্বাচনী হলফনামায় বিবাহিত জীবন নিয়ে তিনি নীরব থেকেছেন। প্রথম স্বীকারোক্তি ২০১৪ সালে। লোকসভা ভোটের প্রার্থী হওয়ার সময় মনোনয়নপত্রে তিনি প্রথমবার স্ত্রী হিসেবে যশোদাবেনের উল্লেখ করেছিলেন। বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগ এনেছিল। লাভ হয়নি।

এবার ভোটের প্রচারে বিরোধীদের ‘পরিবারতন্ত্রের’ সমালোচনায় মুখর মোদিকে পরিবারকে অবহেলা করার কটাক্ষ শুনতে হয়েছে। তিনি উত্তরে বলেছেন, ‘গোটা দেশ আমার পরিবার। ১৪০ কোটি মানুষ আমার আত্মীয়।’ মোদি সেই বিরল রাজনীতিক, যিনি সমালোচনার তির বিরোধীদের দিকে ঘুরিয়ে দিতে দক্ষ।

ভারতের রাজনীতিতে বিতর্ক ও মোদি যেন সমার্থক। দুটি যেন সমান্তরাল রেললাইন। মোদির শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক আজও অমীমাংসিত। সত্যিই তিনি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী কি না, সরকারি বয়ান সত্ত্বেও সেই সংশয় ঘোচেনি। তিনি নিজেও রা কাড়েননি একটিবারের জন্যও।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সত্যাগ্রহ করে জেলে গিয়েছিলেন বলে দাবি করেও তিনি অহেতুক বিতর্ক আবাহন করেছেন। সেই তথাকথিত সত্যাগ্রহের কোনো প্রমাণ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি! মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সত্যাগ্রহ করে কেন জেলে যেতে হবে সেই প্রশ্নও সংগত; কারণ, ভারতই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ও মদদদার!

মোদিকে ঘিরে সবচেয়ে বড় বিতর্ক অবশ্যই গুজরাট দাঙ্গা। ২০০২ সালের সেই দাঙ্গায় সরকারি হিসেবে নিহত হয়েছিলেন সহস্রাধিক মানুষ, যাঁদের মধ্যে ৭৯০ জন ছিলেন মুসলমান। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যা দ্বিগুণ। মোদি তখন মুখ্যমন্ত্রী। অভিযোগ, দাঙ্গা থামাতে তিনি আদৌ সচেষ্ট হননি; বরং তাঁর সিদ্ধান্ত মুসলমান নাগরিক হত্যায়উসকানি দিয়েছিল।

সেই দাঙ্গার পর ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার মোদির ভিসার আবেদন পর্যন্ত খারিজ করে দিয়েছিল। ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দাঙ্গায় মোদির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়। দুই বছর পর দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় সেই যুক্তরাষ্ট্রই মোদিকে রেড কার্পেট অভ্যর্থনা জানাতে দ্বিধা করেনি। রাজনীতি ও কূটনীতিতে নীতির চেয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থই সব সময় প্রধান বিবেচ্য। বিতর্ক সরিয়ে সেই মোদি এখন পশ্চিমা শক্তির কাছে ‘বিশ্বগুরু’!

মোদি তখন মুখ্যমন্ত্রী। অভিযোগ, গুজরাট দাঙ্গা থামাতে তিনি আদৌ সচেষ্ট হননি; বরং তাঁর সিদ্ধান্ত মুসলমান নাগরিক হত্যায়উসকানি দিয়েছিল।

সাফল্যের নেপথ্য রহস্য

রাজনীতিতে মোদির উত্থান ও নিরন্তর সাফল্যের রহস্য কী? তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, পরিশ্রমী, কঠোর। গণতান্ত্রিক মোড়কের আড়ালে তিনি একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন, ভারতের মতো এত বিশাল, বৈচিত্র্যশীল, বৈষম্যে পূর্ণ এক উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্র সব রোগ হরণের বটিকা হতে পারে না। অতি গণতান্ত্রিকতায় উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়। প্রবৃদ্ধি গতিরুদ্ধ হয়। জনকল্যাণমুখী কাজের সুফল পেতে দীর্ঘকাল দরিদ্র মানুষজনকে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হয়। এমন দেশের জন্য দরকার একজন উন্নয়নকামী একনায়ক। গণতন্ত্রের বর্ম চাপিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে মোদি তাই গোটা দেশে অতি দ্রুত প্রশ্নহীন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই কাজে তিনি যেমন নিপুণভাবে ব্যবহার করেছেন প্রচারমাধ্যমকে, তেমনই ব্রাত্য করে দিয়েছেন গণমাধ্যমকে।

মোদি ভারতের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, যিনি ১০ বছরে একবারের জন্যও সংবাদ সম্মেলন করেননি; যা খুশি প্রশ্ন করার অধিকার কাউকে দেননি। সংসদে সদস্যদের প্রশ্নের জবাব দেননি। ১০ বছর ধরে যা কিছু বলার, যা কিছু শোনানোর, তা তিনি একাই বলেছেন। দেশবাসীকে শুনিয়ে গেছেন। একটিবারের জন্যও কারও কাছে জবাবদিহি করেননি। এইভাবে তিনি গড়ে তুলেছেন এক নতুন সংস্কৃতি।

সেই সংস্কৃতিকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তুলতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন ধর্মের। গুজরাট দাঙ্গা তাঁর মুসলমান বিদ্বেষ স্পষ্ট করে তোলার পর বাকি ছিল নিজেকে হিন্দু হৃদয়ের একচ্ছত্র সম্রাট রূপে জাহির করা। ১০ বছর ধরে সেই চেষ্টা তিনি করে গেছেন প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা লাভের মধ্য দিয়ে। আইনের সাহায্য নিয়ে মীমাংসা করেছেন অযোধ্যা বিতর্কের।

তৈরি হচ্ছে ভব্য রামমন্দির। আইনের সাহায্য নিয়ে তাঁরা এগোচ্ছেন কাশী ও মথুরার ‘মুক্তির’ দিকেও। সেই লক্ষ্য পূরণে তাঁরা রেয়াত করছেন না কেন্দ্রীয় আইনেরও। ৭০ বছর ধরে যেসব প্রতিষ্ঠান স্বকীয়তা রক্ষায় ধীরে ধীরে এগিয়ে নিজস্ব ধ্যানধারণার বশবর্তী হয়ে উঠছিল, অতি দ্রুত সেগুলো গ্রাস করে হিন্দুত্ববাদী চেতনায় আচ্ছন্ন করতে তাঁর সরকার উদ্যোগী।

দেশ পরিচালনায় রাষ্ট্রশক্তি পূর্ণ করায়ত্ত করার তত্ত্ব মোদিই প্রথম অনুধাবন করেছেন। ফলে এই মুহূর্তে দেশে এমন একটিও প্রতিষ্ঠান নেই, যা নিজের ইচ্ছায় পরিচালিত। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি), সিবিআই, আয়কর বিভাগ, জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ), সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন (সিভিসি), কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটি আজ তাই বিরোধী নজরে ‘খাঁচাবন্দী তোতা’! কিছুটা বাধা শুধু সুপ্রিম কোর্ট।

সেটুকুই বিরোধীদের একমাত্র আশা ও ভরসার জায়গা। সেখানে পূর্ণ ক্ষমতা করায়ত্ত করতে মোদি সরকারের চেষ্টার অন্ত নেই। বিচারপতি নিয়োগের অংশীদার হতে সরকার মরিয়া। এই লড়াই বিচার বিভাগ কত দিন লড়তে পারবে, নিজেদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ চরিত্র কতকাল বজায় রাখতে পারবে, সেই সন্দেহে বহু মহল আচ্ছন্ন।

মোদি জানেন, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তখনই প্রশ্নাতীত হয়, যখন প্রতিটি রাষ্ট্রযন্ত্র অনুগত ভৃত্য হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বকীয়তা হারিয়ে নেতার মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি সেই প্রশ্নাতীত সাফল্য উদ্‌যাপন করছেন। নির্বাচন কমিশনকে কুক্ষিগত করতে যেভাবে আইন প্রণয়ন করে এতকালের রীতি বিসর্জন দিলেন, কমিশন সদস্যদের মনোনয়নপ্রক্রিয়া থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ভূমিকা ছেঁটে ফেললেন, তা নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্থাপনের সর্বশেষ উদাহরণ।

এই দম্ভ ও কর্তৃত্ব তিনি দেখাতে পারছেন গণতন্ত্রের কল্যাণেই। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দৌলতে। কিন্তু ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ পর্বে ধাপে ধাপে গণতন্ত্রকেই তিনি বিসর্জন দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার চোখে আজ তাই তাঁর দেশ ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে পরিচিত। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় চেষ্টার কোনো ত্রুটি তিনি রাখেননি। চাণক্যের ‘সাম দাম দণ্ড ভেদ’ নীতির সার্থক প্রয়োগের মাধ্যমে সবাইকে হতবাক করেছেন। ভিন্নমত তাঁর দুচক্ষের বিষ। তা সে দলের অভ্যন্তরে হোক অথবা বাইরে। ওই নীতির প্রয়োগে তিনি বিরুদ্ধ স্বর কীভাবে প্রশমিত করেছেন, তার অগুনতি উদাহরণ চতুর্দিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে।

রাজনৈতিক এই সাফল্য অবশ্যই মোদি উপভোগ করছেন। সংকটের ছিটেফোঁটা মেঘও তিনি দেখছেন না বিরোধীকুলের ছন্নছাড়া হালের দরুন। বিরোধীদের এভাবে ছাড়া-ছাড়া রাখার কৃতিত্বও তাঁর প্রাপ্য। রাজনীতি তাঁর সংজ্ঞায় যুদ্ধ। আর কে না জানে ভালোবাসা ও যুদ্ধে সবকিছুই জায়েজ! চোরের ধর্ম চুরি করা, গৃহস্থের ধর্ম ঘরের আগল ঠিক রাখা। গৃহস্থ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তার দায় চোরের ওপর বর্তানো ঠিক যুক্তি হতে পারে না। ভারতের বিরোধীদের অপদার্থতায় মোদির কৃতিত্ব ম্লান হতে পারে না।

‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?’

অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এই সাফল্যের ঢক্কানিনাদ আরও কত দিন ফলদায়ী হবে, সেই প্রশ্ন মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। অর্থনীতির চাকচিক্য যতটা ওপর ওপর, ততটাই অগভীর। ভারতকে তিনি বিশ্বের পঞ্চম অর্থনৈতিক শক্তি করে তোলার কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন, কিন্তু সেটা সত্যের একটি দিক। মুদ্রার অন্য পিঠে রয়েছে মাথাপিছু আয়ের নিরিখে বিশ্বে ১৩১ নম্বর দেশ হিসেবে ভারতের অবস্থান। দেশের বিশালত্ব ও ১৪০ কোটি মানুষের বাজারের দরুন মোট জাতীয় উৎপাদন ভারতকে পঞ্চম অর্থনীতির শিরোপা দিল কি দিল না, তার চেয়ে বড় কথা জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়ল কি না। গরিব মানুষের ব্যয় ক্ষমতা বাড়ছে না কমছে। দুটি মানদণ্ডেই মোদির ভারত দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। কিন্তু তাতে কী? নিরন্তর প্রচার তো মোদি মাহাত্ম্যেরই?

বেহাল অর্থনীতি, বেকারত্বের বহর, মাত্রাছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, সামাজিক বৈষম্যজনিত অসন্তোষ, সাম্প্রদায়িক রেষারেষি কবে কীভাবে মোদির পরীক্ষা নেবে, কারও জানা নেই। ভোট বাক্সে আদৌ তার প্রতিফলন ঘটবে কি না, জানা নেই তা–ও। যদিও এখন আর গোপন নয় যে পররাষ্ট্রনীতি ঘিরে রীতিমতো প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী নীতি নিয়ে। নেপাল ও মালদ্বীপে সরাসরি এবং শ্রীলঙ্কায় কিছুটা রাখঢাক রেখে চীন তার প্রভাব দিন দিন বাড়িয়ে চলেছে।

চুক্তি সইয়ের ৫০ বছর পর ২ বর্গকিলোমিটারের কম জনমানবহীন কচ্চতিভু দ্বীপ শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া নিয়ে মোদি যা করলেন, তা–ও বিস্ময়ের অতীত! তামিলনাড়ুতে লোকসভা নির্বাচনে মাত্র কয়েকটি আসন প্রাপ্তির আশায় নিজের দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে ভূলুণ্ঠিত করা কূটনীতির ইতিহাসে জ্বলজ্বল করবে! ভুটান এখনো চীনের চাপে সেই অর্থে মাথা নোয়ায়নি। কিন্তু ডোকলাম–পরবর্তী পরিস্থিতিতে বেইজিংকে থিম্পু কত দিন আটকে রাখতে পারবে, সাউথ ব্লকেই সে বিষয়ে ঘোর সন্দেহ রয়েছে।

প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশই ভারতের একমাত্র বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ। দুই দেশই তা প্রকাশ্যে বারবার বলে আসছে। গত ১০ বছরে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে দুই দেশ তাদের সহযোগিতার বহর বাড়ায়নি। পারস্পরিক নির্ভরতাও বেড়ে চলেছে নিত্য। তা হলে কেন ওই বন্ধু দেশের একাংশের ভারতবিদ্বেষ এভাবে মাথা তুলছে? কেন সেখানে মালদ্বীপের মতো ‘ইন্ডিয়া বয়কট’ স্লোগান শোনা যাচ্ছে? ভারতীয় পণ্য বর্জনের হাঁক দেওয়া হয়েছে? নরেন্দ্র মোদি কখনো কি তা ভেবে দেখা প্রয়োজন মনে করেছেন?

সাফল্য বহু ক্ষেত্রে মানুষকে অন্ধ করে তোলে। স্বৈরতন্ত্রীদের তো অবশ্যই। নরেন্দ্র মোদি অন্ধ সেজে থাকতেই পারেন, তবে সে জন্য প্রলয় কিন্তু বন্ধ থাকবে না।

  • সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি