কেবল প্রার্থীদের পোস্টারগুলো দেয়াল পরিত্যাগ করে দড়িতে ঝুলে পড়েছে।
কেবল প্রার্থীদের পোস্টারগুলো দেয়াল পরিত্যাগ করে দড়িতে ঝুলে পড়েছে।

ডিজিটালাইজড হলেই কি স্মার্ট হওয়া যায়?

ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। ডিজিটালাইজেশনের বদৌলতে এখন অনলাইনে বেশির ভাগ সংস্থায় আবেদন করা যায়। বিভিন্ন দেশে ভিসার আবেদনও অনলাইনে করতে হচ্ছে। ভিসা নবায়নের জন্য গুলশানের ডেলটা লাইফ টাওয়ারে লিফটের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ এক তরুণ এসে ঠেলেঠুলে আমার সামনে দাঁড়ানোর জন্য কসরত করতে থাকেন। জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনি লাইন ভাঙছেন কেন? আমি তো আপনাকে আমার সামনে দাঁড়ানোর অনুমতি দিইনি।’ তিনি বললেন, ‘আমার একটু তাড়া আছে।’ বললাম, ‘কোন দেশে যাওয়ার জন্য ভিসা নিতে এসেছেন?’ উনি বললেন ‘ম্যারিকা।’ বললাম, ‘সে দেশে গিয়ে যদি আজকের মতো আচরণ করেন, তাহলে ওরা আপনাকে অসভ্য ছাড়া আর কিছু ভাববে না।’ তিনি আইফোন হাতে নিয়ে গজগজ করতে করতে পেছনে চলে গেলেন।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করা হলো, ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি হয়ে গেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মিত হবে। স্মার্ট বলতে দক্ষ জনশক্তি, সমতা ও উন্নয়নের কথা বলা হলো। এর আগে সরকারের সংশ্লিষ্টরা স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে এআই, অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আগমনের কথা বলেছেন। এর সবগুলোই ঠিক আছে। কিন্তু স্মার্ট বাংলাদেশ আসলে কোনো কারিগরি, প্রযৌক্তিক বা অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

স্মার্টনেস একটি বিমূর্ত বিষয়। ধোপদুরস্ত মূর্ত আধুনিক পোশাকের মধ্যে সুন্দর চেহারার মানুষটির আচরণই বলে দেবে সে স্মার্ট কি না। যেন ধরেই নেওয়া হচ্ছে, ডিজিটালাইজেশনের পরবর্তী অবস্থার নাম স্মার্ট। ডিজিটালাইজড না হয়েও স্মার্ট হতে বাধা নেই, আবার স্মার্ট না হয়েও ডিজিটালাইজড হওয়া যায় যেমন স্মার্টফোন এখন অনেকের হাতে হাতে। এটি বাটন ফোনের মতোই ডিজিটাল ডিভাইস। কিন্তু পরিস্থিতি–ভেদে এটির ব্যবহারে স্মার্ট–আনস্মার্ট লক্ষণীয়।

যে নির্বাচনী ইশতেহারে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা বলা হচ্ছে, সে নির্বাচনের প্রস্তুতিলগ্নে প্রচার-প্রচারণা ও আচরণবিধিতে স্মার্টনেসের কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। এর মধ্যে কেবল প্রার্থীদের পোস্টারগুলো দেয়াল পরিত্যাগ করে দড়িতে ঝুলে পড়েছে। জিতুন বা হারুন একমাত্র প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা ব্যতিরেকে এ দড়ির মাল্য কোনো স্মার্ট জনপ্রতিনিধি বা তাঁদের লোকজন সরিয়ে দেবেন, তার ইতিহাস আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশে নেই।

দিন দশেক আগে রাত সাড়ে ১২টায় পাশের ভবনের খোলা বারান্দায় এক ভদ্রমহিলা মুঠোফোনে কার সঙ্গে যেন অকথ্য গালিগালাজ চালাচ্ছিলেন এবং তা এত উচ্চ স্বরে যে আশপাশের ভবনের বারান্দায় বিরক্ত মানুষের ভিড় জমে ওঠে। কারও ঘুম ভেঙে গেছে, কেউ ঘুমাতে পারছেন না, কারও পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। ভদ্রমহিলার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি নিঃসন্দেহে আনস্মার্ট।

কোনো অনুষ্ঠানে বা জরুরি মিটিংয়ে মুঠোফোন বন্ধ বা নিঃশব্দ করে রাখার অনুরোধ সত্ত্বেও যাঁরা তা শোনেন না, তাঁরা স্মার্ট নন। মেসেজ না পাঠিয়ে যাঁরা রাতদুপুরে দুম করে ফোন করে বসেন, তাঁরাও আচরণ জানেন না। মুঠোফোন ব্যবহারের আরও অনেক নিয়মকানুন অনেকে মানেন না।
মেট্রোরেল আমাদের দেশে নতুন।

এটির ব্যবহারও ডিজিটাল। ঘোষণা বা লিখে উল্লেখ করা সত্ত্বেও প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থদের জন্য নির্ধারিত আসনে দিব্যি তরুণেরা হইহই করে বসে পড়ছেন, প্রবীণ-প্রতিবন্ধীরা হ্যান্ডেল ধরে ঝুলছেন। গণপরিবহনের সব ক্ষেত্রে এসব অনাচার চলে, উপরন্তু বাসগুলো যেন যৌন নিপীড়নের অভয়ারণ্য। পোশাকের দোষে নারী ধর্ষণের শিকার—যে দেশের অনেক মানুষ বিশ্বাস করে, সেসব মানুষের স্মার্ট হতে ২০৪১ সাল নিতান্তই নগণ্য সময়।

ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে স্মার্ট হওয়ার কোনো প্রশ্ন আসে না। স্মার্ট হতে লাগে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সমশিক্ষা;  লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ এবং কর্তৃত্ববাদী মনোভঙ্গির অপসারণ। এ ছাড়া সহবত শিক্ষাও স্মার্ট মানুষের জন্য অপরিহার্য। আমরা এখনো কারও ভালো কাজের প্রশংসা করতে পারি না মন খুলে। ধন্যবাদ, দুঃখিত, স্বাগতম, কিছু মনে করবেন না ইত্যাদির চল নেই বললে চলে। এখনো কারও ভালো গান, বাজনা, নাচ, বক্তৃতা বা অন্য পারফর্মিং আর্টের জন্য দর্শকের কাছে হাতজোড়ে হাততালি ভিক্ষা চাইতে হয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রশংসার কোনো সংস্কৃতি আমাদের গড়ে ওঠেনি।

আগে এই স্মার্টনেসটুকু আসুক, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এলেই আমরা দলে দলে স্মার্টের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সুশীল হয়ে উঠব তা ভাবার কোনো কারণ নেই। রাস্তাঘাটে যত্রতত্র কফ-থুথু ফেলে, নিজের বাড়িঘর ও আশপাশ অপরিচ্ছন্ন রেখে ডেঙ্গুর মতো মহামারি আমাদের গ্রাস করার পরও আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের ধ্বজা ধরে স্মার্ট হওয়ার কাফেলায় শামিল হতে যাচ্ছি।

স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সে তো পঞ্চাশোর্ধ্ব কাল আগের সংবিধানেও বলা ছিল। কিন্তু আইনকানুন, নীতিমালা, বিধিবিধানে তার প্রতিফলন কতটুকু? আবার সেসবের প্রয়োগ তো আলোর মুখ দেখে না। আসলে মানুষের আচরণে স্মার্টনেসের সঙ্গে সঙ্গে স্মার্ট বাংলাদেশকে হতে হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত উদ্ভাবনী শক্তির সমন্বয়ক। শহর–গ্রামের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার পার্থক্য দূর হবে, প্রতিকূল জলবায়ুর প্রভাবে গ্রামীণ নারী-পুরুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন হবে, স্বাস্থ্য, জননিরাপত্তা, কৃষি, জনপ্রশাসনে আসবে চৌকস গতিধারা।

কর্মসংস্থানের জন্য কেবল ঢাকামুখী ধাবমান মানুষের গতিও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে রোধ করতে হবে। যাতায়াত ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে নিঃসন্দেহ। তবে ঢাকা এবং প্রত্যন্ত মফস্‌সলের মধ্যে কর্মসংস্থান ও জীবনযাপনে যখন সমতা আসবে তখন সে দেশ খানিকটা হলেও স্মার্ট হয়ে উঠবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে স্মার্ট, অর্থাৎ মেধাবী তারুণ্যকে দেশে ধরে রাখার সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। তরুণদের মধ্যে দেশে ফেরার কিঞ্চিৎ অভিলাষ থাকলেও তরুণীরা নৈব চ। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য ও হয়রানির শিকার হওয়ার চেয়ে বুকে দেশপ্রেম লুকিয়ে বিদেশে কিছু করে খাওয়াই শ্রেয় ভাবেন তারা।

যে নির্বাচনী ইশতেহারে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা বলা হচ্ছে, সে নির্বাচনের প্রস্তুতিলগ্নে প্রচার-প্রচারণা ও আচরণবিধিতে স্মার্টনেসের কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। এর মধ্যে কেবল প্রার্থীদের পোস্টারগুলো দেয়াল পরিত্যাগ করে দড়িতে ঝুলে পড়েছে। জিতুন বা হারুন একমাত্র প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা ব্যতিরেকে এ দড়ির মাল্য কোনো স্মার্ট জনপ্রতিনিধি বা তাঁদের লোকজন সরিয়ে দেবেন, তার ইতিহাস আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশে নেই।
                                   
উম্মে মুসলিমা সাহিত্যকর্মী
ই–মেইল: muslima.umme@gmail.com