মতামত

যেভাবে এলো জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস

আজ ২৮ এপ্রিল, জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ, বিনা মূল্যে আইনি সেবার দ্বার উন্মোচন’। ২০১৩ সাল থেকে জাতীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ে ২৮ এপ্রিল আইনগত সহায়তা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী প্রচারণা চালানো হয়। দিবসটি পালনের ফলে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আইনগত সহায়তা সম্পর্কে সচেতনতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিচার পাওয়া মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আদালত ও বিচারব্যবস্থার জটিলতা, বাদী ও সাক্ষীর প্রতি হুমকি, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, আর্থিক অসচ্ছলতা, অজ্ঞতা—এসব কারণে সাধারণ মানুষ প্রায়ই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। আর্থিক অসচ্ছলতা ও অন্যান্য কারণে যাঁরা বিচার পেতে অসমর্থ বা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন, তাঁদের জন্য বিচারের পথ সুগম করতেই আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০ প্রণীত হয়। এটি একটি যুগান্তকারী ও জনবান্ধব আইন। ২০০৯ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তার প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হওয়ার ফলে আইনগত সহায়তা প্রদান আইনটি বাস্তবে রূপ লাভ করে এবং সরকারি আইনি সহায়তা কার্যক্রমটি গতি লাভ করে।

প্রতিটি জেলায় জেলা ও দায়রা জজের অধীন সরকারি আইন সহায়তা ফান্ডের বরাদ্দ দেওয়া হয়। শুরুতে বেশির ভাগ জেলায় এ ফান্ডের ব্যবহার কম হলেও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ২০১২ সাল থেকে এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। মূলত সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রচারণা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি; বিভিন্ন সময়ে আইন ও বিধিমালার সংশোধনের মাধ্যমে আইনি সহায়তা প্রাপকের যোগ্যতা পুনর্নির্ধারণ; প্যানেল আইনজীবীর ফি বৃদ্ধি; জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার পদ সৃজন করা; জেলা লিগ্যাল অফিসকে এডিআর কর্নার হিসেবে ঘোষণা; জেলা কমিটির মিটিং নিয়মিতকরণ; বেসরকারি সংগঠন কর্তৃক উপকারভোগীদের পরামর্শ প্রদান ও তাদের যাতায়াত ভাতাসহ আনুষঙ্গিক খরচ বহন—এসব কারণে ফান্ডের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।

সময়ের সঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ফলে আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তির বাৎসরিক গড় আয় সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। অন্যান্য আদালতের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ ২০১৪ সালের বিধিমালা অনুযায়ী যাঁর বাৎসরিক গড় আয় এক লাখ টাকার বেশি নয়, তিনি আদালতে মামলা করার ক্ষেত্রে আইনগত সহায়তা পেতে পারেন। যাঁর বার্ষিক গড় আয় দেড় লাখ টাকার ঊর্ধ্বে নয়, তিনি সুপ্রিম কোর্টে আইনগত সহায়তা পাবেন। আইনগত সহায়তাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আর্থিক এখতিয়ার বৃদ্ধির ফলে বেশিসংখ্যক মানুষ এই সহায়তা নিতে পারছেন। তা ছাড়া ২০১৩ সালের সংশোধনীতে আইনগত সহায়তা প্রদান আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন, এর বিস্তারিত কার্যক্রম এবং চৌকি কোর্ট কার্যকর করার ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৩ সালে আইন সংশোধনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে জেল আপিল, দেওয়ানি আপিল, ফৌজদারি আপিল, দেওয়ানি রিভিশন, ফৌজদারি রিভিশন ও রিট মামলার ক্ষেত্রে লিগ্যাল এইড প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে। তবে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসের সমন্বয় বাড়ানো প্রয়োজন।

আইনগত সহায়তা প্রদানের জাতীয় পর্যায়ের সংগঠন জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সক্রিয়তা এবং বেসরকারি সংগঠনগুলোর যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সরকারি আইনগত সহায়তার বিষয়টি ব্যাপক প্রচারণা লাভ করেছে এবং বেশিসংখ্যক মানুষ সরকারি আইনগত সহায়তা পাচ্ছেন। জাতীয় পর্যায় থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বেসরকারি সংগঠনগুলো সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আইনগত সহায়তা বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি, জেলা পর্যায়ে জেলা আইনগত সহায়তা কমিটি এবং ইউনিয়ন কমিটিকে কার্যকর করা এবং উঠান বৈঠকের মধ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কাজ করে চলেছে।

তৃণমূলের মানুষ সচেতন না হলে তাঁরা মামলার বিষয়ে আইনগত সহায়তা নিতে পারেন না। নির্যাতনের শিকার নারী দারিদ্র্যের কারণে ও নিরাপত্তার অভাবে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না বা মামলা করতে পারেন না। অনেক সময় নির্যাতনের শিকার নারী অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে আপস করে ফেলেন। সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রম নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য একটা বড় আশ্রয়। এখানে নারী উপকারভোগীদের জন্য সমস্যা হচ্ছে জেলা আদালতে আইনগত সহায়তা নিতে এলে তাঁদের জন্য যাতায়াত খরচ নেই, খাওয়ার পানি ও বসার ব্যবস্থা নেই। মানদণ্ড অনুযায়ী নারীই এই আইনগত সহায়তা আইনের সুবিধা বেশি পাওয়ার কথা। কিন্তু অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অনেক ক্ষেত্রেই এই আইনের সুবিধা নিতে পারছেন না।

২০১৪ সালের আইনগত সহায়তা প্রদান বিধিমালায় নতুন কিছু ব্যতিক্রম সংযুক্ত করে আইনগত সহায়তাপ্রাপ্তির বিস্তৃতি আরও বৃদ্ধি/শিথিল করা হযেছে। যেমন পারিবারিক সহিংসতার শিকার ব্যক্তি, শিশু, শারীরিক বা মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারী, মানব পাচারের শিকার ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, নিরাশ্রয় ব্যক্তি বা ভবঘুরে, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তির বাৎসরিক আয় এক লাখ টাকা বা এর ওপরে হলেও তাঁরা আইনগত সহায়তা নিতে পারেন, অর্থাৎ তাঁদের ক্ষেত্রে আর্থিক সিলিং প্রযোজ্য নয়।

দীর্ঘদিন সরকারি আইনগত সহায়তা বিষয়ে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে সুপ্রিম কোর্টে আইনগত সহায়তা চালুর ব্যবহারিক দিক পর্যালোচনা করে ২০১২ সালে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে এবং এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য অ্যাডভোকেসি করে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য মানবাধিকার ও লিগ্যাল এইড সংগঠনের অ্যাডভোকেসির ফলে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড বিষয়টি আইনে যুক্ত করে। আইনগত সহায়তা প্রদান প্রবিধানমালা-২০১৫ গেজেট আকারে প্রকাশের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে আইনগত সহায়তা প্রদানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। যার সুফল ভোগ করছে দেশের সাধারণ মানুষ।  

  • রুমা সুলতানা প্রোগ্রাম কো–অর্ডিনেটর ও লিগ্যাল এইড বিশেষজ্ঞ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন