নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পরও একানব্বইয়ের নির্বাচনে দলটি এককভাবে নির্বাচন করে ৩৫টি আসন পেয়েছিল। দলের প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কারাগারে থেকেও পাঁচটি আসনে জয়ী হয়েছিলেন। এর পর থেকেই থেকেই জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ও ভাটির টান শুরু হয়।
১৯৯৬ সালের (১২ জুন) নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩১টি, ২০০১ সালের নির্বাচনে ১৪টি, ২০০৮ সালের মহাজোটের শরিক হিসেবে ২৭টি, ২০১৪ সালে ২৬ ও ২০১৮ সালে ২২টি আসন পায়। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দলটি ২৬টি আসন সমঝোতা করে মাত্র ১১টি আসনে জয়লাভ করে।
একদা জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত রংপুর এখন প্রায় জাতীয় পার্টি শূন্য। রংপুরে জাতীয় পার্টি একটি আসন পেয়েছে, ‘হারাধনের একটি ছেলে’—জিএম কাদের।
জাতীয় পার্টির এই ভরাডুবির কারণ কী? প্রথমত, নেতৃত্বের হঠকারিতা ও দোদুল্যমানতা। বছর দুই আগে থেকে জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব দলীয় নেতা-কর্মী ও দেশবাসীকে এমন আভাস দিয়ে আসছিল যে জাতীয় পার্টি সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে যাবে না।
আর গেলেও এককভাবে নির্বাচন করবে। তাদের অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে সমদূরত্ব। এমনকি জাতীয় সংসদে দলের কোনো কোনো নেতা গরম বক্তৃতা দিয়ে বাজিমাত করারও চেষ্টা করেছে।
কিন্তু যে দলের সঙ্গে সুবিধাবাদ জন্মদাগ হিসেবে চিহ্নিত, সেই দল নীতি আদর্শের কথা বললে মানুষ বিশ্বাস করে না। দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের আওয়ামী লীগকে স্বৈরাচারী বলে অভিহিত করেছেন। পত্রিকায় নিবন্ধও লিখেছেন। কিন্তু নির্বাচনের কয়েক মাস আগে দিল্লি সফরের পরই তার সুর পাল্টে যায়।
দলের সর্বশেষ বর্ধিত সভায় ২৭ প্রতিনিধির মধ্যে ২৫ জনই আওয়ামী লীগের অধীন নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এর দুদিন পরই ঘোষণা এল জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে।
এরই মধ্যে দলে রওশনপন্থী ও কাদেরপন্থীদের বিরোধ মীমাংসার বাইরে চলে যায়। একপর্যায়ে রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের চিঠি দলীয় প্রার্থীদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার পর রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একাংশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ২৬টি আসন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আদায় করেন।
নির্বাচনের আগে কাদেরপন্থীরা রওশনপন্থীদের দল থেকে পত্রপাঠ বিদায় করতে সক্ষম হলেও দলের ভরাডুবি ঠেকাতে পারেননি। এ অবস্থায় নেতা-কর্মীরা দলীয় চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের পদত্যাগ এবং নতুন কাউন্সিল করার দাবি জানান।
প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, নির্বাচনে জাতীয় পার্টির (জাপা) ভরাডুবির দায়িত্ব নিয়ে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হকের (চুন্নু) পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ করেছেন দলটির একদল নেতা-কর্মী।
দলের পরাজিত কয়েক প্রার্থীর নেতৃত্বে এই নেতা-কর্মীরা বুধবার ঢাকায় দলীয় কার্যালয়ে এই বিক্ষোভ থেকে জাপার শীর্ষ দুই নেতাকে পদত্যাগের জন্য ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছেন। জাপার বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের সামাল দিতে দলীয় অফিসে পুলিশ ডাকতে হয়েছে।
জাপার অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে জাতীয় পার্টিকে পারিবারিককরণ, মনোনয়ন-বাণিজ্য ও দুর্বল নেতৃত্বের অভিযোগ তোলেন। লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের গত চার বছর তাঁর সাংগঠনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতায় দলকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছেন।
নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটছে। জাতীয় পার্টির দুই শতাধিক প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন।
সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে মাত্র ২৬টি আসনে সমঝোতা করে নির্বাচনে গেলেও সেখানে ভরাডুবি হয়েছে। নেতা-কর্মীদের প্রত্যাশা ছিল, এ ব্যর্থতার দায় নিয়ে চেয়ারম্যান ও মহাসচিব তাঁদের সম্মান রক্ষা করে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন। কিন্তু তাঁদের বোধোদয় হয়নি। এখন দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী তাঁদের অপসারণ চান।
নির্বাচনের পরও জাতীয় পার্টির দোদুল্যমানতা কাটেনি। নেতারা একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নেন। দলের মহাসচিব প্রথমে বললেন, তাঁরা বুধবার শপথ নিচ্ছেন না। পরে শপথের তারিখ জানাবেন। কয়েক ঘণ্টা পর জানালেন, বুধবারই শপথ নিচ্ছেন দলের সদস্যরা।
দুপুর ১২টার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের শপথকক্ষে তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করান একাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
গত তিন নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জিতেছে আওয়ামী লীগের দয়ায়। এবারও তারা দর-কষাকষি করে ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে। কিন্তু এসব আসনে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রত্যাহার করলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী থেকে যায়। ফলে জাতীয় পার্টির পক্ষে জয়ী হওয়া কঠিন ছিল।
কমসংখ্যক আসনে দলীয় প্রার্থীদের জয়ে হতাশার পাশাপাশি বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় পার্টিতে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬ আসনে সমঝোতার পরও ভোটের ফলাফলে তার প্রতিফলন না থাকায় দলের একটি অংশ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ।
নির্বাচনে বিপর্যয় নিয়ে দলে নানামুখী আলোচনা চলছে। নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশের বক্তব্য হচ্ছে, এবার নির্বাচনে যাওয়াই ঠিক হয়নি। দলের পরাজিত ও নির্বাচন থেকে সরে আসা প্রার্থীদের অভিযোগ, মনোনয়ন দেওয়ার পর দলের নেতৃত্ব তাঁদের খোঁজ নেননি।
নিজের আসন ছাড়া তাঁরা কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রচারও করেননি। প্রত্যেক প্রার্থীকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি।
দলের শীর্ষ নেতৃত্বসহ অনেক নেতার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। সরকার-নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হয়েছে। ফলাফল ছিল অনেকটাই নির্ধারিত। আবার কেউ কেউ মনে করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপার আসন সমঝোতা সঠিক ছিল না।
যে দুজন নেতাকে সমঝোতার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাঁরা দলীয় স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আসন থেকে জাপাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার একটি আসনে দলের জিএম কাদের স্ত্রী শেরিফা কাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারিয়েছেন।
গত তিন নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জিতেছে আওয়ামী লীগের দয়ায়। এবারও তারা দর-কষাকষি করে ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে। কিন্তু এসব আসনে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রত্যাহার করলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী থেকে যায়। ফলে জাতীয় পার্টির পক্ষে জয়ী হওয়া কঠিন ছিল।
যেকোনো রাজনৈতিক দল চলে নীতি, আদর্শ কর্মসূচির ভিত্তিতে। জাতীয় পার্টি নীতি-আদর্শ অনেক আগেই বিসর্জন দিয়েছিল। কর্মীদের উজ্জীবিত রাখার জন্য যে কর্মসূচি থাকার কথা, তা-ও তাদের ছিল না।
২০০৮ সাল থেকে তারা আওয়ামী লীগের কৃপাতেই মন্ত্রী-সংসদ সদস্য ও বিরোধী দলের নেতা হয়েছেন।
নতুন সংসদে বিরোধী দল হওয়ার মতো সদস্য জাতীয় পার্টির নেই। তাদের মোট সদস্যসংখ্যা ১১, সংরক্ষিত নারী আসনে আরও দুটি সদস্য তারা পেতে পারে।
অন্যদিকে স্বতন্ত্র সদস্যসংখ্যা ৬২। তাঁরা মিলে কোনো গ্রুপ করলে জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হওয়ার খোয়াব অপূর্ণই থেকে যাবে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com