জেরাল্ড ফুৎশেক টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনার ইনফরমাটিকসের অধ্যাপক। পরিচয় ২০০৪ সালে এথেন্সে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড ইন ইনফরমেটিকসে, যেখানে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি অংশগ্রহণ করছিলাম। সদালাপী সাদাসিধে মানুষ। যার ফলে প্রতি অলিম্পিয়াডেই তাঁর সঙ্গে ভাবের আদান–প্রদান হয়, আলোচনা হয়।
অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, জাপান, ইরান—সবখানেই আমাদের দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। একবার আমাদের দেশে আসতে দাওয়াত করলাম। তিনি আসতে রাজি হলেন। এর মধ্যে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯। পরিশেষে এ মাসের ১৩ তারিখে তিনি ঢাকা পৌঁছালেন।
বিমানবন্দরে যাতে অনভিপ্রেত বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে না হয়, পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তার প্রটোকল অফিসার দিয়ে নিখুঁতভাবে কাজটি করে ফেললেন। শুধু তা–ই নয়, ওই দিন বিকেলে ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেসে একটি সেমিনারের ব্যবস্থা করলেন।
মানুষকে সহৃদয়ে গ্রহণ করা, সম্মানিত করা এবং সব মানুষের প্রতি তাঁর আন্তরিক ভালোবাসা উপলব্ধি করে অধ্যাপক ফুৎশেক মোহিত হলেন। তাঁকে যে সেমিনার শেষে ক্রেস্ট দেওয়া হলো, তাতে তিনি রীতিমতো উৎফুল্ল। কারণ, তাঁর দেশে এ রকম ঘটা করে এবং অহরহ ক্রেস্ট দেওয়ার সংস্কৃতি নেই।
তিনি আগাগোড়া খ্রিষ্টান হলেও সুফি মিজানের মতোই তিনিও সব ধর্মের প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান ও জাপান এসেছেন। সুতরাং আমাদের দেশের ধর্ম ও আচার–আচরণ তাঁর অজানা নয়।
প্রতি বেলা খাদ্য গ্রহণের আগে ও পরে সুফি মিজান যে প্রার্থনা করেন, তা নাকি অন্যান্য প্রধান ধর্মেও আছে এবং যথারীতি সুফি মিজানকে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই অনুকরণ করলেন। শুধু তা–ই নয়, আমাদের দেশের আতিথেয়তায় যে আন্তরিকতার ও দৈহিক স্পর্শ থাকে, তা–ও তাঁকে বিব্রত করতে পারল না।
অস্ট্রিয়ান অধ্যাপক বাংলাদেশ সফরে এসেছেন, দেশটি দেখবেন এবং আমার আনাড়িপনায় তাঁর যথেষ্ট আস্থা থাকার ফলে তিনি জেরাল্ডকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করলেন। যে কথা সেই কাজ। মুহূর্তের মধ্যেই বিমান ভ্রমণের আয়োজন হলো।
সন্ধ্যায় মিজান ভাই ফোন করে জানালেন বিমানভ্রমণে দেশের কিছুই দেখা যাবে না, তাই হেলিকপ্টারে ভ্রমণের প্রস্তাব করলেন। আমি তো নির্বাক।
পরের দিন ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। গ্রামীণ বাংলাদেশ, নদীনালা, সমতলভূমি, সবুজ শস্য দেখে জেরাল্ড তো মহাখুশি। হেলিকপ্টারে ভ্রমণের সুযোগ তো আর অহরহ হয় না।
হেলিকপ্টার থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা উভয়েই একজন দরজির ফিতায় আবদ্ধ হয়ে গেলাম।
আমাদের দুজনের জন্য একই রকম দুটি সুইট তৈরি করতে হবে। যেহেতু চট্টগ্রামে মাত্র এক দিন থাকব—এর মধ্যেই তা তৈরি করতে হবে বলে তাড়াহুড়া। জেরাল্ড তো সুফি মিজানের তুঘলকি কাণ্ডে রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
১৪ তারিখে আমরা প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত পাই দিবসের (৩/১৪ যা আইনস্টাইনের জন্মদিবস) অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলাম, যেখানে মঞ্চে দু–দুজন একুশে পদকপ্রাপ্ত স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক অনুপম সেন ও সুফি মিজান। আনুষ্ঠানিকতা দেখে জেরাল্ড রীতিমতো তাজ্জব। বাংলা না জানলেও সুফি মিজানের অঙ্গ ও বাচনভঙ্গি ও বক্তব্যের উচ্ছ্বাসে তিনি অভিভূত। সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় ইফতারের দাওয়াত।
দু–তিন ছেলে ব্যবসায়ের কাজে বিদেশে থাকলেও ৩০ জন উপস্থিত। জেরাল্ড যখন জানল এরা সবই সুফি মিজানের ছেলে, তাদের স্ত্রী ও নাতি–নাতনি—তিনি রীতিমতো আশ্চর্য। এতজন একই ছাদের নিচে প্রতিদিন ইফতারের সময় একসঙ্গে বসে। পুত্রবধূরা সবাই সবজি দিয়ে খাবার তৈরি করে এনেছেন, যেহেতু অতিথি নিরামিষভোজী, কোনো মাছ–মাংস নেই।
জেরাল্ড এই সম্মান প্রদর্শনে রীতিমতো আবেগাপ্লুত। সুফি মিজান তাঁকে খাইয়েও দিলেন। এরপর যন্ত্রসংগীত ও গানের আসর যেখানে, তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও অংশগ্রহণ ছিল। এরপর আমরা হোটেল পেনিনসুলার দিকে রওনা হলাম।
মধ্যরাতে ইউআইটিএসের ফার্মেসির চেয়ারম্যান মোফাজ্জল সাহেব জানালেন যে এখনই তাঁর সঙ্গে যেতে হবে। আমার সমস্যা নেই কিন্তু ইউরোপের একজন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপককে মধ্যরাতে বাইরে যেতে কীভাবে বলি। আশ্চর্য, তাঁকে ডাকতেই তিনি উঠে পড়েছেন, সুফি মিজানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে নেই। আমরা গেলাম লোকারণ্য একটি বাটার দোকানে।
সেখানে অবস্থানকারী সবাইকে সুফি সাহেব জুতা কিনে দিলেন, আমাদেরকেও ঠিক একই রকম। পাশের একটি সংগঠনের অফিসে দাওয়াত করলে ভেতরে গিয়ে যখন দেখলেন অনেক গরম, তাদের একটি এয়ারকন্ডিশনার কিনে দিলেন। স্বভাবতই জেরাল্ড রীতিমতো ঘোরের মধ্যে। তাঁদের দেশে এ রকম একজন মানুষ নেই—এ রকম ঘটনা নেই।
এসওএস শিশুপল্লীর জনক একজন অস্ট্রিয়ান এবং সেই প্রোগ্রাম বিশ্বের ৭০–৮০টি দেশে চলমান। জেরাল্ড সেই প্রোগ্রামে খুলনায় অর্থায়ন করেন। তাঁর এসওএস শিশুপল্লি দেখার শখ; যদিও তিনি জানেন, যে মেয়েটির জন্য অর্থায়ন করে থাকেন, তাকে তিনি দেখতে পারবেন না।
সুফি মিজানের সুবাদে আমরা চট্টগ্রাম শিশুপল্লি দেখতে পারলাম। তিনি শিশুপল্লীর জন্য অনেক ফল নিয়েছেন। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কর্মকর্তারা তাঁকে দেখে খুশি। মনে হলো এখানে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত। শিশুরাও তাঁকে দেখে খুশি, শুধু একটি আপত্তি, তিনি দীর্ঘদিন তাদের দেখতে আসেন না। এরপর জানলেন, পল্লিতে সব মিলে মোট কতজন থাকে, তত হাজার টাকার একটি চেক লিখে দিলেন। একদিন পিএইচপি ফ্যামিলির প্রাঙ্গণে তাঁদের সবাইকে ইফতার করার জন্য নিয়ে যাবেন, তা–ও নিশ্চিত করলেন। ওই দিন জেরাল্ডকে কর্ণফুলী টানেলও দেখানো হলো।
এরপর আমরা ফিরে এলাম চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে যেখানে সুফি মিজান একজন গুরুত্বপূর্ণ স্পনসর। কিছুদিন আগে তাঁর পরিবারের সদস্যরা এই হাসপাতাল দেখতে এসে দাতাদের তালিকায় তাঁর নামে না দেখতে পেয়ে হতাশ। অবশ্য সুফি মিজান হতাশ নন। তিনি আজ এলেন আরও ৫ কোটি টাকা দান করার জন্য। দানের চেক হস্তান্তর করতে জেরাল্ডের হাত ব্যবহার করা হলো।
এরপর আবার সুফি মিজানের বাসায় ইফতার একই রকমভাবে সব সদস্যের অংশগ্রহণে। এভাবে দুই দিনের সফর শেষে আমরা ঢাকা প্রত্যাবর্তন করলাম।
শনিবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা শেষে আমাদের ম্যাথ ক্যাম্পে চলে গেলাম মোহাম্মদপুর। সেখানে ক্যাম্পে ৩০ জন ছাত্র গণিতের দক্ষতা বাড়াচ্ছে জেনে তিনি খুশি। অস্ট্রিয়ার জনসংখ্যা মাত্রই ১ কোটি আর আমাদের ১৭ কোটি। আমাদের ছাত্রদের জ্ঞানপিপাসা তাকে নাড়া দিয়েছে। তিনি নতুন চালু করা বেব্রাস প্রতিযোগিতা সম্পর্কে বললেন, যা এ পর্যন্ত ৭০–৮০টি দেশে সূচনা করা সম্ভব হয়েছে।
এই প্রতিযোগিতা অন্যান্য অলিম্পিয়াডের মতো শুধু মেধাবী ছাত্রদের লক্ষ্য করে নয়, সমাজের সব শ্রেণির কিশোর, তরুণ, যুবক, মধ্যবয়সী কিংবা প্রৌঢ়দের মস্তিষ্ককে আরও একটু সক্রিয় করার জন্য নানা নতুন নতুন সমস্যা তারা তৈরি করে থাকে।
বুয়েটের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক সোহেল রহমান উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু কোভিড ১৯ ও অন্যান্য কারণে অগ্রসর হতে পারেননি। পৃথিবীর টেকসই ও সুষম উন্নয়নের জন্য জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে শুধু বিশেষভাবে মেধাবীদের নয়, সব মানুষকে আরও চৌকস হতে হবে।
আশা করি, আগামী দিনে সর্বস্তরের মানুষের বুদ্ধিমত্তা বাড়াতে আমাদের দেশেও এই কর্মসূচির সূচনা হবে।
রোববার আমাদের গন্তব্য খুলনা, যেখানে জেরাল্ড এসওএস শিশুপল্লীতে ও একজন মেয়েকে অর্থায়ন করে থাকেন। এবার আমাদের পথপ্রদর্শক হলো চৌকস কম্পিউটার বিশারদ ও তরুণ উদ্যোক্তা আজমত ইকবাল (সজল)।
পদ্মা সেতুর আগে ও পরে গড়া বিশ্বমানের রাস্তা দেখে এই ইউরোপিয়ান অধ্যাপক রীতিমতো অভিভূত। এসওএস শিশুপল্লিতে শিশুদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসিখুশি ও ক্রীড়ারত দেখে তিনি খুবই খুশি। তাদের অত্যন্ত পরিষ্কার প্রাঙ্গণ ও ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার ফল দেখে তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন।
ক্যাম্পাসের নীতিমান প্রধান ওই মেয়েকে দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করলেও যথাসম্ভব ঘুরে ঘুরে দেখালেন। এরপর আমরা ডুমুরিয়াতে সজলের উদ্যোগে তৈরি খামারে গেলাম। সেখানে প্রায় প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা হাজার হাঁসের বিচরণ উপভোগ করলেন। তিনি মধ্যাহ্নভোজও করলেন। এরপর সন্ধ্যায় আমরা ঢাকা ফিরে এলাম কোনো যানজটের কবলে না পড়েই।
সোমবার আইইউবিএটিতে সকালে জেরাল্ড সেমিনার দিলেন। তিল ধারণের স্থান নেই। ছাত্রদের মধ্যে এই উৎসাহ দেখে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর দারুণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হলো। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেলা দুইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার।
মঙ্গলবার জেরাল্ড গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে সেমিনার, যেখানেও ছাত্রদের উপস্থিতি প্রত্যাশাকে অতিক্রম করেছে। বুধবার সকালে সুফি মিজান তাঁর গ্রামের বাড়ি কাঞ্চনে অবস্থিত হাইস্কুলে হাজার ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের উপস্থিতিতে একটি সভার আয়োজন করলেন, যেখানে জেরাল্ডের অভিভূত হওয়ার অনেক উপাদানই ছিল।
সভা শেষে স্কুলের ছাত্রদের ব্যবসা করার জন্য কাউকে মুরগি, কাউকে ছাগল এবং সবার জন্য ১০ লাখ টাকার চেকও প্রদান করলেন। ব্যবসায় সফল হলে ৫০ লাখ টাকে দানের প্রতিশ্রুতিও দিলেন। জেরাল্ডের ফিরতি ভ্রমণের সময় ঘনিয়ে এল। এবার সুফি মিজান জেরাল্ডকে হোটেল ওয়েস্টিনে একটি নৈশভোজে আমন্ত্রণ করলেন। ৫০ জন অতিথির সামনে আবার তাঁকে সম্মানিত করা হলো।
জেরাল্ড অতিসাধারণ মানুষ। হোটেলে না থেকে তিনি আমার বাসায় থেকেছেন। বাংলাদেশের মানুষের আচার–ব্যবহার ও আন্তরিকতা পেয়ে অভিভূত হয়েছেন, যদিও তা সুফি মিজান ফ্যাক্টর দিয়ে বহুগুণ হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে আমাকে বলেছেন যে বাংলাদেশে তাঁর এই সফরটি, সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সুফি মিজানের আন্তরিকতা, তাঁর আগ্রহ তাঁর আজীবন মনে থাকবে।
শুধু এবারই নয়, ২০২৩ সালের শুরুতে আমাদের এক কানাডিয়ান আত্মীয় ম্যাডলিনকেও তাঁর অতিথিপরায়ণতা দিয়ে অভিভূত করেছেন। আমার মনে হয় জেরাল্ডের এই ভ্রমণে সুফি মিজানের অতিথিপরায়ণতা এবং সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কর্মতৎপরতা বাংলাদেশ সম্পর্কে অস্ট্রীয় এই অধ্যাপক এবং তাঁর বন্ধুমহলে অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টি তৈরিতে প্রশংসনীয় অবদান রাখবে।
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে সুফি মিজানের মতো আরও অনেক ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন।
একজন মানুষের গুণাবলি, কর্মতৎপরতা একটি গোটা দেশের ভাবমূর্তি কী পরিমাণ উন্নত করতে পারে, তা কানাডীয় অতিথি ম্যাডলিন ও জেরাল্ডের অভিব্যক্তি থেকে সহজেই অনুমেয়।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফেলো