দেশে গত কয়েক সপ্তাহে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলন, প্রথম আলোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ১৮৭ জন নিহত, সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিস ও ভবনে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটতরাজ এর অন্তর্ভুক্ত।
এ ছাড়া আপিল বিভাগে একটি রায় হয়েছে। বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশনও গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা তাদের আন্দোলন থামানোর কথা এখনো বলেনি। আপিল বিভাগের রায়কে তারা যে স্বাগত জানিয়েছে, সে ধরনের কথা তারা বলেনি। সরকার কারফিউ দিয়ে, সেনাসদস্যদের মাঠে নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, ছররা গুলি, গ্রেপ্তার ইত্যাদি তো চলছে।
কর্তৃত্ববাদী বা প্রায় একনায়কতন্ত্রী সরকারের বৈশিষ্ট্য হলো, তারা শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার শক্তিপ্রয়োগের বদলে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার পথ বেছে নেয়। অস্বীকার্যভাবে আমরা এখন কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীন বসবাস করছি।
অতএব এই সরকার সমঝোতা, আলাপ-আলোচনার পরিবর্তে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে। তবে হ্যাঁ, গত কয়েক দিনে দু-চারজন মন্ত্রী আলাপ-আলোচনার কথা বলেছেন। কিন্তু সেটাকে আমি ব্যতিক্রম হিসেবে ধরে নিচ্ছি।
আমরা অবশ্যই সবাই চাই, আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে এই সংকট নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হোক। কিন্তু বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রের যে বৈশিষ্ট্য, তাতে সমঝোতা ও আলাপ-আলোচনার সুযোগ দেখছি না। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
সরকার যদি সমঝোতার পথে আসতে চায়, তাহলে প্রথমেই পুলিশের গুলিতে রংপুরের আবু সাঈদের মৃত্যু এবং আন্দোলনের একজন সমন্বয়কারী মো. নাহিদ ইসলামকে ধরে নিয়ে যে অত্যাচার করা হয়েছে, অবিলম্বে তার তদন্ত করে বিচার হতে হবে। কিন্তু তদন্ত করে বিচারের কথা বলার অসারতা হলো, গতকাল সোমবার সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, গত কয়েক দিনে অজ্ঞাতনামা ৬১ হাজার মানুষকে আসামি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা করা হয়েছে।
এটাও সেই একই কর্তৃত্ববাদী সরকারের আচরণের বহিঃপ্রকাশ।
বলব বলব করেও একটা বিষয় কোনো দিন বলিনি। আমাদের আইনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত বলে কোনো কিছু নেই। যদিও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে, অন্যায়-অবিচার হলে বিভিন্ন মহল প্রায়ই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানায়। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে আইনের মধ্যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত বলে কিছু নেই। আমাদের বিচার বিভাগ বিচার করে। অর্থাৎ দুই পক্ষের মধ্যে কোনো বিরোধ হলে সেই বিরোধের আইনগত সমাধান দেয়।
বহুদিন পরে হলেও সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, কমিশন অব ইনকোয়ারি অ্যাক্ট-১৯৫২-এর অধীন বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ আইনে কমিশন অব ইনকোয়ারি বা তদন্ত কমিশন আছে। তদন্ত কমিশন গঠনের প্রেক্ষাপট হলো, সরকার তার প্রশাসনে যদি কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং বারবার যদি একই ধরনের সমস্যা ঘটে, তাহলে একটা কমিশন করে সেই কমিশনকে বলে, সমস্যার কারণ কী সেটা খুঁজে বের করো এবং এর সমাধানে একটা সুপারিশ দাও।
যেমন আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখছি, সেতুর যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তাতে হয়তো বলা হয়, তিন বছরে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটি নির্মাণ করা হবে। কিন্তু দেখা যায়, পাঁচ, ছয়, সাত বছরেও সেতু নির্মিত হচ্ছে না। অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ তিন কোটি থেকে বেড়ে আট থেকে দশ কোটি টাকা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে তদন্ত কমিশন করে আমাদের সেতু পরিকল্পনায় কোথায় গলদ আছে, কেন সেটা হচ্ছে, ভবিষ্যতে সেতু নির্মাণের জন্য কী ধরনের পরিকল্পনা ও কী ধরনের দক্ষতা দরকার, সে সম্পর্কে সরকারকে সুপারিশ করা।
বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের নেতৃত্বে যে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেটা কোটা সংস্কার আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তার বিচারের ব্যবস্থা করার জন্য নয়। এই কমিশন মূলত প্রশাসনিক ব্যর্থতা বা অন্য কোনো পদক্ষেপের কারণে এই অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে কি না, তার খোঁজখবর নেবে এবং সেটা নিয়ে সরকারকে সুপারিশ দেবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে।
সুতরাং, রংপুরের আবু সাঈদ ও ঢাকার নাহিদ ইসলামের ঘটনা স্বাভাবিক ফৌজদারি আইনের নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত করে বিচারের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এখন আট দফা দাবি জানিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া, আবাসিক হলগুলোয় প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করা ও ছাত্র সংসদ চালু, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক, আইনি বা প্রশাসনিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তাসহ আনুষঙ্গিক দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ না নিলে অস্থিরতা কাটবে না।
সবারই যেটা চোখে পড়েছে, সেটা হলো নারীদের কোনো কোটা নেই। আমাদের সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন আছে। সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসন থাকবে আর তাঁদের কর্মজীবনে কোটা থাকবে না, এটা তো হতে পারে না। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কতটা কোটা থাকবে, সেটাও আলাপ-আলোচনার বিষয়। মোদ্দাকথা, আপিল বিভাগে একটা রায় হয়েছে, কিন্তু রায়কে হুবহু অনুসরণ করে এখনই যদি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, তাতে সংকটের সমাধান হবে বলে আশাবাদী নই।
শেষ কথা হলো, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারকে আলাপ-আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধানের পথ ধরতে হবে; যদিও সেটা সরকারের কাছে অনেক বেশি প্রত্যাশা হয়ে যাবে। অর্থনীতি ইতিমধ্যে স্থবির হয়ে গেছে। সেনাসদস্যদের নামিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ রেখে, হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে এই সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং সমস্যাটা আরও ঘনীভূত হবে। আমাদের জীবন এমনিই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সবার নাভিশ্বাস। এগুলোর সবকিছুকে আমলে নিয়ে সবার সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে সরকারকে একটা সমাধানের পথে যেতে হবে।
ওপরের কথাগুলো যদিও বলছি, কিন্তু একই সঙ্গে এ ব্যাপারে সংশয়, সন্দেহ ও উদ্বিগ্নতা দূর হচ্ছে না। কারণ, আমাদের রাষ্ট্রের যে বৈশিষ্ট্য, সেই কাঠামোর মধ্যে এসব আশা করা সম্ভবত বাস্তব নয়। কিন্তু দেশ নিয়ে শেষ বিচারে তো আমরা সবাই আশাবাদী। সবাই চাই রাষ্ট্র আরও সংকটে যাতে পতিত না হয়। তাই আশা করেই যাব, আশা করতেই থাকব।
ড. শাহদীন মালিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক