২৫ আগস্ট বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্তের জন্য একটা কালো দিন। পাঁচ বছর পূর্ণ হলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ আগমনের। পাঁচ বছর অনেক লম্বা সময়। কিন্তু আজও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যায়নি।
তাদের প্রতি গণ-অবিচারের বিচারও শেষ হয়নি। সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় আছে তাদের পুনর্বাসন, কাজ ও শিক্ষার বিষয়। ইতিমধ্যে মিয়ানমারে লেগেছে গৃহযুদ্ধের আগুন। আরাকানেও ঘটেছে গেরিলাযুদ্ধের ব্যাপক বিস্তার। দুর্ভাগ্যের পঞ্চম বছরে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের একত্রে বসে আহাজারির অবস্থাও নেই। ভাসানচর ও কক্সবাজারজুড়ে বিভক্ত তারা।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বিশ্বের মনোযোগও বেশ কমে গেছে। মিয়ানমারের মূল গৃহযুদ্ধের আঁচ রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি আরাকানে কম হলেও রাখাইনদের সশস্ত্রতায় পুরো প্রদেশে যুদ্ধাবস্থা চলছে। রোহিঙ্গারা যে অবস্থায় উত্তর আরাকান ছেড়ে এসেছিল, এখনকার অবস্থা সে রকম নেই।
মাটি কামড়ে পড়ে থাকা ওখানকার অবশিষ্ট চার থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার ওপর যদিও নিপীড়ন নতুন করে বাড়েনি, কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আরাকানজুড়ে এখন পরিস্থিতির নতুন ‘নায়ক’ আরাকান আর্মি।
অনেক গ্রাম এলাকা তারা নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের মা–বাবার ঠিকানায় ফেরত যেতে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় রাখাইন আরাকান আর্মির সঙ্গেও বোঝাপড়া লাগবে। কিন্তু কীভাবে, কার মাধ্যমে সেসব হবে? গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিকভাবে গুছিয়ে ওঠা বা গুছিয়ে তোলার কোনো উদ্যোগ ছিল না। উল্টো রহস্যময় সন্ত্রাসী হামলায় ক্রমাগত মরছে ক্যাম্পবাসী প্রভাবশালী রোহিঙ্গা নেতারা।
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর দর-কষাকষিতেও গত পাঁচ বছরে অগ্রগতি ঘটেনি। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুই দফা ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল কেবল। অতীতের মতো বাংলাদেশ এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ‘বন্ধু’দের মুখাপেক্ষী হয়ে আছে। মিয়ানমারের শাসকদের মন নরম করতে চীনের সহায়তার ওপর এখনো ঢাকার বড় ভরসা। কিন্তু চীন বাংলাদেশের স্বার্থে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি ঘটাতে পারেনি।
আবার চীন এবং মিয়ানমার জান্তা চাইলেও আরাকান আর্মির মতামত ও সম্মতি এ বিষয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন পরিস্থিতিতে। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মুরব্বির ভূমিকাতেও বাংলাদেশের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক কিছু নেই আপাতত।
প্রতিবছর ক্যাম্পে নতুন করে ৩০ হাজার শিশু যুক্ত হচ্ছে। বিয়েও হচ্ছে ব্যাপক হারে। এভাবে নতুন-পুরোনো মিলে প্রতিদিন বাড়তে থাকা এই জনগোষ্ঠী দক্ষিণ সীমান্তের জনমিতির ঘনত্বে নতুন মাত্রা যোগ করছে ক্রমে। পাহাড়ি ধাঁচের জনপদে এত বড় জনগোষ্ঠীকে ফটক বসিয়ে আটকে রাখা দুরূহ। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে ভাষা ও শরীরী গঠনে মিল থাকায় কক্সবাজারজুড়ে স্থানীয় সমাজে রোহিঙ্গাদের মিলেমিশে যাওয়ায় প্রতিবন্ধকতা কম। অনেকে কাজকর্মের সূত্রে নিয়মিত ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছে। ক্যাম্পেও ছোটখাটো ব্যবসায়ের প্রসার বাড়ছে।
