সমবায়ের ইতিহাস প্রায় মানবসভ্যতার ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের উন্নতিতে সমবায়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সমবায়ের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। যার ফলে যেকোনো বড় কাজ অতি সহজে সম্পাদন করা যায়। সমবায়ের মূল কথা সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহযোগিতা। সমবায় জনগণকে সংঘবদ্ধ করার একটি বড় মাধ্যম। শুধু ব্যক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠা নয়, বরং ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ইসলামের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে সমবায় একটি সহায়ক পন্থা, যার মাধ্যমে অর্জিত হবে বৃহত্তর মানবকল্যাণ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ‘সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের ব্যক্তিগণ সম-অধিকার ও দায়িত্বের ভিত্তিতে যে সংস্থা গড়ে তোলে, তাকে সমবায় সমিতি বলে।’ কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে সম্মিলিত প্রয়াসই সমবায়। সমবায় সমিতির বহুবিধ উদ্দেশ্য রয়েছে। যেমন দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জন, আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন, বড় বিনিয়োগের জন্য মূলধন সৃষ্টি, নৈতিক শিক্ষা, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সামাজিক উন্নয়ন, মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎখাত, সেবার মানসিকতা, সামাজিক বন্ধন, সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করা, সঞ্চয়ী করে তোলা, পরামর্শভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনা, আইনগত সত্তা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। সমবায় সমিতির মূল লক্ষ্য হলো ‘দরদি-সমাজ গঠনে অংশগ্রহণ করা এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় দূরীভূত করা।’ সমবায়ের মাধ্যমে একে অপরকে সহযোগিতা করে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধন ইসলামের অন্যতম দর্শন।
সমবায়ের মাধ্যমে সংকটকালে আন্তরিকতার সঙ্গে অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়া যায়। একজনের বিপদাপদে যখন অন্যজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তখন তার জন্য নির্ধারিত হয় বিরল মর্যাদা
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে বলেন, ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যকে সাহায্য করবে না। আল্লাহকে ভয় করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।’ (সুরা-৫ মায়িদা, আয়াত: ২) ‘নিশ্চয়ই যারা স্বীয় দ্বীনকে খণ্ডবিখণ্ড করেছে এবং অনেক দল হয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই।’ (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১৫৯)
বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তরুণ বয়সে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে একটি সেবাধর্মী সমবায় সংঘ গঠন করে সমাজের কল্যাণে কাজ করেন। এই সমবায়ের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি ছিল সমাজ থেকে অশান্তি ও অসংগতি দূর করা, নাগরিক ও অভ্যাগতদের জীবন-সম্পদ ও মানসম্মান রক্ষার্থে সদা সচেষ্ট থাকা, বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব স্থাপন করা, অত্যাচারীর হাত থেকে অত্যাচারিত ব্যক্তিদের রক্ষা করা এবং অত্যাচারীকে প্রতিহত করা। এই সমবায় পদ্ধতি একটি অনুকরণীয় আদর্শ।
ইসলামের বিধানাবলি লক্ষ করলে দেখা যায়, এর প্রতিটি বিধান সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠার অনুকূল। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ আদায়, শুক্রবারে জুমার জামাত, দুই ঈদের জামাত, হজের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম সম্মেলন যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঐক্য বিনষ্টকারী বিষয়গুলো—হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা, দ্বন্দ্ব-কলহ, গিবত, অপবাদ, নিন্দাবাদ, অবজ্ঞা, মন্দ ধারণা পোষণ করা, অধীন ব্যক্তিদের কষ্ট দেওয়া, বংশের গৌরব করা, অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা, ঝগড়াবিবাদ, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি সম্পূর্ণ হারাম করা হয়েছে। (সুরা-১০৪ হুমাজাহ, আয়াত: ১-৯)
এর বিপরীতে ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি, ভালোবাসা, পরোপকার, সদুপদেশ, বিপদ-আপদে সাহায্য, সহমর্মিতা, সহাবস্থান, অপরকে অগ্রাধিকার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা, মেহমান, প্রতিবেশী, এতিম, গরিব-মিসকিন, নারীদের অধিকার সুরক্ষা, বড়দের প্রতি সম্মান, ছোটদের প্রতি স্নেহ, রোগীর সেবা, পরস্পরের কল্যাণ কামনা ইত্যাদিকে ইবাদত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
সমবায়ের মাধ্যমে সংকটকালে আন্তরিকতার সঙ্গে অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়া যায়। একজনের বিপদাপদে যখন অন্যজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তখন তার জন্য নির্ধারিত হয় বিরল মর্যাদা। কাউকে ভুল পথে চলতে দেখলে সমবায়ের মাধ্যমে তাকে সতর্ক করা যায়। তাকে কোনো অপকর্মে লিপ্ত দেখে তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নয়; বরং তার সমব্যথী হয়ে সে দোষ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা যায়।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
smusmangonee@gmail.com