পাঠ্যপুস্তক নিয়ে দ্বন্দ্ব: রাজনীতি সামাল দিতে হবে

নতুন পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বিতর্ক তিন ধরনের বিষয় নিয়ে—১. ধর্মীয় বিশ্বাস, মতবাদ ও মূল্যবোধের প্রতিফলন পাঠ্যপুস্তকে কতখানি ঘটেছে। ইসলামিক রাষ্ট্র ও শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের সমর্থকেরা এ বিষয়ে সোচ্চার। ২. ভুলত্রুটি ও উপস্থাপনায় অসংগতি নিয়ে অভিযোগ। ৩. শিক্ষকদের যোগ্যতা-দক্ষতা ও বিদ্যালয়ের বাস্তব পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের জন্য পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের উপযুক্ততা।

তথ্যের ভুল বা উপস্থাপনার অসংগতি ও মুদ্রণপ্রমাদ ইত্যাদি নতুন পাঠ্যপুস্তকে থাকতে পারে। কিন্তু এসবের ধরন ও ব্যাপকতার মাত্রা গ্রহণযোগ্য নয়। এসবই দায়িত্বশীলদের অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা নিদর্শন। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নবায়নের প্রক্রিয়া, ধরন বিষয়বস্তুর বিন্যাস ও বিষয়ের ধারাবাহিকতা ও পরিমাণ ইত্যাদি স্থির হওয়া দরকার শিক্ষার সামগ্রিক ও প্রতি শ্রেণির জন্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে।

আরও বিবেচনার বিষয় রচিত পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক শ্রেণিকক্ষে কাজে লাগানোর জন্য শিক্ষকের প্রস্তুতি, যোগ্যতা ও দক্ষতা এবং বিদ্যালয়ে ও শ্রেণিকক্ষে ভৌত অবকাঠামো, উপকরণ ইত্যাদিসহ উপযুক্ত পরিবেশ আছে কি না। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুগতও এ ক্ষেত্রে জরুরি বিষয়।

উচ্চাভিলাষী এক আদর্শ পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক তৈরি হলে বা বিষয়বস্তুর বোঝা চাপিয়ে দিলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাব্যবস্থা সংকটে পড়বে। পাঠদানের সঙ্গে শিক্ষার্থী মূল্যায়নের বৈপরীত্য এবং মূল্যায়নপদ্ধতি নিয়ে অনেক সমস্যা বহুল আলোচিত বিষয়। এসব বিষয়ে সঠিক বাস্তবায়নযোগ্য ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ নয়। অনেক শিক্ষাবিদ ও গবেষক আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছেন, অতীতে প্রবর্তিত শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক ঠিকমতো কাজে লাগানো যায়নি শিক্ষকের যোগ্যতা, সংখ্যা ও বিদ্যালয়ের পরিবেশের জন্য।

কোভিড মহামারির আঘাতে সমস্যা আরও গভীর হয়েছে। তাই এই সময় নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক চালু করার চেয়ে শিক্ষার ক্ষতি পোষানোর কাজে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন ছিল। তাতেই শিক্ষাক্রম ও পাঠক্রম নবায়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারত। সরকারি সিদ্ধান্তদাতারা এসব পরামর্শে কান দেননি। তাঁরা শিক্ষায় বড় রকমের ক্ষতির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। কোভিডের পর স্কুল খুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তনের কাজ শুরু করা হয়েছে, যদিও নিজেদের পরিকল্পনামতো প্রস্তুতি পুরোপুরি নেওয়া যায়নি।

যথার্থ শিক্ষণ-শিখনের প্রশ্ন ও শিক্ষার মান রক্ষার বিষয় ছাপিয়ে এখন পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নবায়নের ব্যাপারে বিতর্ক প্রধানত বিশ্বাস ও মতবাদের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। আলোচনা ও অংশীজনের সংলাপের পরিবর্তে বিষয়টি এখন রাজপথে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে রূপ নিয়েছে।

ক্ষমতাসীন দলকে জনসাধারণের প্রতি তাঁদের আস্থার নিদর্শন দৃশ্যমান করতে হবে। তাদের মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধ করে সৎ ও স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচন করতে হবে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তানি বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনী ওয়াদার জয়জয়কারের বয়ান সীমিত করে সমস্যা ও ব্যর্থতার কথাও বলতে হবে। জনসাধারণের আস্থা অর্জন করে গণতন্ত্রের বিধান ও প্রেরণাকে ধারণ করাই হবে পশ্চাদ্‌মুখী শক্তিকে প্রতিহত করাই প্রকৃষ্ট উপায়।

খেলাফত মজলিসের বক্তব্য, নতুন পাঠ্যবইয়ে ইসলামি মূল্যবোধ বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। বাংলার মুসলিম শাসকদের অবদান খাটো করা হয়েছে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়িয়ে ইসলামি বিশ্বাস ও মূল্যবোধে আঘাত করা হয়েছে (২৭ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভের সময় বক্তব্য।) ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী বলে পরিচিত পেশাজীবী অধিকার পরিষদ জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘ভুলে ভরা পাঠ্যবইয়ে বিকৃত ইতিহাস শিশুশিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা (২৭ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হয়।

বক্তারা অভিযোগ করেন পাঠ্যবইয়ে ইসলামি সংস্কৃতি উপেক্ষা করে ‘হিন্দুত্ববাদ’ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক শামসুল আলম তাঁর প্রবন্ধে বলেন, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বইয়ে ষড়্ঋতুর সঙ্গে মিল রেখে বিভিন্ন অধ্যায় সাজানো হয়েছে। যাত্রাপালা, সার্কাস, বাউলগান, লোকনাটক, পুতুলনাচ, গানের অনুষ্ঠান ইত্যাদিকে। সেখানে ঢোল, তবলা ও হারমোনিয়ামের ছড়াছড়ি থাকলেও ইসলাম সংস্কৃতির ছিটেফোঁটাও নেই।

একই আলোচনায় লেখক ও কবি ফরহাদ মজহার বলেন, ‘এই পাঠ্যপুস্তক দিয়ে জাতি গঠন করা যাবে না। আপনি কে—হিন্দু না মুসলিম, নাকি সেন আমলে বাস করছেন, কিছুই বুঝবেন না। তারা বহু শিশুর হৃদয়কে হত্যা করেছে।’ ধর্মাচারের এক বিশেষ ব্যাখ্যা ও বিশ্বাস এবং আবেগপ্রসূত এসব বক্তব্যে যাত্রাপালা ইত্যাদি কেন বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ নয় এবং ইসলামি সংস্কৃতির কী বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল, তা স্পষ্ট করা হয়নি।

পাঠ্যবই নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক নতুন নয়। ২০১৭ সালে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আন্দোলন হেফাজতে ইসলামের অভিযোগের জবাবে ‘ইসলামবিরোধী’ ও ‘নাস্তিকতাবাদী’ ১৭টি বিভিন্ন বিষয় সেই সময়ের পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়। সংগঠনের প্রধান আল্লামা শফী সরকারকে সে জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।

কান টানলে মাথা আসে। বর্তমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মাথায় রাখতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষণায় ও সাংবিধানিক মূলনীতি হিসেবে গৃহীত জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজ ও রাষ্ট্রে কীভাবে প্রতিফলিত হবে, তা সব সময় ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। তবে ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এসব মূলনীতি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।

স্বৈরশাসনের আমলে এবং ১৯৯০-এর পর রাজনৈতিক শাসনের আমলেও সংবিধানকে নানাভাবে কাটাছেঁড়া করে সুবিধাবাদী রাজনীতির আপসের পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে সামরিক শাসনের মদদে সাধারণ বাংলা মাধ্যম, মাদ্রাসাশিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যমের ত্রিমুখী ধারার ব্যাপক প্রসার ঘটে। সেই ধারা অব্যাহত থাকে ১৯৯০-এর পরও। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে এই ত্রিমুখী ধারাকে টেক্কা দেওয়া হয়। নীতির খসড়ায় ধর্মনিরপেক্ষ (ধর্মবিরোধী নয়) শিক্ষার কথা থাকলেও চূড়ান্ত নীতিতে তার উল্লেখ ছিল না। স্বীকার করতে হবে বাংলাদেশের মানুষের এক অংশ স্বাধীনতার ঘোষণা ও সংবিধানের মূলনীতির প্রেরণা মেনে নেয়নি বা নিজেদের মতো এর ব্যাখ্যা তৈরি করেছে।

স্বৈরশাসকদের মতোই ১৯৯০-পরবর্তী রাজনৈতিক শাসকেরাও যোগসাজশের পুঁজিবাদী নীতি (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) ও কমবেশি স্বার্থসর্বস্ব আর্থ-রাজনীতি (পলিটিক্যাল ইকোনমি) অনুসরণ করে। রাষ্ট্রীয় মূল শক্তিকে পাশে সরিয়ে রেখেছে। ফলে শিক্ষার সংবেদনশীলতা ও এর নানা সমস্যা উত্তরণের জটিলতার সুযোগ নিয়েছে নানা ধরনের ধর্মীয় ও জনতোষণমূলক রাজনীতির অ্যাজেন্ডার বাহকেরা। পাঠ্যপুস্তক দ্বন্দ্বের রাজনীতি সামাল দেওয়ার উপায় কী? ক্ষমতাসীন দলকে গণতন্ত্র ও সুশাসনের চর্চার মাধ্যমে নিজেদের গণসমর্থনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করাই হবে যথার্থ সমাধান।

যারা ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে, সৃষ্টিকর্তা ও মানুষের মধ্যে আত্মিক সম্পর্কে, কে মুসলিম বা বিধর্মী, এসব নির্ধারণে রাষ্ট্রকে টেনে আনতে চায় এবং ধর্মের সমালোচনার জন্য মৃত্যুদণ্ড (ব্ল্যাসফেমি) আইন চালু করতে চায়, তাদের সঙ্গে আপস কতখানি সম্ভব? পশ্চাদ্‌মুখী শক্তিগুলোকে মোকাবিলা করার উপায় গণতান্ত্রিক আচার সমুন্নত রাখা। বর্তমান সন্ধিক্ষণে গণতন্ত্রকে বেগবান রাখার জন্য দুটি পদক্ষেপ নিতে হবে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে যথার্থ সমাধান দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়ে প্রশাসনকে নির্বাচনকালে কমিশনের অধীনে নিয়ে আসার ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী পক্ষের জন্য এক গ্রহণযোগ্য সমাধান হতে পারে ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থাপনার আদলে।

দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দলকে জনসাধারণের প্রতি তাঁদের আস্থার নিদর্শন দৃশ্যমান করতে হবে। তাদের মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধ করে সৎ ও স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচন করতে হবে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তানি বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনী ওয়াদার জয়জয়কারের বয়ান সীমিত করে সমস্যা ও ব্যর্থতার কথাও বলতে হবে। জনসাধারণের আস্থা অর্জন করে গণতন্ত্রের বিধান ও প্রেরণাকে ধারণ করাই হবে পশ্চাদ্‌মুখী শক্তিকে প্রতিহত করাই প্রকৃষ্ট উপায়।

  • ড. মনজুর আহমেদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইসিডি নেটওয়ার্কের সভাপতি ও গণসাক্ষরতা অভিযানের সহসভাপতি