উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, পরিবহন, কৃষি ও নির্মাণ। এই পাঁচটি খাতই জিডিপির প্রাণ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপিতে এদের অবদান ছিল ৬৭ শতাংশ। জিডিপির হিসাব ধরা হয় কৃষি ও শিল্পে উৎপাদিত পণ্য সেবা সৃষ্টি হয়ে কত টাকার মূল্য সংযোজন করে, সেটাই জিডিপি। কৃষি, শিল্প ও সেবা হিসাব করা হয় আবার ১৫টি খাত ধরে।
২০১৮ সালে সেবা, শিল্প আর কৃষিতে জিডিপি এসেছে যথাক্রমে ৫২ দশমিক ১১, ৩৩ দশমিক ৬৬ ও ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে কৃষিতে জিডিপির অবদান ছিল ৩৩.২১ শতাংশ, শিল্পে ছিল ১৭.০৮ শতাংশ। তবে সেবা খাত ৪৯.৭২ শতাংশ নিয়ে প্রায় একই ছিল। অর্থাৎ শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। অথচ কুড়িগ্রাম জেলায় নতুন শিল্প তো হয়ইনি, উল্টো আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। সেবা খাতেও একই দশা। অর্থাৎ গোটা দেশ যেখানে এগিয়ে গেছে, কুড়িগ্রামের সেখানে উল্টো যাত্রা হয়েছে। চিলমারী-বাহাদুরাবাদ ফেরি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। চিলমারী থেকে চলাচল করত যে চারটি লোকাল ট্রেন, সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কৃষিতেও বেহাল দশা যে নেমেছে, তা বোঝা যায় বিশাল হাটগুলোর ভগ্ন দশা দেখে। ফলে কুড়িগ্রাম জেলা থেকে জনসংখ্যা অন্য জেলাগুলোয় ছড়িয়ে পড়েছে।
উৎপাদন খাতে ছোট-বড় কারখানাগুলোই মূল। জিডিপিতে এই খাতের অবদান ২৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। এখানে প্রবৃদ্ধির হার ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে পরিবেশের বারোটা বাজানো সান ড্রিঙ্কিং লিমিটেড কোম্পানি ছাড়া বাকি দুটি মাঝারি শিল্প হচ্ছে নাগেশ্বরীর একটি অটো রাইস মিল ও বিসিকের অভ্যন্তরের জুট প্রসেসিং ওয়ার্কশপ। আর দাসেরহাটের স্পিনিং মিল ও শহরের টেক্সটাইল মিলটি বন্ধ হয়ে আছে। বৃহৎ শিল্প কুড়িগ্রামে নেই।
খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় অষ্টমীর চরের মনজু ভাইয়ের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বিক্রিও জিডিপির অন্তর্ভুক্ত। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপিতে এই খাত ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩.৯২ শতাংশ। আগের বছরের চেয়ে ১১ হাজার কোটি টাকা বেশি। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় কুড়িগ্রাম জেলা এখানেও পিছিয়ে।
ব্রহ্মপুত্রের খনিজ সম্পদ কবে ব্যবহার হবে কাচ তৈরিতে, তা আল্লাহ মালুম। প্রভাবশালীরা ডিমের উৎস কোলাগুলো ইজারা নিয়ে ধ্বংস করছে। সাধারণ মানুষের আমিষের চাহিদার কথা কেউ ভাবে না। ফলে নদ–নদীময় কুড়িগ্রামের বাসিন্দারা গোটা দেশবাসীর গড় মাছ ভোগের চেয়ে কম মাছ খায়।
রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নভেম্বর ২০২০ সালে এই খাতের ওপর ভর করেই রিজার্ভ দাঁড়িয়েছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার। জিডিপিতে এই খাতের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে শুধু মৌলভীবাজারেই ৪ হাজার ২৩০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স এসেছে। যেখানে চট্টগ্রাম বিভাগে প্রবাসী শ্রমিক ৩৯ শতাংশ আর আয় ৪২ শতাংশ, সেখানে রংপুর বিভাগে অভিবাসী শ্রমিক মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ আর আয় ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। কুড়িগ্রাম জেলায় তা আরও কম।
পরিবহন খাত গত বছর ১ লাখ ১৭ হাজার ৫০ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন করেছে। যার মধ্যে নৌপথ থেকে মাত্র ৭ হাজার কোটি টাকা। কুড়িগ্রাম জেলার সীমানায় ঢাকা বিভাগ। অথচ ঘাট খাজনা না থাকলে ১০০ টাকার জায়গায় ৫ টাকায় বা ফেরি যোগাযোগ চালু থাকলে প্রায় মুফতে চিলমারী থেকে রৌমারী যাওয়া যেত। আর সড়কপথ উন্নত থাকলে রৌমারী থেকে ঢাকা মাত্র ৪ ঘণ্টার দূরত্ব। ফলে কোনো কুড়িগ্রামবাসী ১১ ঘণ্টার ট্রেন আর দুই দিনে সড়কপথ হয়ে ঢাকা পৌঁছায়? এত দূরত্ব নিয়ে পরিবহন খাত কী ভূমিকা রাখবে কুড়িগ্রামে?
কৃষি ও বনায়ন খাত থেকে জিডিপি আসে ১০ শতাংশের বেশি। টাকার অঙ্কে ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা। অন্য দিকে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্রের উজানে ভারতের গোয়ালপাড়ায় ভারতের অন্যতম বৃহৎ সংরক্ষিত বন। কিন্তু কুড়িগ্রাম জেলায় বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে প্রাকৃতিক বন গড়ে উঠতে দেওয়া হয় না। এজমালি গোচারণভূমিগুলো প্রভাবশালীরা ভূমিহীন দেখিয়ে আবাদ করছে। ফলে একদিকে গরু-মহিষের বাথান গড়ে উঠছে না, আরেক দিকে নিম্নবিত্তদের জ্বালানির ও জীববৈচিত্র্য সংকট ঘটছে। প্রাকৃতিক মাছের উৎসও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
নির্মাণ খাতে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট থেকে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের মতো নির্মাণযজ্ঞ জিডিপিতে ভূমিকা রাখছে, যা জিডিপির ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। একদিকে কুড়িগ্রামে ৭১ শতাংশ দরিদ্র মানুষ থাকায় বাড়িঘর তেমন গড়ে ওঠে না, অন্যদিকে বড় কোনো নির্মাণকর্ম না থাকা। অন্যান্য জেলায় যেখানে গড়ে দুটি করে বিশ্ববিদ্যালয় মানের প্রতিষ্ঠান, সেখানে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসই শুরু হলো না। চিলমারী-হরিপুর সেতুর কাজ ১৫ বছর ধরে চলছে। স্থানীয় নেতৃত্বকে উদ্দেশ করে খোদ প্রধানমন্ত্রীই বলেছেন, এরা চাইতে জানে না। কিন্তু তিনি পার্টির কর্মীদের নেতা বাছাইয়ের সুযোগ দিয়েছেন?
আবাসন, স্বাস্থ্য ও সামাজিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা, জনপ্রশাসন, ব্যাংক-বিমা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সরবরাহ, তেল-গ্যাস-খনিজ এবং মৎস্য খাত। গত ১৯১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপিতে ৩ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা মূল্য সংযোজন করেছে। কুড়িগ্রাম জেলায় এই খাতের কী পরিস্থিতি, তা জানা মুশকিল। তবে ব্যাংক-বিমার ক্ষেত্রে বলা যায়, আগে যেসব প্রতিষ্ঠান ছিল, সেগুলোর শাখা কমে গেছে। জনতা-রূপালী তাদের শাখা কমিয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের খনিজ সম্পদ কবে ব্যবহার হবে কাচ তৈরিতে, তা আল্লাহ মালুম। প্রভাবশালীরা ডিমের উৎস কোলাগুলো ইজারা নিয়ে ধ্বংস করছে। সাধারণ মানুষের আমিষের চাহিদার কথা কেউ ভাবে না। ফলে নদ–নদীময় কুড়িগ্রামের বাসিন্দারা গোটা দেশবাসীর গড় মাছ ভোগের চেয়ে কম মাছ খায়।
আর আছে অনানুষ্ঠানিক খাত। ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ যে শ্রমশক্তি এই খাতে আছে, তাদের যেহেতু হিসাব নেই, ফলে তাদের কথা আলোচনায় না আনাই ভালো। ২০০০ সালে এই খাতের কর্মসংস্থানের হার ছিল ৭৫ শতাংশ, সেখানে ২০১০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তার মানে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের চেয়ে সমাজের নিজস্ব শক্তিই দিন দিন ভূমিকা বাড়াচ্ছে। যে দেশীয় জাতের তুলা উৎপাদন করা গেলে, স্থানীয় প্রযুক্তির চরকা দিয়ে তুলা থেকে সুতা আর সুতা থেকে কাপড় উৎপাদন করা গেলে আর বাজার ধরা গেলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে চ্যালেঞ্জ করা যায়। এতে কৃষকের ঘর কারখানা হয়ে পুঁজি অনুভূমিকভাবে সমাজের সবার মধ্যে ছড়ালেও দারিদ্র্য দূরীকরণ হলেও পিরামিডের মতো একজন ব্যক্তি শীর্ষ পুঁজিপতি হয়ে উঠতে পারবে না বলেই হয়তো তুলার আবাদ হবে না।
২০২০ সালে প্রকাশিত বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক সারণিতে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ অতি তীব্র বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে আর ১৮ দশমিক ২ শতাংশ ঝুঁকিতে আছে। মোট ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। আর কুড়িগ্রামে এই হার ৮০ শতাংশের কাছাকাছি।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) ১৯ জানুয়ারি ২০২০ সালে সামাজিক উত্তরণ সূচক প্রকাশ করেছে। ১০টি উপসূচক দিয়ে সামাজিক উত্তরণ সূচক তৈরি করেছে সেখানে। এগুলো হচ্ছে স্বাস্থ্য, শিক্ষার সুযোগ, মান ও সমতা, জীবনভর শিক্ষার সুবিধা, প্রযুক্তির লভ্যতা, কাজের সুযোগ, ন্যায্য মজুরি, কাজের পরিবেশ, সামাজিক সুরক্ষা ও সরকারি সেবার বিস্তৃতি। কুড়িগ্রামবাসী এই উপসূচকগুলো কবে এই উত্তরণ ঘটাবে?
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক। ইমেইল: nahidknowledge1@gmail.com