আস্থার ঘাটতি এবং আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

আপনাকে অবশ্যই মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে, অন্যথায় জীবন অসম্ভব হয়ে যাবে: আন্তন চেখভ

দেশ পরিচালনার একটি মৌলিক নীতি হলো দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো এবং যাঁরা সেগুলো পরিচালনা করেন, তাঁদের প্রতি জনগণের আস্থা প্রতিষ্ঠা ও তা বজায় রাখা। আস্থার অভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। সংসদ, বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও আমলাতন্ত্রের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা থাকে যতক্ষণ তারা তাদের আচরণে সৎ, শাসনে নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন মেনে চলার ক্ষেত্রে কঠোর থাকে। এসব গুণাবলি একটি ভালো সরকার, ভালো নেতা ও একটি ভালো জাতির বৈশিষ্ট্য।

দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বের কোনো দেশই শাসনে শ্রেষ্ঠত্বের রোলমডেল বলে দাবি করতে পারে না, তবে বেশির ভাগ দেশই সুশাসনের ন্যূনতম মান বজায়ের লক্ষ্যে থাকে। এ কারণেই গণতন্ত্র চর্চাকারী দেশগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ অর্জনের জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। তবে প্রায়ই তারা ব্যর্থ হয়, কারণ তারা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে না এবং লোকেরা পরের রাউন্ডে তাদের ফেলে দিয়ে নতুন দলকে তাদের স্থানে বসায়। চক্রটি নতুনভাবে শুরু হয়। এভাবেই গণতন্ত্র কাজ করে।

যেসব দেশে জনগণের সার্বভৌমত্ব, আইনের শাসন ও সুশাসনের নীতি অনুসরণ করা হয়, সেখানে লিখিত ও অলিখিত—উভয় নিয়ম রয়েছে; যা কিছু সীমা নির্ধারণ করে, যা একটি সরকারের সামনে রাখা উচিত এবং মেনে চলা উচিত। এগুলোর মধ্যে আছে সরকারি কর্মচারী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীদের আচরণবিধি। এ আচরণবিধি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা আনতে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর জনসাধারণের বিশ্বাস স্থাপনে সহায়তা করে। এ ধরনের আচরণবিধি থাকার কারণে প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চাকারী দেশের সাধারণ মানুষ দেশের মুখ্য প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ইত্যাদির ওপর বিশ্বাস হারায় না।

এটি একটি অন্তর্নিহিত বিশ্বাস যে যাঁরা এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তাঁরা নিরপেক্ষ থাকবেন। কারণ, তাঁদের সেবা সমাজের কোনো নির্দিষ্ট অংশ বা অংশের জন্য নয়, তাঁরা বৃহত্তর জনগণের জন্য। এ জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান বা আমলাতন্ত্রে নিয়োগের জন্য নির্বাচন সাধারণত মেধা ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য বা আনুগত্যের ভিত্তিতে নির্বাচিত হন না। রাজনীতি, সরকারি কর্মচারী ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি কঠোর সীমারেখা রয়েছে, অন্তত বেশির ভাগ দেশে যা একক দলভিত্তিক সরকার দ্বারা পরিচালিত হয় না। অবশ্য স্বৈরশাসক বা কমিউনিস্ট সরকারের অধীনে থাকা একটি দেশের জন্য এটি সম্পূর্ণ আলাদা গল্প।

বাংলাদেশে বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোর প্রতি জনসাধারণের ব্যাপক আস্থার ঘাটতি রয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে বেসামরিক প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত। এই আস্থার ঘাটতি শুধু তাঁদের অনুভূত অকার্যকারিতা বা দুর্নীতির খ্যাতির কারণে নয়, বরং তাঁদের অনুভূত রাজনীতিকীকরণের কারণে এই বিশ্বাসের ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়েছে।

এখনো কি সমঝোতার সুযোগ আছে? নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, সাবেক বিচারপতিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন সংস্কার এবং সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই একটি সাধারণ নির্বাচন কি সম্ভব, যা দেশের জনগণ এবং বিদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে?

সরকারি সংস্থা ও কর্মকর্তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার এই ক্ষয় ত্বরান্বিত হয়, যখন লোকেরা এমন একজন পুলিশপ্রধানের কথা শোনেন, যিনি ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের একটি সভায় যোগ দেন এবং দলের প্রধানের (সরকারপ্রধানও) প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেন। একটি সরকারের নিরপেক্ষতার প্রতি বিশ্বাস বিপন্ন হয়, যখন কোনো জেলা প্রশাসনের প্রধান তাঁর অফিসে একটি প্রার্থনায় যোগ দেন এবং সরকারি পদে ক্ষমতাসীন দলের কোনো প্রার্থীর সাফল্যের আহ্বান জানান। এ ধরনের আচরণ সরকারি সংস্থা ও এগুলো পরিচালনাকারী ব্যক্তিদের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ায় না।

দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বাসের এই ক্ষয় রাতারাতি ঘটেনি। এই ক্ষয় অনেক বছর আগে শুরু হয়েছিল, আমাদের স্বাধীনতার খুব বেশি দিন পরে নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতির ছদ্মবেশী আগ্রাসন শুরু হয়েছিল, যখন ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক সরকারগুলো অনুগত বলে বিবেচিত কর্মচারীদের পৃষ্ঠপোষকতা আরম্ভ করে এবং পূর্ববর্তী সরকারের অনুগত বলে বিবেচিত অন্যদের শাস্তি দেয়।

১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৪টি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেশ কয়েকজন প্রধানের নির্বাচনের মাধ্যমে এই প্যাটার্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনকে কেন্দ্র করে এ রাজনীতিকীকরণ বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। বিদায়ী সরকার এ দুটি স্থানে এমন ব্যক্তিত্বকে মনোনীত করতে চায়, যাঁরা সেই দলের সমর্থক। এর অর্থ সেই দলের মতে দেশে নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তি নেই, সবাই কোনো না কোনো দলের সমর্থক। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই বিভাজনমূলক ইস্যুটি আমলাতন্ত্রের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের একটি কারণ, যা পরবর্তী বছরগুলোতে আরও বিস্তৃত হয়।

পরপর কয়েক বছরে দেশ যখন আরও স্থিতিশীল সরকারে পরিণত হয়েছে, ততই দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনীতিকীকরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারণ আংশিকভাবে বিরোধী দলগুলোর একত্রকরণে ব্যর্থতা এবং সন্দেহজনক জালিয়াতির কারণে প্রধান বিরোধী দলের নির্বাচনে অনুপস্থিত থাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্মচারীদের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতার অভাব এবং আচরণবিধির অনুপস্থিতির কারণেও সরকারি সংস্থাগুলোতে রাজনীতির আগ্রাসন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এতটাই যে এটা বলা ভুল হবে না, একটি নিরপেক্ষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বেসামরিক প্রশাসনের ওপর এখন জনসাধারণের বিশ্বাস প্রায় বিরল।

আগামী দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এই আশায় যে সব দল অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু এই আশায় অনেক বাধা রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এবং নির্দলীয় সদস্যদের নিয়ে নবগঠিত নির্বাচন কমিশন। এসবের অনুপস্থিতিতে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে, তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না, যেমনটা তারা আগের দুটি সাধারণ নির্বাচনে করেছে।

প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া একটি সাধারণ নির্বাচনের জন্য সরকার যে বিশ্বাসযোগ্যতা চায়, তা হবে না। পক্ষান্তরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বিএনপির দাবির কাছে নতি স্বীকার করা সরকারের পক্ষে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, একটি সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন বাতিল করা হয়েছে।

এখনো কি সমঝোতার সুযোগ আছে? নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, সাবেক বিচারপতিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন সংস্কার এবং সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই একটি সাধারণ নির্বাচন কি সম্ভব, যা দেশের জনগণ এবং বিদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে?

আগামী নির্বাচন না হয় কোনো না কোনোভাবে সরকার সম্পন্ন করবে, কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা সরকারি সংস্থা ও কর্মকর্তাদের ওপর জনসাধারণের আস্থা কীভাবে ফিরিয়ে আনবে? যে আস্থা হারিয়ে গেছে, তা ফেরাতে লাগবে আরেকটি রাজনৈতিক ইচ্ছা। রাজনীতির আরও আগ্রাসন বন্ধে সরকার কি আদৌ পদক্ষেপ নেবে? আমি জানি না সরকার এটাই চায় কি না, কিন্তু আমি জানি, পরবর্তী সময়ে কী হবে। পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার যখনই আসবে, পুরস্কার ও শাস্তির আরেকটি চক্র শুরু করবে, আস্থার ঘাটতি পূর্ণ হবে।

  • জিয়াউদ্দিন চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত বিশ্বব্যাংক ও সরকারি কর্মকর্তা