তরুণেরা কি সব দেশ ছেড়ে চলে যাবেন

কেউ–বা দরিদ্র মা-বাবার শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পার হচ্ছেন, বিস্তীর্ণ মরুভূমি কিংবা জঙ্গল পাড়ি দিয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছেন শুধু রুটিরুজির নিশ্চয়তাটুকু পেতে
ছবি : এএফপি

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, মাত্র বছর দশেক আগে আমি আমার বর্তমান আবাসনে স্থায়ী হই। সেই সময় হাউজিংয়ে বসবাসকারী শিশু-কিশোরের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। ওদের নিয়ে অনায়াসে একটি ক্রিকেট কিংবা ফুটবল দল গঠন করা যেত। বাড়ির পাশে থাকা একচিলতে জমিতে প্রতিদিন দুপুর থেকে শুরু হতো ওদের কোলাহল। ওরা ক্রিকেট খেলত, ফুটবল খেলত, সাইকেল চালাত।

বিকেল গড়িয়ে ওদের খেলা চলত সন্ধ্যা পর্যন্ত। শীতের রাতে সেখানেই অনেক রাত পর্যন্ত ব্যাডমিন্টন খেলা চলত। আজ ১০ বছরের মাথায় সব কেমন বদলে গেছে। সেদিনের সেই খুদে খেলোয়াড় প্রায় সবাই বড় হয়ে গেছে। একে একে তঁাদের অনেকেই উচ্চশিক্ষার্থে পাড়ি জমিয়েছেন ইউরোপ-আমেরিকার নানা দেশে। তাঁরা আর কখনো দেশে ফিরে আসবেন বলে মনে হয় না। যাঁরা বাকি আছেন, তাঁরাও অনেকটাই অপেক্ষা করছেন বিমানের ফ্লাইট ধরার।

কয়েক বছর পর এই হাউজিংয়ে তরুণ বয়সী একজন সদস্যও খুঁজে পাওয়া যাবে না হয়তো। এরপর ফিরে তাকালাম আমার নিজের বর্ধিত পরিবারের সন্তানগুলোর দিকে। সেখানেও তারা প্রায় অনুপস্থিত। বন্ধুবান্ধব আর পরিচিত অনেকেই দেশের বাইরে স্থায়ী হয়েছেন। যাঁরা অবশিষ্ট আছেন, তাঁরা নিজেদের নিয়ে স্বপ্ন না দেখলেও সন্তানদের দেশের বাইরে পাঠানোর জোরদার বন্দোবস্ত করছেন। ভাবছিলাম, বার্ধক্যে আমাদের অবলম্বন হবে কারা? কাদের হাতে আমরা রেখে যাব আমাদের অসমাপ্ত স্বপ্নগুলো? ওদিকে বাসায় সাহায্যকারী তরুণ বয়সী মেয়েটির স্বামী সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় চলে গেছেন ভাগ্যান্বেষণে। সৌদি আরবে গিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে স্থায়ীভাবে থাকার স্বপ্ন দেখছেন তরুণ ড্রাইভারটিও।

দেশের বাইরে স্থায়ী হওয়ার স্বপ্নটি একসময় উচ্চবিত্ত আর উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত ছিল। তবে এখন স্বপ্নটি আর শুধু এই শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; বরং তা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধে৵। নিজেরা না হলেও সন্তানদের বাইরে স্থায়ী করতে সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছেন তঁারা। তরুণদের মধ্যে কেউ–বা তাঁদের মেধা, যোগ্যতা আর অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনুযায়ী বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পা বাড়াচ্ছেন। আর কেউ–বা দরিদ্র মা-বাবার শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পার হচ্ছেন, বিস্তীর্ণ মরুভূমি কিংবা জঙ্গল পাড়ি দিয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছেন শুধু রুটিরুজির নিশ্চয়তাটুকু পেতে।

বিদেশে স্থায়ী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এই তরুণদের আটকানো না গেলে অচিরেই নেতৃত্বশূন্যতায় পড়বে দেশ। নেতৃত্বদানকারী মেধাবী তরুণ আর শ্রমজীবী তরুণ—এই দুই ধরনের তারুণ্যের শূন্যতা দেশকে এক নিদারুণ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে। আমরা তরুণদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখাতে আর তাদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছি। তাই দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য ও তারুণ্যের শূন্যতাই হয়তো হতে যাচ্ছে আমাদের আগামী। শুধু সন্তানদের দেশের বাইরে ভালো রেখে আমাদের সব দিক রক্ষা হবে তো? আমরা পারব তো ভালো থাকতে?

আমার প্রায়ই মনে হয়, বাংলাদেশ তারুণ্যশূন্যতার দিকে এগোচ্ছে। তরুণেরা যে যেভাবে পারছেন দেশ ত্যাগ করছেন। মনে পড়ে, বছরখানেক আগে কোনো এক জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় কথা হচ্ছিল এক তরুণ বিতার্কিকের সঙ্গে। তুখোড় ওই বিতার্কিকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে। তরুণ জানান,  ‘হয় বিসিএস কর্মকর্তা হব, নয়তো দেশ ছাড়ব।’ ‘দেশের বাইরে স্থায়ী হতে চান কেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে তরুণ স্পষ্টভাবে জানান, বিসিএস চাকরি ছাড়া এই দেশে সে তাঁর জন্য অন্য কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পান না।

২০১৮ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম তরুণদের নিয়ে এক জরিপ প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, ভালো জীবনযাপন ও পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮২ শতাংশ তরুণ নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। এসব তরুণ মনে করেন না যে নিজের দেশে তাঁদের ভবিষ্যৎ আছে। জরিপের ফলাফলটি ছিল প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট ২০১৯ সালের মার্চ মাসে সারা বাংলাদেশে তরুণদের ওপর যে জরিপ পরিচালনা করে, তার সঙ্গে যথেষ্ট সংগতিপূর্ণ। প্রথম আলোর ওই জরিপেও দেখা  গেছে যে বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ তরুণ উদ্বিগ্ন তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে তাঁরা নানা ধরনের অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। দুটি জরিপ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল পরিষ্কারভাবেই জানান দেয় যে আমাদের তরুণেরা ভালো নেই এ দেশে।

প্রশ্ন হলো, উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ খেতাব পাওয়া একটি দেশের তরুণ প্রজন্ম কেন বৈধ-অবৈধ যেনতেন উপায়ে দেশ ত্যাগ করছে? সে কি কেবলই উন্নত জীবনের মোহে, নাকি দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি তঁাদের বাধ্য করছে এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে! ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতা জানার পরও কেন বাংলাদেশি তরুণেরা এভাবে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বিদেশের পথে পা বাড়াচ্ছেন? এই হিসাবগুলো মেলানো আজ খুব জরুরি।

বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা তরুণদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছি। আবার যতটুকু দক্ষতা আছে, সে অনুযায়ী তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারিনি আমরা। লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবক কাজের আশায় পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিসিএস চাকরি আর হাতে গোনা দু–একটি পেশা ছাড়া আমরা সামগ্রিকভাবে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছি। এ ছাড়া চোখের সামনে লুটপাট, দুর্নীতি, সুবিধাবাদী আদর্শের অনুসারী রাজনীতির চর্চা, সামাজিক অবক্ষয়, ট্রাফিকে আটকা স্থবির নগরজীবন, নারী নির্যাতনসহ নানা অরাজকতা, আইনের শাসনের অভাব এই বাস্তবতাগুলো তরুণ মনকে বিষিয়ে দিচ্ছে।

বিদেশে স্থায়ী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এই তরুণদের আটকানো না গেলে অচিরেই নেতৃত্বশূন্যতায় পড়বে দেশ। নেতৃত্বদানকারী মেধাবী তরুণ আর শ্রমজীবী তরুণ—এই দুই ধরনের তারুণ্যের শূন্যতা দেশকে এক নিদারুণ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে। আমরা তরুণদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখাতে আর তাদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছি। তাই দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য ও তারুণ্যের শূন্যতাই হয়তো হতে যাচ্ছে আমাদের আগামী। শুধু সন্তানদের দেশের বাইরে ভালো রেখে আমাদের সব দিক রক্ষা হবে তো? আমরা পারব তো ভালো থাকতে?

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী

    purba_du@yahoo.com