মতামত

আমাদের নগর কেন এমন মৃত্যুকূপে পরিণত হলো?

গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারের ভবন বিস্ফোরণের ঘটনায় ভবনের অধিবাসীদের বাইরেও হতাহত হয়েছেন পথচারী, বাসের যাত্রী, রিকশা-ভ্যানের যাত্রী।
ছবি : প্রথম আলো

আমাদের নগর এলাকাগুলো এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুকূপ। সড়ক-ফুটপাত, মসজিদ-উপাসনালয়, আবাসিক ভবন-শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক ভবন-বিপণিবিতান কিংবা খাবারের রেস্টুরেন্ট—এই নগরে কোনো কিছুই আর আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নগর এলাকায় বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ড কিংবা ভবন বিস্ফোরণে এই চরম সত্যটা আমাদের এসব নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারের ভবন বিস্ফোরণের ঘটনায় ভবনের অধিবাসীদের বাইরেও হতাহত হয়েছেন পথচারী, বাসের যাত্রী, রিকশা-ভ্যানের যাত্রী। কেউ কেউ দোকানে এসেছিলেন কেনাকাটা করতে। সবাইকেই এক নির্মম পরিণতির শিকার হতে হয়েছে।

নগরের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এখানে মানুষের বসবাস তথা জনঘনত্ব বেশি থাকে, বহুতল ভবনের আধিক্য আর সঙ্গে থাকে বিবিধ ধরনের অর্থনৈতিক-সামাজিক ও বিবিধ কর্মকাণ্ডের সমাহার। ফলে নগরে জীবনযাপনকে নিরাপদ করতেই রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নগর সংস্থা থাকে, যাদের মূল দায়িত্ব হলো নগরে ভবন, সড়ক ও বিভিন্ন পরিসরে জীবনকে নিরাপদ করার জন্য ইমারত, পরিষেবা ও নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর নিয়মিত পরিদর্শন, রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির সার্বিক দায়িত্ব পালন করা, যা নগরে মানুষের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করে।

অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঢাকার বিভিন্ন নগর এলাকায় নিয়ন্ত্রণহীণভাবে ভবনের মিশ্র ব্যবহারের কারণে একই ভবনের বিভিন্ন তলায় খাবারের রেস্টুরেন্ট, রাসায়নিক বা বিভিন্ন দাহ্য বস্তুর গুদাম, শিল্পকারখানা ও আবাসিক বসবাস। সব মিলিয়ে যেকোনো মুহূর্তেই যেকোনো ধরনের অগ্নিকাণ্ডে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা আছে ভয়ানক। বিগত বছরগুলোতে জলাশয়-জলাভূমি ভরাট করে এবং ইমারত নির্মাণের আইন ও বিধিবিধান উপেক্ষা করে ভবন নির্মিত হয়েছে। এসব ভবনে বসবাসকারী মানুষেরা ভূমিকম্প বা ভূমিধসসহ যেকোনো দুর্যোগে জীবনের ঝুঁকিতে রয়েছেন।

আমাদের অনেক বিদ্যালয়, হাসপাতালসহ অনেক সামাজিক অবকাঠামো পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন দুর্যোগ ঝুঁকিতে আছে। গলির সরু রাস্তার পাশে বিগত দুই দশকে যেভাবে বহুতল ইমারত গড়ে উঠেছে, সেখানে অগ্নিকাণ্ড কিংবা যেকোনো দুর্যোগে ফায়ার সার্ভিস গিয়ে উদ্ধারকর্ম চালানোর সুযোগও অত্যন্ত কম। ঢাকার নিম্নবিত্ত এলাকা ও বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঘটনায় অতিদরিদ্র ও ভাগ্যবিড়ম্বিত লোকেরা তাঁদের সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন।

নগরের বিভিন্ন সেবা সংস্থা, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষগুলোকে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব। বিভিন্ন ভবন বিস্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভবনমালিকের দায় নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়, কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, যাঁদের তদারকির গাফিলতিতে আমাদের জীবন এভাবে অনিরাপদ ও মূল্যহীন হয়ে পড়েছে, তাঁদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনাও অত্যন্ত জরুরি।

নগরে জীবনযাপন এখন উচ্চবিত্ত এলাকার জন্যও ঝূঁকিপূর্ণ, যার প্রমাণ রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের গুলশানের অগ্নিকাণ্ড কিংবা বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়। জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য যেসব শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি, জেনারেটরসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি আমরা ব্যবহার করছি, তা–ই আমাদের প্রাণনাশের কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। এসির ব্যবহারের কারণে দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-কারখানা কিংবা আবাসিক ভবন—সবকিছুতেই প্রাকৃতিক আলো–বাতাস প্রবেশের সুযোগ রুদ্ধ করে দেওয়ার পর দরজা-জানালা বন্ধ করার মাধ্যমে আমাদের গ্যাস জমে ঘনীভূত হওয়ার সুযোগ তৈরি করছি, যা বিস্ফোরণের শঙ্কা তৈরি করছে।

ভবনে নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত করতে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, এসি, ড্রেনেজ, সুয়ারেজ প্রভৃতি পরিষেবার সংযোগ ও নেটওয়ার্কের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা অত্যাবশ্যক। ভবনমালিক ও বসবাসকারীদের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের এবং সেবা সংস্থাগুলোর নিয়মিত তদারকির অভাবের ফলে ভবনে যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের দুর্যোগ—অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। অবৈধ গ্যাস–সংযোগ আর সেখান থেকে সৃষ্ট গ্যাস লিকেজ নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক রিপোর্ট হয়েছে, কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে সামান্যই।

আমাদের রাজধানীতে যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, তার অনেকাংশ সিটি করপোরেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ল্যান্ডফিল সাইটে চলে গেলেও অনেক বর্জ্যই শহরের বিভিন্ন জায়গায় স্তূপ করে রাখা হচ্ছে, যেখান থেকে মিথেন গ্যাস তৈরি ও জমা হচ্ছে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি করছে। নগরের আবাসিক এলাকায় অনুমোদনহীনভাবে অনেক শিল্পকারখানা তৈরি হয়েছে, যেগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ইমারত, শিল্প, নিরাপত্তা, পরিবেশসংক্রান্ত আইনের প্রতিপালন হচ্ছে না। এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা অতিদারিদ্র্যের কারণে যেমন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, তেমনি এর আশপাশে বসবাসরত হাজারো মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকিতে আছেন।

রাজধানীতে মানুষের জীবনের ঝুঁকি এখন শুধু শিল্পকারখানার অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ নয়; আবাসিক ভবন থেকে মসজিদ, সড়ক পরিবহন থেকে ফুটপাত, বস্তি থেকে উচ্চবিত্ত এলাকার বহুতল ভবন, বিপণিবিতান থেকে বাণিজ্যিক ভবন—সর্বত্রই এখন জীবন নিয়ে শঙ্কা। নগর পুড়লে দেবালয়ও বাদ থাকবে না—অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীন নগরায়ণের এটাই বোধ হয় অনিবার্য পরিণতি। আর তাই নগর এলাকায় স্বাভাবিক মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা তীব্র হলেও নিশ্চয়তা নেই কোথাও। নিরাপদ নগর তৈরি না করতে পারলে বিচ্ছিন্নভাবে কারোরই স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার তাই নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না।

আমাদের জীবনকে নিরাপদ করতে ভবনমালিক কিংবা ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকদের আইন প্রতিপালনে বাধ্য করার জন্য রাষ্ট্রের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে নগরের বিভিন্ন সেবা সংস্থা, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষগুলোকে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করাও রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব। বিভিন্ন ভবন বিস্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভবনমালিকের দায় নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়, কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, যাঁদের তদারকির গাফিলতিতে আমাদের জীবন এভাবে অনিরাপদ ও মূল্যহীন হয়ে পড়েছে, তাঁদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনাও অত্যন্ত জরুরি।

ড. আদিল মুহাম্মদ খান নগর–পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক