মতামত

ভুয়া বিশেষজ্ঞদের কালে মনীষী বেনসন অ্যান্ড হেজেসকে মনে পড়ে

গত শতকের নব্বই দশকে, আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, সমাজবিজ্ঞান বিষয়টা ছিল একই সাথে বেশ কঠিন এবং মজার। কঠিন, কারণ এই বিষয়ের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে বহু সমাজবিজ্ঞানীর উদ্ধৃতি মনে রাখতে হতো, কিশোরদের জন্য সেই মনে রাখা ছিল কঠিন এক চ্যালেঞ্জ।

অবশ্য দুঃসাহসী কিশোরদের জন্য, এই ব্যাপারটাই হয়ে যেতো রোমাঞ্চকর। কে কী বলল, তা মনে রাখার তোয়াক্কা না করে, সত্যকে থোড়াই কেয়ার করে, এই বালকেরা রীতিমতো নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে উদ্ধৃতি বানাতো।

বেনসন অ্যান্ড হেজেস বলেছেন, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল, কিংবা অষ্টাদশ শতকের নারী সমাজবিজ্ঞানী মেরিলিন মনরো বলেছেন, অর্থই অনর্থের মূল—এইরকম ভুয়া উদ্ধৃতি দিয়ে খাতা ভরাতো দুষ্ট বালকের দল। বলাই বাহুল্য, কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদ্ধৃতি দেওয়া মনিষীটি হতেন একেবারেই কল্পনায় সৃষ্ট। এসব করতে গিয়ে দুই–একবার ধরা পড়ে মাস্টারের কিল খাওয়াও যে হয়নি তা না।

বালক বয়সের এই সুখস্মৃতিটি গতকাল ফিরিয়ে আনল প্যারিস-ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদন। সংস্থাটির এক অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারের প্রশংসা করে ‘বিদেশি বিশেষজ্ঞরা’ দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে শত শত মতামত কলাম বা নিবন্ধ লিখেছেন। আদতে ‘ডরিন চৌধুরী’, ‘নন্দিতা রায়’-সহ আরও যেসব বিশেষজ্ঞের নাম এসেছে, তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই বলে প্রায় ৭০০ নিবন্ধ বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে এএফপি।

নিবন্ধগুলোতে এই সব লেখকের পরিচয়ে বলা হয়, দুনিয়ার অনেক নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁরা যুক্ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এদের কোনো অস্তিত্বই নেই। এই ‘ভুয়া বিশেষজ্ঞরা’ বালক বয়সের মনীষী বেনসন অ্যান্ড হেজেসের থেকেও এক কাঠি সরেস যেন।

একজন বিশেষজ্ঞের পরিচয় এবং কথাবার্তায় সততা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক একইরকম ব্যাপার সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রেও। শত শত সংবাদপত্রের মধ্যে একটিকে পাঠক বেছে নেন, তার বড় কারণ এর প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা। এই বিশ্বাসযোগ্যতাই সংবাদমাধ্যমের মূল ভিত্তি। এই ভিত্তি নড়ে গেলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। সংবাদপত্র যদি বালকদের স্কুলের পরীক্ষার খাতার মতো হয়ে যায়, তবে তা কেবল প্রহসন নয়, রীতিমতো ভীতিকরও।

আর বালকেরা যেভাবে মাস্টারদের ফাঁকি দিয়ে নম্বর পেত, সেভাবেই ৮০টিরও বেশি সংবাদমাধ্যমকে বোকা বানিয়ে ছেড়েছে এই সব ভুয়া বিশেষজ্ঞ। এএফপি জানাচ্ছে, সেসব সংবাদমাধ্যমে ৩৫ জন ‘ভুয়া’ বিশ্লেষকের নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।  
যেহেতু সরকারের প্রশংসা করে লেখা, ধরে নেওয়া হচ্ছে যে এই লেখাগুলোর পেছনে সরকারের বিভিন্ন স্তরের সক্রিয়তা ও সমর্থন ছিল।

প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞদের ভাড়া করে বা জোর করে মতামত লেখানো নতুন কিছু নয়। সাহিত্যে ছদ্মনামে লেখা তো আকছার হয়। আর, সরকারবিরোধী কিংবা ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে থাকারাও নিয়মিত ছদ্মনাম ব্যবহার করে বার্তা পৌঁছান। জনমানসে নিজেদের মতামত শক্তভাবে প্রোথিত করতে এই কৌশল চিরন্তন।

কিন্তু, সেসবের সাথে সাম্প্রতিক এই ঘটনার বড় পার্থক্য আছে। সাহিত্য কিংবা প্রোপাগান্ডায়, ভুয়া নাম ব্যবহার করে আড়াল রাখার প্রচেষ্টাতে একধরনের দ্যোতনা আছে। নিরাপত্তার ব্যাপার আছে। নিজেকে আড়াল করে রাখার সৌন্দর্য আছে। কিন্তু, এসব ভুয়া বিশেষজ্ঞের মতামত কলাম এই কাতারে পড়ে না।

একজন বিশেষজ্ঞের পরিচয় এবং কথাবার্তায় সততা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক একইরকম ব্যাপার সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রেও। শত শত সংবাদপত্রের মধ্যে একটিকে পাঠক বেছে নেন, তার বড় কারণ এর প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা। এই বিশ্বাসযোগ্যতাই সংবাদমাধ্যমের মূল ভিত্তি। এই ভিত্তি নড়ে গেলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। সংবাদপত্র যদি বালকদের স্কুলের পরীক্ষার খাতার মতো হয়ে যায়, তবে তা কেবল প্রহসন নয়, রীতিমতো ভীতিকরও।

লেবাননীয় কবি কাহলিল জিবরান বলতেন, সত্য বলে কিছু নেই, আছে অনেকগুলো সত্য। দার্শনিক, সুফিবাদীরাও প্রায়ই বলেন, যা দেখো তাই সত্য নয়, সত্য বহুমাত্রিক হতে পারে। এই সব উচ্চমার্গীয় কঠিন কথাগুলো ভাবনার খোরাক জোগায়, কিন্তু তাই বলে ডাহা মিথ্যাকে ‘সত্য’ বলে চালানোর অপরাধ ঢাকা পড়ে না।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মানুষ এক বিচিত্র প্রাণী। নিজের বিশ্বাসের উপর অগাধ ও প্রবল আস্থার ফলে, সে যে কোনো সত্যকে উড়িয়ে দিতে পারে এবং অসম্ভবে বিশ্বাস রাখতে পারে। আর এই করতে গিয়ে, চিন্তকদের নানা কথার অপব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের প্রবোধও দিতে পারে। মনোবিজ্ঞানী আর দার্শনিকেরা এই নিয়ে বহু পাঠ করে, মানব চরিত্রের এই দিকটা উন্মোচিত করেছেন।

ফলে, মিথ্যা কথা, ভুয়া প্রচারের আবেদন আছে এবং থাকবে। আর, আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে দুনিয়া এখন হাতের মুঠোতে চলে আসায় এর প্রকোপ আরও বেড়েছে। পোস্ট ট্রুথ বলে এক ধারণার জন্ম হয়েছে, যাতে বলা হয়, সত্য বলে কিছু নেই, তুমি যা বিশ্বাস করো তাই সত্য।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অদ্ভুত সব দাবি করতেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ ‘ফেক নিউজ’ বলে উড়িয়ে দিতেন। পোস্ট ট্রুথ দুনিয়ার এক ‘পোস্টার বয়’ হয়ে উঠেছিলেন এই ট্রাম্প।

আদতে, দেশে দেশে যুগে যুগে রাজনীতিবিদসহ নানা বিশ্বাসের লোক মিথ্যা প্রোপাগান্ডার আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু, আগের যুগে সম্ভবত কিছুটা লাজলজ্জা ছিল, মিথ্যা ধরা পড়লে লোকে শরম পাইতো। কিন্তু পোস্ট ট্রুথের যুগে চোরের মায়েদের জিরাফ হয়ে যাওয়াটাই কৌশল।

আবার সেই বালক বয়সের কথা মনে পড়ল। একবার পরীক্ষার খাতায় ‘সময়ের মূল্য’ রচনায় এক বালক লিখেছিল, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘সময় বয়ে যায়’। শুধু এতেই থামেনি, শিক্ষক লাল কালিতে লাইনটা কাটার পর ট্রাম্পের মতো মতো শিক্ষককে পালটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল সেই বালক। চোরের মায়ের মতো বড় গলা করে বলেছিল, ‘স্যার, আপনি কি নিশ্চিত কবিগুরু কখনোই এমনটা বলেননি?’

কিশোরের এই কৌশল হচ্ছে ধোঁয়াশা তৈরি করে অপরাধ ঢেকে রাখার কৌশল।
কিন্তু, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যখন ব্যাপারটা ঘটে তখন আর কিশোরের পরীক্ষার খাতার মতো নির্বিষ থাকে না। প্রায়শই দেখা যায়, যিনি এই মিথ্যা উন্মোচিত করে দেন তাঁদের ওপরই উল্টো খড়্গ নেমে আসে। তাঁদের চরিত্রহননের চেষ্টা করা হয়—ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ভুল বোঝাবুঝি আর নানারকম ধোঁয়াশা তৈরি করে।

অবশ্য, আলোচ্য ‘ভুয়া বিশেষজ্ঞদের’ মহাযজ্ঞ নিয়ে পোস্ট ট্রুথ, প্রোপাগান্ডা, স্বৈরাচারী মনোভাবের মতো গুরুতর ব্যাপার যুক্ত করে আলোচনা করলেও এর উৎস হয়তো এক নিম্নমানের তস্কর মনোভাব।

বিদেশে বসে বাংলাদেশ ও সরকারকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার জবাব দিতে গত বছরের শেষ দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভালো কলামিস্টের সন্ধান করে। ভাড়াটে কলামিস্ট বা ঘোস্ট রাইটার ধারণাটা খুবই প্রচলিত। আর বহু টাকা খরচ করে সরকারের প্রোপাগান্ডা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এই দুই ব্যাপার যোগ করে একটা দৃশ্যকল্প চিন্তা করা যায়, যা আমাদের আশপাশের অবস্থা বুঝিয়ে দেয়।

হয়তো এই নিবন্ধগুলো ‘সত্যিকারের বিশেষজ্ঞদের’ দিয়ে লেখানোর জন্যই মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ ছিল। কিন্তু, যাদের এই টাকাপয়সার ব্যাপারটা দেখার কথা, তাঁদের মাথায় প্রথমেই এসেছে এখান থেকে সিংহভাগ অর্থ তছরুপ করা।

এরই ফলাফল, খুবই অল্প টাকায় কিছু ভাড়াটে লেখকদের দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া। বাকি টাকাটা পকেটস্থ করা। সরকারি হিসেবে যে দেশে বিভিন্ন প্রজেক্টে বালিশের দাম কয়েক হাজার টাকা, কয়েক হাজার টাকার রাউটারের দাম লক্ষাধিক টাকা দেখানো হয়, এক কিলোমিটার রাস্তা বা ব্রিজ তৈরিতে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি খরচ দেখানো হয়, সেখানে প্রোপাগান্ডার প্রকল্পের দায়িত্বরতরা এমনটা করতেই পারেন। এই খরচ তো সরকারি হিসেবের মতো প্রকাশ্যেও না।

সেই টাকা দিয়ে, বেনসন অ্যান্ড হেজেস মার্কা মনীষীদের জন্ম দিয়ে দামি সিগারেট কেবল না, বিদেশি মদ্য আর বিলাসব্যসনের দৃশ্যটা কারও কাছে অশ্লীল ঠেকলেও, পোস্ট ট্রুথের যুগে এই সব ব্যাপার না।
কারণ বিখ্যাত মনীষী জন মার্লবোরো বলেছেন, ত্যাগে নয় ভোগেই প্রকৃত সুখ।

  • সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক