কথা বলার, মতপ্রকাশের অধিকার মানুষের জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষকে অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। মানুষ যখন নির্বিঘ্নে কথা বলার সুযোগ পায়, সমস্যাগুলো তখন সহনীয় হয়ে দেখা দেয়। ২০২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান মানুষের কথা বলার এই পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। গত দেড় দশকে মানুষের মতামতকে দুমড়েমুচড়ে ফেলা হয়েছিল। নাগরিক তার নিজের অধিকারটুকুও প্রকাশ করতে ভয় পেত। দেশটাকে একটা ভয়ের রাজ্য বানিয়ে ফেলা হয়েছিল।
জনপ্রিয় গায়ক তাশরিফ খানের গানে যেমন আছে, ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম, করতে হবে রাজার সুনাম, নাহয় তোমার কল্লা যাবে, বিরাট কঠিন শাস্তি পাবে।’ পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সুনাম না করার কারণে হাজার হাজার মানুষকে কাটাতে হয়েছে অন্ধকার কারাগারে, সইতে হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। অনেকের প্রাণও দিতে হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘সরকারবিরোধী’ বক্তব্য দেওয়ার কারণে ১৫ মাস কারাগারে থাকতে হয়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাস কারাগারে থেকেই মারা যান লেখক মুশতাক আহমেদ। বেঁচে গেছেন জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। মুশতাক ও কিশোর দুজনকেই পুলিশ একসঙ্গে গ্রেপ্তার করেছিল এবং তাঁদের সহ্য করতে হয়েছিল অমানুষিক নির্যাতন।
আইন মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেশের আদালতগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটাল এবং সাইবার মামলা চলমান রয়েছে ৫ হাজার ৮১৮টি (প্রথম আলো, ৮ নভেম্বর)। মামলাগুলোতে লাখ লাখ মানুষ ভুক্তভোগী। স্বস্তির খবর হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা আইনটি খুব দ্রুতই বাতিল হচ্ছে। এ–সংক্রান্ত সব মামলা প্রত্যাহার করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় ১০০ দিন পার হতে যাচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে। সরকার পরিচালনায় এক শ দিন খুব বেশি সময় নয়। তবে বিগত দিনের কর্মকাণ্ড যাচাই করলে সামনের দিনগুলোতে সরকার কেমন করবে, এর একটি ধারণা পাওয়া যায়।
শুরুতেই এই সরকারকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়েছে। সরকার গঠনের প্রথম দিকে নানান শ্রেণি–পেশার মানুষ নিজেদের ‘বঞ্চিত’ অনুভব শুরু করলেন। বঞ্চনার প্রতিকার চাইতে তাঁরা প্রায় প্রতিদিন রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে জড়ো হতে থাকলেন নতুন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। তখন গণমাধ্যমগুলো সংবাদ করেছিল, এত দাবি এত দিন কোথায় ছিল? একই সময়ে সচিবালয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝেও ‘বঞ্চিতদের’ ঢালাও পদোন্নতি এবং জেলা প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে তৈরি হয় নানা অস্থিরতা। পুলিশ বাহিনীতেও ছিল একই অবস্থা। ফলে মাঠপর্যায়ে প্রশাসন ছিল অনেকটাই নিষ্ক্রিয়।
পাবলিক বিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যসহ কর্তাব্যক্তিদের অনেকেই স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন। অনেকে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রমও ছিল একপ্রকার বন্ধ। এরই মধ্যে শুরু হলো বিভিন্ন আলোচনা। নির্বাচন আগে, না সংস্কার আগে? সংবিধান সংশোধন, না পুনর্লিখন? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ হবে কত দিন? সংসদ এক কক্ষ হবে, না দ্বিকক্ষ? নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক হবে, না গতানুগতিক? এটি বিপ্লবী সরকার, না অন্তর্বর্তীকালীন? এমন আরও অনেক কিছু।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রায় দুই মাস পর সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ, দুর্নীতি ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া–সংক্রান্ত ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। এর বাইরে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুটি কমিটি এবং স্বাস্থ্য, নারী, গণমাধ্যম ও শ্রম–সম্পর্কিত চারটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর বাইরে আছে গুম কমিশন। সব মিলিয়ে অনেক বড় কাজ। কমিশনগুলো কাজ করছে, সেটা দৃশ্যমান। এর মাধ্যমে সরকারের কাজের ক্ষেত্রগুলো স্পষ্ট হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে সংস্কার কমিশনগুলো কথা বলছে এবং সংস্কারে তাদের মতামত নিচ্ছে।
বর্তমান সরকারের অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ ম্লান করে দিচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে নিত্যপণ্যের মূল্য দেখে বর্তমান সরকারকে আগের সরকার থেকে খুব একটা পৃথক করতে পারে না। আগের সরকারের সময় ‘বাজার সিন্ডিকেটের’ নাম বারবার উচ্চারিত হয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সময়ে না সেগুলো ভাঙতে পারার বিষয়টা আশঙ্কাজনক।
সরকারের সংস্কারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ, একাধিক সংস্কার কমিশন ও সংস্কার প্রস্তাব আগেও এসেছে। পরবর্তী সরকার এসে তা আর আমলে নেয়নি। এদিকে বর্তমান সংস্কার কমিশনগুলোকে বলা হয়েছে সংস্কার কমিশন গঠিত হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে হবে। এর মধ্যে ৩০ দিন সময় শেষ। যথাসময়ে সব কমিশন কাজ শেষ করতে পারবে কি না, তা নিয়েও অনেকের কৌতূহল আছে।
দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিগত সরকারের আমলে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখান থেকে নতুন করে কাজ করা অনেকটাই দুরূহ ব্যাপার। পুলিশ বিভাগের কথা বলা যায়। বিগত ১৬ বছরে পুলিশ বাহিনী আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। আন্দোলনের সময় এই বাহিনী জনরোষের শিকার হয়েছে। নতুন পরিস্থিতিতে এই বাহিনীতে পেশাদারত্ব ফিরিয়ে আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গত তিন মাসেও পুলিশ বাহিনীকে সম্পূর্ণ সচল করা সম্ভব হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের মাঝে স্বস্তি নেই। এমনভাবে প্রতিটি খাতেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে গত সরকারের পতনের পর। তবে প্রশাসনে অস্থিরতা কমে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিয়োগগুলোর ক্ষেত্রে একাডেমিক এক্সেলেন্সি গুরুত্ব পেয়েছে। তবে সরকার গঠনের ১০০ দিনের মধ্যে সব নিয়োগপ্রক্রিয়া এখনো শেষ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায় ছয় মাসের সেশনজটে পড়তে যাচ্ছে। এটা মোকাবিলায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটিও জানা প্রয়োজন। অন্যান্য খাতের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ব্যাপক অনিয়ম এবং দুর্বৃত্তায়ন হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন গঠন হয়নি।
একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে এই সরকার যাত্রা শুরু করেছে। গোটা কয়েক লুটেরা ব্যবসায়ী এবং ঋণখেলাপির হাতে ছিল গোটা দেশের অর্থনীতি বন্দী। ব্যাংকগুলোতে চলছিল পুকুরচুরি। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি বলেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য দুটি কমিটি ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করা না গেলে এবং বিদেশ থেকে পাচারকৃত টাকা ফেরত না আনলে দেশের দুর্বল অর্থনীতি সবল হবে না। যদিও সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে রপ্তানি আয় বেড়েছে। রেমিট্যান্সও বাড়ছে। এখন প্রয়োজন সঠিক কর্মপদ্ধতি, তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এ ছাড়া বিদেশি ঋণ নিয়ে ‘লোকদেখানো’ যেসব মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন করার সময়ও এখন এসেছে।
বর্তমান সরকারের অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ ম্লান করে দিচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে নিত্যপণ্যের মূল্য দেখে বর্তমান সরকারকে আগের সরকার থেকে খুব একটা পৃথক করতে পারে না। আগের সরকারের সময় ‘বাজার সিন্ডিকেটের’ নাম বারবার উচ্চারিত হয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সময়ে না সেগুলো ভাঙতে পারার বিষয়টা আশঙ্কাজনক।
২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট দেশের মানুষের মধ্যে এক অসাধারণ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১০০ দিনের মাথায় এসে মনে হচ্ছে সেই ঐক্যের কিছুটা সুর কেটে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। রাজপথে যাঁরা একসঙ্গে লড়াই করেছেন, সেই তরুণদের মধ্যেও অনৈক্যের সুর। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের কেমন দূরত্ব এসেছে বলে মনে হয়। অনেকে প্রশ্ন রাখছেন, আরব বসন্তের মতো আমাদের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানও কি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে? নিজেদের অনৈক্যের কারণে আবার যদি আমরা কথা বলার স্বাধীনতা হারাই, গণতন্ত্র পথ হারায়, তবে সেটি হবে হাজার জীবন উৎসর্গ করা প্রাণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।
● ড. মো. সাহাবুল হক অধ্যাপক, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
shahabu14@yahoo.com