এবারের এইচএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রথম পত্রের একটি প্রশ্ন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। প্রশ্নের সৃজনশীল অংশে উদ্দীপক হিসেবে নেপাল-গোপাল আর আবদুলের এমন এক গল্প ফাঁদা হয়েছে, যার বাস্তবতা বাংলাদেশে নেই।
প্রশ্নকর্তার বিবেচনা থেকে এই প্রশ্ন তৈরি হলো, নাকি এর পেছনে অন্য কারও ইন্ধন আছে, তার উত্তর বোধ করি শিক্ষা বোর্ডের কাছ থেকেও পাওয়া সম্ভব নয়। তবে বলতে দ্বিধা নেই, শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্ন প্রণয়নপ্রক্রিয়ায় সমস্যা আছে। সমস্যা আছে কয়েক বছর ধরে চলা সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতেও। আমাদের শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সংশোধনের জন্য এগুলো নিয়ে কথা বলা দরকার।
‘সৃজনশীল’ নাম দিয়ে আদতে যা চলছে, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করার যথেষ্ট কারণ আছে। গালভরা নামের কারণে এখন পর্যন্ত শিক্ষক-অভিভাবকদের একটা অংশ মনে করে, এ ধরনের প্রশ্নের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে। আসলে কোনো প্রশ্নপদ্ধতিই চূড়ান্তভাবে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা যাচাইয়ের নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ, সবার সৃজনশীলতা একদিকে বিকশিত হয় না। বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে একই কাঠামোর কয়েকটি প্রশ্ন থাকে।
তাতে প্রতিটি প্রশ্নের চারটি অংশ আছে: ক অংশের মান ১, খ অংশের ২, গ অংশের ৩ এবং ঘ অংশের ৪। অংশ চারটির উত্তর দেওয়ার জন্য শুরুতে একটি উদ্দীপক বা বিবরণ উপস্থাপন করা হয়। শিক্ষার্থীদের কাজ এই উদ্দীপক পড়ে পূর্বপাঠের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া।
আমাদের পরীক্ষার বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্দীপকগুলো তাকিয়ে দেখুন, বিস্ময়করভাবে সেগুলো দুর্বল এবং সামঞ্জস্যহীন। শুধু বাংলা প্রশ্নের ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য নয়। প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্নগুলো পর্যবেক্ষণ করলেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু হওয়ার আগে যেভাবে প্রশ্ন করা হতো, তার সঙ্গে এই পদ্ধতির বিশেষ ফারাক নেই। যেমন গণিত কিংবা বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে পুরোনো প্রশ্নে যা থাকত, এখনো তা-ই থাকে। উদ্দীপক অংশ তৈরির জন্য তথ্যগুলো শুধু শুরুতে দেওয়া হয়। আর সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে উদ্দীপক অংশ যেন দেওয়ার জন্যই দেওয়া। সেগুলো না থাকলেও উত্তর লিখতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
বাংলার বিষয়ের অবস্থা অবশ্য আরও ভয়ংকর। এখানে প্রশ্নের শুরুতে যে উদ্দীপকটি দেওয়া হয়, সেটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তা নিজে বানিয়ে লিখে দেন। তাঁর ওই সাধারণ মানের উদ্দীপকের সঙ্গে তুলনা করতে দেওয়া হয় পাঠ্যবইয়ের কোনো বিশিষ্ট লেখকের গল্প-কবিতার। একরকম জোর করেই এ ধরনের অসম মানের দুটি বিষয়ের তুলনা করতে বলা হয়।
তুলনা করার কাজে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তা কোনো মহৎ লেখকের লেখার অংশবিশেষও উদ্দীপক হিসেবে ব্যবহার করেন। মজার ব্যাপার হলো, দুই ধরনের প্রশ্নেই শিক্ষার্থী বইয়ের কোন লেখার সঙ্গে তুলনা করে লিখবে, তা পরিষ্কারভাবে বলা থাকে। ফলে পরীক্ষার খাতায় মুখস্থ করা বিদ্যা উগরে দিতে পরীক্ষার্থীদের সমস্যা হয় না।
বর্তমান পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সময় হয়েছে প্রশ্ন ও মূল্যায়নপদ্ধতি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার। একদিকে সবাই বলবে ‘মুখস্থকে না’, আর শেষ যাচাইয়ে মুখস্থ ছাড়া ভালো নম্বর তোলা যাবে না, এটা হতে পারে না
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই তুলনার মধ্য দিয়ে আসলে শিক্ষার্থীদের কোনো দক্ষতা যাচাই করা হয়? তুলনামূলকের কাল গত হয়েছে দেড় শ বছর আগেই। উনিশ শতকজুড়ে তুলনা চলেছে ভাষার সঙ্গে ভাষার, উদ্ভিদের সঙ্গে উদ্ভিদের, প্রাণীর সঙ্গে প্রাণীর এবং এ রকম আরও অনেক কিছুর।
এসব তুলনা থেকে বের করা সম্ভব হয়েছে ভাষাবংশ, উদ্ভিদের শ্রেণি, প্রাণীর পর্ব বিভাজন কিংবা অন্য কিছু। সেখান থেকে বিদ্যা এখন একক উপকরণের বিশ্লেষণের দিকে গেছে। তুলনা করার বিদ্যা জানা দরকার; তাই বলে সব প্রশ্নে তুলনা করতে বলা মানে জ্ঞানকে একুশ শতক থেকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়া।
প্রশ্নের আরেকটি অংশে থাকে এমসিকিউ বা বহুনির্বাচনীমূলক প্রশ্ন আছে। এরপরও সৃজনশীল অংশে কিছু প্রশ্নের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন এবারের বিতর্কিত বাংলা প্রথম পত্র প্রশ্ন থেকেই বিষয়টি দেখানো যাক। ‘মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম কী?’, ‘“রেইনকোট” গল্পটি কত সালে প্রকাশিত হয়?’, ‘কবি সুফিয়া কামালের প্রথম স্বামীর নাম কী?’—এসব প্রশ্ন ‘সৃজনশীলে’র অংশ হয়েছে!
আজকের দিনে যেসব তথ্য সার্চ বাটনের এক ক্লিকে চলে আসে, সেসব প্রশ্ন কেন শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করে মনে রাখতে হবে? আসলে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় তথ্য মুখস্থের ওপর খুব বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব চিন্তন-দক্ষতা ও বিশ্লেষণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। প্রশ্নকর্তাদের জানাই নেই, এমসিকিউ প্রশ্নের মধ্য দিয়েও শিক্ষার্থীদের বোধ, বিশ্লেষণ ও চিন্তনশক্তি যাচাই করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে উত্তরের অপশনগুলো একটু দীর্ঘ ও ব্যাখ্যামূলক হবে।
বর্তমান পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সময় হয়েছে প্রশ্ন ও মূল্যায়নপদ্ধতি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার। একদিকে সবাই বলবে ‘মুখস্থকে না’, আর শেষ যাচাইয়ে মুখস্থ ছাড়া ভালো নম্বর তোলা যাবে না, এটা হতে পারে না।
শিক্ষায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর শিক্ষা ও প্রশ্নপদ্ধতি আমরা অনুসরণ করতে পারি। প্রশ্নের মান নিরীক্ষণের জন্য প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতা নেওয়া যায়। বর্তমানে সব প্রশ্ন একই কাঠামোয় তৈরি করা হয়।
এর চেয়ে বরং প্রশ্নে বৈচিত্র্য থাকা ভালো। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এখনো আমাদের তটস্থ থাকতে হয় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে! এর সঙ্গে মাঝেমধ্যেই প্রশ্নে যুক্ত হয় স্পর্শকাতর ও আপত্তিকর বিষয় কিংবা তথ্যগত ত্রুটি।
এ ধরনের ব্যাপার এড়ানোর জন্য প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। প্রশ্নকর্তা বা মডারেটরকে শাস্তি দিয়ে এর সমাধান সম্ভব নয়। বর্তমানে একজন প্রশ্নকর্তা একটি প্রশ্নপত্র তৈরির পর একজন মডারেটর তা যাচাই করেন।
কিন্তু এক সেট প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য একজন মডারেটরের হাতে অন্তত দুই সেট প্রশ্ন তুলে দিতে হবে। তিনি ওই দুই সেট প্রশ্ন সমন্বয় করে একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করবেন। প্রয়োজন হলে তিনি প্রশ্নে সামান্য সংযোজন-বিয়োজনও ঘটাবেন। মডারেটর বা প্রশ্ন-সমন্বয়ক যদি তাৎক্ষণিকভাবে সম্পূর্ণ নতুন করে একটি প্রশ্ন তৈরি করতে বসেন, তবে প্রশ্নে আরও বড় ধরনের ত্রুটি থেকে যেতে পারে।
তারিক মনজুর অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়