আগামী বছর তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবার্ষিকী। নিশ্চয় দেশবাসী যথাযথ মর্যাদায় তাঁকে স্মরণ করবে। স্মরণ করবে রাষ্ট্র, তাঁর পরিবার, সংবাদমাধ্যম।
সম্প্রতি এসব নিয়ে আলাপ হচ্ছিল জুলিয়ান ফ্রান্সিসের সঙ্গে। জুলিয়ান এখন বাংলাদেশের নাগরিক। এ বছর তিনি আশিতে পৌঁছালেন। ২৯ এপ্রিল ছিল তাঁর জন্মদিন। একানব্বইয়ের মহাপ্লাবন এসেছিল ২৯ এপ্রিল। সে কারণেই জুলিয়ানের জন্মদিনটা মনে থাকে সব সময়।
কানাডাভিত্তিক এক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার তখন তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি। উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড়ে সে বছর নিহত হয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৬ জন মানুষ। কয়েক লাখ পরিবার হয়েছিল বাস্তুচ্যুত। নতুন সরকারের নতুন গণতন্ত্র নিয়ে সেই সংকট সামলানো বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু একাত্তরের অভিজ্ঞতা নিয়ে এগিয়ে থাকা জুলিয়ান ঢাকায় বসেই বলে দিচ্ছিলেন কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। উন্নয়ন সংগঠনগুলোর সভায় অনেকেই অপেক্ষা করতেন জুলিয়ানের বক্তব্যের জন্য।
একাত্তরে জুলিয়ান ছিলেন অক্সফামের কলকাতা কার্যালয়ের প্রধান সমন্বয়ক। বিহারের দুর্ভিক্ষের (১৯৬৬-৬৭) পর ১৯৬৮ সালে ত্রাণকর্মী হিসেবে কাজ করতে এসে আর দেশে ফেরা হয়নি জুলিয়ানের। একাত্তরের এপ্রিলে ত্রাণ সংস্থা অক্সফামের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল পূর্ব ভারতের অফিস রাঁচিতে বসে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ লাখ লাখ শরণার্থী সামলানো সম্ভব হবে না। অফিস ঠিক করে কলকাতায় নতুন দপ্তর খোলা হলো।
বিহার থেকে জিপগাড়ি চালিয়ে কলকাতায় চলে আসেন জুলিয়ান। রাসেল স্ট্রিটের এক হোটেলে খোলা হয় অস্থায়ী দপ্তর। কাছেই থিয়েটার রোডে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। সেখানে জুলিয়ান গেছেন ত্রাণকাজে বুদ্ধি–পরামর্শের জন্য। দেখা হয়েছে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। জুলিয়ানের চেয়ে কমপক্ষে ১৯ বছরের বড় প্রবল ব্যস্ত যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে তাঁর সব সময় বন্ধু বলেই মনে হতো। ত্রাণের অনেক খুঁটিনাটি তরুণ জুলিয়ান শিখেছিলেন তাজউদ্দীনের কাছে।
একবার অক্সফাম কানাডা একটা বড় খাদ্যসামগ্রীর চালান পাঠায় জুলিয়ানদের কাছে। শর্ত ছিল বিতরণ করতে হবে বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চলে। কলকাতার অক্সফাম অফিস তখন কাজ করছে শরণার্থী ক্যাম্পে। ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, কোচবিহারসহ পশ্চিম বাংলার প্রায় ৫০টি ক্যাম্পে ছয় লাখ শরণার্থীর সেবা দিতে তখন অক্সফামের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। এর মধ্যে মুক্তাঞ্চলে বিতরণের অনুরোধ!
বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা না বলে এগোনো সম্ভব নয়। আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতের দিনক্ষণ ঠিক করে কাগজপত্র নিয়ে সময়মতো থিয়েটার রোডে গিয়েও প্রথম দিন তাজউদ্দীনকে পাননি জুলিয়ান। অনির্ধারিত বিশেষ জরুরি এক মিটিংয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবে জুলিয়ানের মন খারাপ হয়ে যায়। নানা ভিটামিন, খনিজ আর গুঁড়া দুধ মেশানো ৫০ টন আলুর পাউডার নিয়ে তখন মহাবিপাকে অক্সফাম। পরদিন সকালে জুলিয়ানের কাছে হাতে লেখা এক চিঠি আসে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন।
জুলিয়ান দেরি করেননি। তিনি অন্য এক তাজউদ্দীনকে সেদিন আবিষ্কার করেন তাঁর রান্নাঘরে। আমরা জানি, তাজউদ্দীন দীর্ঘ ৯ মাস রান্নাবান্না, কাপড় কাচা থেকে শুরু করে সব কাজ নিজে করতেন। তিনি বললেন, এটা খাবার, তার ওপর প্রধানত শিশুদের খাবার, আমাকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এসব খাবার আগে আমি রান্না করে দেখব, টেস্ট করব, তারপর বিতরণের ব্যবস্থা হবে। রাতে সবজি রান্নার সময় এটা মেশাব আর কাল ডালে দিয়ে দেখব খেতে কেমন হয়। তাজউদ্দীন শুধু পরীক্ষা করেননি, রাত জেগে সেই আলু পাউডার কীভাবে শিশুদের জন্য খাবারে পরিণত করতে হবে, তার নির্দেশিকা তৈরি করেছিলেন সহজ বাংলায়।
আমরা ভাবি, দুর্গত মানুষের খাবারদাবার, মশারি, বালিশ–কম্বল, থালাবাসন দিলেই চলবে। তরুণ ত্রাণকর্মী জুলিয়ান শুনলেন অন্য কথা তাজউদ্দীনের কাছে। তিনি বলেছিলেন, ‘শরণার্থীশিবিরে খাবার দিচ্ছেন ঠিক আছে। কিন্তু তাদের সব সময় মনমরা অবস্থায় দেখেন না! তা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। আমার মনে হয় শিবিরগুলোতে কিছু নির্মল বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। আপনারা কি কিছু বাদ্যযন্ত্রের ব্যবস্থা করতে পারেন?’
এখানেই অন্যদের থেকে তাজউদ্দীনের তফাত। এই গল্প প্রথম শুনি ১৯৯১ সালে ত্রাণ তৎপরতা চালানোর সময় যখন অনেক কোম্পানি বাজার দখলের জন্য নানা ব্র্যান্ডের ‘শিশুখাদ্য’ নিয়ে ছোটাছুটি করছিল আর অনেকেই তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ফটোসেশনে সময় পার করছিল।
আমরা ভাবি, দুর্গত মানুষের খাবারদাবার, মশারি, বালিশ–কম্বল, থালাবাসন দিলেই চলবে। তরুণ ত্রাণকর্মী জুলিয়ান শুনলেন অন্য কথা তাজউদ্দীনের কাছে। তিনি বলেছিলেন, ‘শরণার্থীশিবিরে খাবার দিচ্ছেন ঠিক আছে। কিন্তু তাদের সব সময় মনমরা অবস্থায় দেখেন না! তা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। আমার মনে হয় শিবিরগুলোতে কিছু নির্মল বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। আপনারা কি কিছু বাদ্যযন্ত্রের ব্যবস্থা করতে পারেন?’
ত্রাণের তালিকায় চাল, ডাল, নুন, মশারি, ওষুধ থাকলেও তবলা, হারমোনিয়াম নেই। অক্সফামের মতো একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা গাছ থেকে পড়ল এসব শুনে।
তাজউদ্দীন জানিয়েছিলেন, ‘আমি বলছি বলে নই, আপনারা ত্রাণশিবিরে কর্মরত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলুন। তাঁরা সব বয়সের মানুষের মধ্যে ট্রমা লক্ষ করছেন। ট্রমায় থাকলে তারা দিন দিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। কোনো ওষুধ কাজে আসবে না।’ তাজউদ্দীনের মধ্যে একটা সম্মোহনী শক্তি ছিল। কোনো বাজেট লাইন না থাকলেও জুলিয়ান রাজি হয়ে যান। কেনা হয় নানা বাদ্যযন্ত্র। বিতরণ করা হয় শিবিরে শিবিরে। গড়ে ওঠে শিল্পীদল।
কিন্তু হিসাব নিরীক্ষকদের কে মানাবে? তবলা, ঢোল, গিটার, হারমোনিয়াম কেনা হয়েছিল স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ থেকে। ওষুধ না কিনে গানবাজনার যন্ত্রপাতি কেনা ছিল তাদের কাছে গর্হিত অপরাধ। এবার শিবিরের চিকিৎসকেরা এগিয়ে আসেন। তাঁরা লিখিতভাবে জানান, এসব সামগ্রী ব্যবহারের পর স্বাস্থ্য পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, কত গভীর চিন্তার চর্চা থাকলে একজন আগাপাছতলা রাজনীতিবিদ এমনভাবে ভাবতে পারেন। শেখাতে পারেন পেশাদার ত্রাণকর্মীদের।
দেশ শত্রুমুক্ত হলে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে জুলিয়ান ঢাকায় এসে তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করেন। তাজউদ্দীনের দপ্তরে তখন ত্রাণের দায়িত্বে থাকা কামারুজ্জামানের সঙ্গেও তাঁর দেখা হয়। তাঁরা তাঁকে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে। জুলিয়ানের কাছে সেটাও এক স্মরণীয় মুহূর্ত। সেটা অন্য গল্প। অন্য একদিন সে ঝাঁপি খোলা যাবে। তাজউদ্দীন জন্মশতবর্ষ যথাযথ মর্যাদায় উদ্যাপিত হোক।
● গওহার নঈম ওয়ারা গবেষক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অর্জন গ্রন্থের প্রণেতা।
nayeem5508@gmail.com