নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা আসবে কী করে

২০২২ পার হয়ে নির্বাচনের বছর ২০২৩-এ পা রেখেছি। ধরে নেওয়া হচ্ছে, ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৩-এর শেষ দিকে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করার সাংবিধানিক ও আইনি দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হাতে। কাজেই বছরখানেক চলবে এই নির্বাচনের প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতির দাপ্তরিক বিষয় ছাড়া প্রয়োজন হবে গত দুটি নির্বাচন, বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচন পর্যালোচনা করা। ওই নির্বাচন দুটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষকেরা দুটিই ব্যর্থ নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেছেন। নির্বাচন কমিশনকে সেটা উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও বহু জায়গায় রাতে ব্যালট ভরে ফেলা এবং ভোটকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা যে ঘটেছে, সে কথা খোদ গত কমিশনের প্রধান নূরুল হুদাও বলেছেন।

তিনি ইভিএম ব্যবহারের যুক্তি হিসেবে রাতের ভোটের উদাহরণ টেনেছিলেন। এ বিষয় এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়েছে। এসবই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের উপলব্ধি ও বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়। কারণ, আগামী নির্বাচন কেমন, কীভাবে ও কোন পরিবেশে হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনই মাঠ গরম হচ্ছে।

আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে, না ২০১৪ সালের মতো একতরফা হবে, তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ওপর। এ জন্য অনেক সময় এখনো রয়েছে। কাজেই নির্বাচন কমিশনের এখনই কোনো মতামত প্রকাশের সময় হয়নি। কিন্তু ইদানীং দু-একজন কমিশনারের মুখে সে রকম মতামত শোনা গেছে। এমনকি কোনো কোনো বক্তব্য রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো শোনা যাচ্ছে। এসব বক্তব্য শুনে মনে হয় বর্তমান কমিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনের গভীরতা ও জটিলতা এখনো উপলব্ধি করতে পারেননি।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও সর্বস্তরের স্থানীয় সরকার নির্বাচন অর্পিত রয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আইনগুলোও, বিশেষ করে নির্বাচনী আইন, ধারা ও প্রক্রিয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আইনি প্রক্রিয়া ও কর্মপদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের অনুকূলে তৈরি অন্যান্য ধারা এখন সন্নিবেশিত নয়। এর আওতায় ২০২২ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে।

সেগুলোয় ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়নি। কারণ, দলীয় প্রতীকের আওতায় নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হওয়ার পর দেশের অন্যতম বৃহত্তম দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো তাদের রাজনৈতিক কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রয়েছে। এ কারণেই স্থানীয় নির্বাচনে এক দলের, বিশেষ করে সরকারি দলের আধিপত্য বজায় থেকেছে। এমনকি কথিত ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’রাও জয়ী হয়ে মূল দলে ফিরে এসেছেন।

আমাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল যদিও জাতীয় নির্বাচনকে সেভাবে প্রভাবিত করে না। অন্যান্য দেশে এ ধরনের নির্বাচন জনসমর্থন যাচাইয়ের মাপকাঠি হলেও আমাদের দেশে তেমন মনে করার কারণ নেই। কারণ, আমাদের দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বেশির ভাগই ‘ম্যানেজড’ হয়েছে। বিশেষ করে দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। এ প্রসঙ্গ উঠলে প্রায়ই উদাহরণ টানা হয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের কথা। এ কথা অনস্বীকার্য যে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানেই নির্বাচন হয়।

উপমহাদেশের বৃহত্তম দেশ ভারতে সরকার রেখেই নির্বাচন হয়। তবে ভারত ফেডারেল রাষ্ট্র, বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন দলের সরকার থাকে। তা ছাড়া ভারতের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ শক্তিশালী এবং আমলাতন্ত্র দক্ষ ও নিরপেক্ষ। রাজনৈতিক সংস্কৃতিও বেশ উন্নত। ভারতে নির্বাচনকালে সরকারের প্রভাব ও ক্ষমতা সংকুচিত থাকে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন ‘সুপার’ সরকার হয়ে ওঠে। এর ওপর রয়েছে বিচার বিভাগ। শুধু ভারত নয়, মাত্র দেড় দশকের গণতান্ত্রিক দেশ নেপালে সরকারের তত্ত্বাবধানেই নির্বাচন হয়েছে। অথচ ছোট সরকার পরবর্তী সরকারই গঠন করতে পারেনি, কারণ, নেপালের সংবিধান ও আইনে নির্বাচনকালে সরকারব্যবস্থার ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া লিপিবদ্ধ রয়েছে।

সে তুলনায় আমরা এখনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে রয়েছি। অতীতে যে সুযোগ ছিল, তা-ও হাতছাড়া হয়েছে। ২০১৪-১৮ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়নি যে দলীয় সরকারের অধীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের হারই কি নির্বাচনের মাপকাঠি, এমন প্রশ্ন অনেকেই করেন।

২০২২ সালে বর্তমান কমিশনের ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন ভালো হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে ওগুলোই মাপকাঠি নয়। অতীতের বহুল আলোচিত দুই কমিশনের অধীন অনেক স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষা কেমন হয়েছিল, সে বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কাজেই কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন ভালো হয়েছে বলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো জটিল নির্বাচনও ভালো হবে, আশাবাদ থাকতে পারে, এমন আগাম কথা বলা কঠিন।

যার উত্তর ‘না’। একটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় তখনই, যখন প্রত্যেক ভোটার তাঁর ভোটটি পছন্দনীয় প্রার্থীকে অথবা প্রতীকে নির্বিঘ্নে দিতে পারেন এবং ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি, গাফিলতি অথবা অদক্ষতাজনিত ত্রুটি না থাকে। একটি নির্বাচন সার্বিকভাবে সর্বজনীন হতে হবে। এমন ব্যবস্থা করার দায়িত্ব শুধু কমিশনেরই নয়, মুখ্য ভূমিকা সরকার ও অংশীদারকে নিতে হয়। তবে নির্বাচন কমিশনের গুরুদায়িত্ব সে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

একটি জাতীয় নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে মূলত নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কমিশনকে চলনে-বলনে পক্ষপাতদুষ্ট মনে হলে বহু চেষ্টা করেও সেটিকে আস্থায় আনা যায়নি। নির্বাচন কমিশনের যেকোনো মন্তব্য জনমনে নানা প্রশ্ন জন্ম দিলে আস্থায় ভাটা পড়ে। হালে একজন কমিশনার বিরোধী দল নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা শোভনীয় নয়। তাঁর বক্তব্য রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো শোনা গেছে। এ কথা ঠিক যে কমিশন যেমন সংবিধান বদলাতে পারে না, তেমনি কোনো দলকে জোর করে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করতে পারে না।

তবে সংবিধানের আওতায় নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে ও সব দলকে নির্বাচনে আনার অব্যাহত প্রচেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় একটি বড় দল যারা ৩০০ আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা রাখে, এমন দল বা গোষ্ঠীকে বাইরে রেখে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের প্রচেষ্টা আস্থার উপাদান হতে পারে। বিরূপ মন্তব্য কমিশনের ভাবমূর্তি উন্নত করে না।

স্মরণযোগ্য ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের দায়িত্ব থাকা কমিশনের কোনো অজুহাত জনগণ গ্রহণ করেনি। কারণ, তাদের প্রচেষ্টা দৃশ্যমান ছিল না। এর দায়দায়িত্ব কমিশনের ওপরই বর্তিয়েছে।

২০২২ সালে বর্তমান কমিশনের ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন ভালো হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে ওগুলোই মাপকাঠি নয়। অতীতের বহুল আলোচিত দুই কমিশনের অধীন অনেক স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষা কেমন হয়েছিল, সে বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কাজেই কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন ভালো হয়েছে বলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো জটিল নির্বাচনও ভালো হবে, আশাবাদ থাকতে পারে, এমন আগাম কথা বলা কঠিন।

গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন স্থগিত হয়েছিল, না বাতিল হয়েছিল; সে প্রশ্নসহ তদন্তে চিহ্নিত ব্যক্তি, বিশেষ করে নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যে শাস্তির ক্ষমতা কমিশনের এখতিয়ারে ছিল, তা কেন প্রয়োগ করা হয়নি— সেই প্রশ্ন তোলা জরুরি। এমনকি প্রার্থিতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। এসব প্রশ্নের উত্তর কি কমিশন খোলাসা করবে? এসব উত্তর পাওয়া প্রয়োজন আগামী নির্বাচনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও কমিশনের ভাবমূর্তির স্বার্থে। আগামী নির্বাচন গত দুটি নির্বাচনের মতো হলে সবচেয়ে ক্ষতি হবে নির্বাচন কমিশন নামক প্রতিষ্ঠানটির।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

hhintlbd@yahoo.com