রোহিঙ্গা প্রশ্নে বিগত সময়ে একমাত্র ইতিবাচক ঘটনা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচার শুরু হওয়া। মিয়ানমার অনেক চেষ্টা করেও এ বিচার থামাতে পারেনি।
তবে এ বিচার শেষ হতে অনেক বছর লাগবে বলেই মনে হয়। বাংলাদেশ আইসিজের এ বিচারে অনানুষ্ঠানিক নীরব এক পক্ষ—কারণ, ক্ষতিগ্রস্তরা তার আশ্রয়ে আছে। ইউরোপ-আমেরিকার মানবাধিকারকর্মীরা বরাবরই মনে করেছেন, মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচারের আন্তর্জাতিক এ আয়োজনে বাংলাদেশের আরও সবল ও সাহসী অবস্থান নেওয়ার সুযোগ ছিল এবং আছে।
এ বিচার আন্দোলনের আকর্ষণীয় এক সংযোজন হলো মিয়ানমারের প্রধান রাজনৈতিক দল এনএলডি এখন মনেপ্রাণে জেনারেলদের শাস্তি কামনা করছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি তঁাদের মনোভাবেও বদল ঘটেছে।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের সহায়তার পরিমাণ কমতে শুরু করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য নতুন বিপদের দিক। তবে কক্সবাজার ও ভাসানচরজুড়ে থাকা রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও পুনর্বাসনে বাংলাদেশের মনোযোগ দরকার বলে মনে করছেন অনেক শরণার্থীবিশেষজ্ঞ।
কাজকর্মের চাপ ও তাগিদ না থাকায় এবং তরুণেরা শিক্ষাবঞ্চিত হওয়ার পরোক্ষ ফল হিসেবে ক্যাম্পগুলোয় সন্ত্রাস বাড়ছে ক্রমে। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন ক্যাম্পে নানান কায়দার পাল্টাপাল্টি হামলায় নিহত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় দেড় শ ছুঁয়েছে। বলা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এখন আর রোহিঙ্গাদের জন্য পুরো নিরাপদ নেই। ছোট ছোট সন্ত্রাসী বাহিনী কাজ করছে বিভিন্ন ক্যাম্পে।
সন্ত্রাস কমাতে ক্যাম্পগুলোয় কাঁটাতারের যে বেড়া দেওয়া হয়, সেটা রোহিঙ্গাদের মুক্ত চলাচলে সামান্যই বাধা দিতে পারছে; বরং অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাংলাদেশ এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুর্নামের ভাগী হয়েছে। ব্যবস্থাপনার এ মৃদু দুর্নাম আশ্রয় দেওয়ার বিপুল সুনামের চেয়ে সামান্য হলেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিয়ে ক্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে বলেই সাক্ষ্য মেলে।
প্রতিবছর ক্যাম্পে নতুন করে ৩০ হাজার শিশু যুক্ত হচ্ছে। বিয়েও হচ্ছে ব্যাপক হারে। এভাবে নতুন-পুরোনো মিলে প্রতিদিন বাড়তে থাকা এই জনগোষ্ঠী দক্ষিণ সীমান্তের জনমিতির ঘনত্বে নতুন মাত্রা যোগ করছে ক্রমে। পাহাড়ি ধাঁচের জনপদে এত বড় জনগোষ্ঠীকে ফটক বসিয়ে আটকে রাখা দুরূহ। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে ভাষা ও শরীরী গঠনে মিল থাকায় কক্সবাজারজুড়ে স্থানীয় সমাজে রোহিঙ্গাদের মিলেমিশে যাওয়ায় প্রতিবন্ধকতা কম। অনেকে কাজকর্মের সূত্রে নিয়মিত ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছে। ক্যাম্পেও ছোটখাটো ব্যবসায়ের প্রসার বাড়ছে।
ক্যাম্পের ভেতরের রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে অনেক। ফিরে যাওয়ায় যত দেরি হবে, তত এসব ক্যাম্প আজকের বাসিন্দাদের মূল ঠিকানা হয়ে যাওয়ার শঙ্কা অনেককে ভাবাচ্ছে। তবে এর মধ্যেই রোহিঙ্গা তরুণেরা ‘বাড়ি চলো’ নামে নতুন এক আন্তদেশীয় আন্দোলনের ডাক দিয়েছে ২০ জুন থেকে।
২০২১ সালে উখিয়ায় খুন হওয়ার আগে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মহিবুল্লাহ এ রকম এক আন্দোলনের কৌশল নিয়ে কাজ করছিলেন। তাঁর সহযোগী অনেকে এখন সেই উদ্যোগ নিয়ে এগোতে আগ্রহী। কিন্তু বাংলাদেশের নীতিগত মদদ ছাড়া কীভাবে তারা এগোবে? রোহিঙ্গাদের পাশে আর কে আছে?
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক