পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রধান এবং একজন পরিচালককে সরকার চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। আইএমইডির বরখাস্ত হওয়া প্রধান অতিরিক্ত সচিব এস এম হামিদুল হককে বরখাস্ত করা হয় বৃহস্পতিবার এবং পরিচালক উপসচিব মাহিদুর রহমানকে বরখাস্ত করা হয় তার দুদিন আগে। এর আগে তাঁদের দুজনকেই দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি (কার্যত দপ্তরবিহীন) করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। তাঁদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশে বলা হয়েছে, এটি ‘অসদাচরণের’ অভিযোগে নেওয়া বিভাগীয় ব্যবস্থার অংশ।
কিন্তু অসদাচরণের কোনো বিবরণ সরকারি প্রজ্ঞাপনে নেই। তবে আমরা অনুমান করতে পারি। তাঁরা তাঁদের ওপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পেশাদারি ও নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন, রাজনৈতিক সরকারের রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতি, কিংবা অন্য কোনো স্বার্থগোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনায় তাতে তথ্য লুকানো বা কল্পকাহিনি রচনা করেননি। বস্তুত রাষ্ট্রীয় স্বার্থের প্রতি আনুগত্যের কারণে শতভাগ ‘বিদ্যুতায়িত দেশে’ বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ যে একটি ‘লুটেরা মডেল’, সেই সত্য তুলে ধরেছেন।
‘বিদ্যুৎ সেক্টরভুক্ত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতিবিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন’ শিরোনামের মূল্যায়ন তাঁরা পরিকল্পনা কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছিলেন সংবাদপত্রে খবর হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে। তখন সরকারের মনে হয়নি যে সেটি একটি ইংরেজি দৈনিকের বাংলা সংস্করণে প্রকাশিত নিবন্ধ। একাধিক ইংরেজি ও বাংলা দৈনিকে ওই মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে খবর প্রকাশিত হয় জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে। তার আগে পত্রিকাগুলোর অর্থনীতিবিষয়ক প্রতিবেদকেরা প্রধানত বাজেট নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। প্রথম আলোয় ‘বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ একটি “লুটেরা মডেল”’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনের সারাংশ নিয়ে সংবাদ বেরোয় ৯ জুলাই।
এরপর আইএমইডির ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদনটি সরিয়ে ফেলে সংবাদমাধ্যমে একটি প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে দাবি করা হয়, ভুলবশত একটি ইংরেজি পত্রিকার বাংলা নিবন্ধ তাঁদের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সরকারি চাকরির বিধিমালার কারণে পরিহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, ওই প্রতিবেদন যিনি রচনা করেছিলেন, সেই মাহিদুর রহমানকেই প্রতিবাদলিপিটি সই করে সংবাদমাধ্যমে পাঠাতে হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর চাকরি রক্ষা হলো না।
আমরা জানি না হামিদুল হক ও মাহিদুর রহমানের সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্তে তাঁদের প্রতিবেদনের কারণে ক্ষুব্ধ কোনো গোষ্ঠীর ভূমিকা আছে কি না। তবে সরকারের যাঁরা দায়মুক্তি ভোগ করছেন, তাঁরাও যে তাঁদের শিক্ষা দিতে উদ্যোগী হতে পারেন, সেই বাস্তবতাও উপেক্ষণীয় নয়। তাঁরা যে কর্তব্যনিষ্ঠ ও দেশের স্বার্থের জন্য দায়িত্ব পালনের খেসারত দিচ্ছেন না, এটা মোটামুটি স্পষ্ট। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে তাঁদের সমর্থনে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন এগিয়ে আসেনি, তেমনই নাগরিক সমাজেরও তেমন কোনো জোরালো প্রতিবাদ চোখে পড়ে না। আর তাঁদের যে সরকারি কর্মকর্তাদের সমিতি, তারাও তো এখন রাজনৈতিক দূষণের শিকার।
অসদাচরণ যদি সত্যিই কিছু তাঁরা করে থাকেন, তার বিচারে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু, জনসমক্ষে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত ও ঘটনাক্রমে তাঁদের কোনো অসদাচরণের প্রমাণ মেলে না, বরং রাজনৈতিক ও দুর্বৃত্তায়নের অর্থনীতির গোষ্ঠীতন্ত্রের প্রতিশোধের আলামত দেখতে পাওয়া যায়। যাঁদের মাথা থেকে বিষয়টি আড়াল করা ও রাজনৈতিক ক্ষতি সামাল দেওয়ার বুদ্ধি এসেছে, তাঁরা সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন যে ইন্টারনেটে কোনো নথি প্রকাশ পেলে, তা উঠিয়ে নিলেই সেটা হারিয়ে যায় না। প্রায় দেড় সপ্তাহ যে প্রতিবেদন অনলাইনে ছিল, তা কত শত বা হাজার জন প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ডাউনলোড করে রেখেছেন, তার রেকর্ড তাঁরা চাইলেই জেনে নিতে পারতেন।
৫৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি পড়লে কেউ কোথাও সামান্যতম অসংগতি পাবেন না। কোনো পত্রিকার অনলাইনে এত দীর্ঘ এবং পরিসংখ্যানসমৃদ্ধ নিবন্ধ ছাপা হয় না। বোঝাই যায়, এটি সাধারণ পাঠকের জন্য তৈরি নয়, বরং বিদ্যুৎ খাত নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, সেসব বিশেষজ্ঞের জন্য রচিত। তথ্যসূত্র হিসেবে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ-সম্পর্কিত সামগ্রিক মূল্যায়ন, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের সমিতি ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে (আইপিপিএ) বহুজাতিক নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান
প্রাইসওয়াটারহাউস কুপারসের বাংলাদেশর বিদ্যুৎ খাতের রূপান্তরবিষয়ক প্রতিবেদন, সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা, আইএমইডির বিভিন্ন সমীক্ষা প্রতিবেদন এবং আইএমইডির বিভিন্ন পরিদর্শন প্রতিবেদনের কথা এতে উল্লেখ করা আছে।
আইএমইডির সেই বহুল আলোচিত প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ খাতের প্রতিটি সংস্থার বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের আর্থিক ব্যয় ও ভৌত কাঠামোর অগ্রগতির হিসাব যেমন আছে, তেমনই সংস্থাওয়ারি গৃহীত প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থার মূল্যায়নও তুলে ধরা হয়েছে। গত ৬ জুনের হিসাব উদ্ধৃত করে অঞ্চল ভিত্তিতে উৎপাদনে থাকা প্রতিটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের সক্ষমতা এবং বাস্তব উৎপাদনের ফারাকের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। খুঁটিনাটি পরিসংখ্যানে ঠাসা প্রতিবেদনকে পত্রিকার নিবন্ধ বলে দাবি করার হাস্যকর প্রচেষ্টায় স্পষ্টতই বোঝা যায় যে বিদ্যুৎ খাতের প্রকৃত চিত্র কতটা হতাশাজনক। তাদের পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণে ‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ কথাটা প্রমাণিত হওয়ায় সরকারের তরফে তথ্যগুলো খণ্ডনের কোনো চেষ্টাই করা হয়নি।
প্রতিবেদনের তিনটি অংশ সরকারের সবচেয়ে বেশি মর্মজ্বালা ঘটিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে অযৌক্তিক অপচয়, বিদ্যুৎ খাতকে চীন ও ভারতীয় সরবরাহকারীদের পুনর্বাসনকেন্দ্র বানিয়ে ফেলা এবং দায়মুক্তির আইন করে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন মডেলকে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া। ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে গত ১৪ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলার গচ্চা গেছে হিসাব দিয়ে প্রতিবেদনে একে লুটেরা মডেল অভিহিত করে বলা হয়েছে, ক্যাপাসিটি চার্জের বর্তমান মডেল কোনোভাবেই টেকসই নয়।
সরকারি প্রতিবাদপত্রে ৯০ হাজার কোটি টাকার পরিমাণের যথার্থতা নিয়ে যেমন কোনো প্রশ্ন করা হয়নি, তেমনই দেশীয় উৎপাদকদের বৈদেশিক মুদ্রা ডলারে মূল্য পরিশোধের জাতীয় স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্তেরও কোনো ব্যাখ্যা নেই। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পিডিবি আগে বছরে যে পরিমাণ লোকসান গুনত এখন দুই মাসে সেই পরিমাণ লোকসান করার যে হিসাব এতে দেওয়া হয়েছে, তা কেন প্রতিবাদলিপিতে খণ্ডন করা হয়নি? কারণ, এ হিসাব খণ্ডনযোগ্য নয়। ক্যাপাসিটি চার্জের সুবিধা যাঁরা ভোগ করছেন, তাঁদের প্রতাপ-প্রতিপত্তির কথা সবারই জানা। ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতির ক্ষমতাবলয়ে প্রভাবশালী এ গোষ্ঠীর কাছে লুটেরা মডেল কথাটা যে পছন্দ হবে না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিদ্যুৎ খাত চীনা ও ভারতীয় সরবরাহকারীদের পুনর্বাসন ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ানোর বিষয়ে অবশ্য প্রতিবেদনে বিশদ কিছু নেই। তবে বিদ্যুৎ খাতে চীনা সরবরাহকারী ও ঠিকাদারেরা কতটা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত, তা সবারই জানা। একইভাবে রামপালের ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং আদানির মালিকানাধীন প্রকল্প নিয়েও জনপরিসরে কম বিতর্ক হয়নি। রামপালের উন্নত প্রযুক্তির কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পে শুরু থেকেই যেসব কারিগরি সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে তার যথার্থতা নিয়ে সন্দিহান হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। আদানির গোড্ডা প্রকল্প নিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল কয়লা ও বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি উচ্চমূল্য। দেশ-বিদেশে সমালোচনা ও বিতর্কের পটভূমিতে এখন আদানি গোষ্ঠী বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম কমাতে রাজি হয়েছে, যার ফলে মাসে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে খবর দিয়েছে শেয়ারবিজ পত্রিকা (পায়রা-রামপালের চেয়ে জ্বালানি বিল কম রাখবে আদানি, ১২ জুলাই ২০২৩)।
১৫ জুলাই গৌতম আদানি ঢাকায় সংক্ষিপ্ত এক সফরে এসে গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুরো সক্ষমতায় উৎপাদন বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন বলে সেদিন এক টুইটে জানিয়েছেন। আদানি এখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে একজন বড় সরবরাহকারী। বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি ভারতের ক্ষমতা কাঠামোয় গৌতম আদানির প্রভাব বিশ্বজুড়েই সুবিদিত। শ্রীলঙ্কায় কলম্বো ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের প্রধান সে দেশে আদানি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রভাব খাটানোর কথা পার্লামেন্টারি কমিটিতে প্রকাশ করার কারণে বরখাস্ত হয়েছিলেন। যদিও দুই দেশের সরকার প্রভাব খাটানোর কথা অস্বীকার করেছিল।
আমরা জানি না হামিদুল হক ও মাহিদুর রহমানের সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্তে তাঁদের প্রতিবেদনের কারণে ক্ষুব্ধ কোনো গোষ্ঠীর ভূমিকা আছে কি না। তবে সরকারের যাঁরা দায়মুক্তি ভোগ করছেন, তাঁরাও যে তাঁদের শিক্ষা দিতে উদ্যোগী হতে পারেন, সেই বাস্তবতাও উপেক্ষণীয় নয়। তাঁরা যে কর্তব্যনিষ্ঠ ও দেশের স্বার্থের জন্য দায়িত্ব পালনের খেসারত দিচ্ছেন না, এটা মোটামুটি স্পষ্ট। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে তাঁদের সমর্থনে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন এগিয়ে আসেনি, তেমনই নাগরিক সমাজেরও তেমন কোনো জোরালো প্রতিবাদ চোখে পড়ে না। আর তাঁদের যে সরকারি কর্মকর্তাদের সমিতি, তারাও তো এখন রাজনৈতিক দূষণের শিকার।
● কামাল আহমেদ সাংবাদিক