ন্যাটো জোটের সামরিক মহড়া স্টিডফাস্ট ডিফেন্ডার ২০২৪ মে মাস পর্যন্ত চলবে
ন্যাটো জোটের সামরিক মহড়া স্টিডফাস্ট ডিফেন্ডার ২০২৪ মে মাস পর্যন্ত চলবে

মতামত

রাশিয়ার ঘরের কাছে ন্যাটো কেন সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া করছে

গত সপ্তাহটা ছিল ন্যাটোর জন্য বড় কিছু। কয়েক মাসের গড়িমসির পর অবশেষে তুরস্কের পার্লামেন্ট ন্যাটো জোটে সুইডেনের প্রবেশের অনুমোদন দেয়। সুতরাং সুইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হলে ন্যাটো হবে ৩২টি দেশের জোট।

এরপরেই আঙ্কারায় অবস্থিত তুরস্কের পার্লামেন্টের আট হাজার কিলোমিটারের চেয়েও বেশি দূরের ভার্জিনিয়ার নকফোক বন্দর ছেড়ে ইউরোপের দিকে রওনা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বিশালাকার যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস গানস্টন হল।  যুদ্ধজাহাজটির এই যাত্রার মধ্য দিয়ে ন্যাটো জোটের সামরিক মহড়া স্টিডফাস্ট ডিফেন্ডার ২০২৪-এর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। শীতল যুদ্ধের পর ন্যাটোর সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া এটি।

এই মহড়ার উদ্দেশ্য হলো, কোনো একটি সদস্যদেশ শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে ন্যাটো তাতে কীভাবে সাড়া দেবে, সেটা পরীক্ষা করা। জোটের যে যৌথ প্রতিরক্ষা বিধি (আর্টিকেল-৫) রয়েছে, তা কীভাবে সক্রিয় করা যায়, তারও একটা পরীক্ষা হবে মহড়াটি।

ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া মহড়াটি আগামী মে মাস পর্যন্ত চলবে। ৯০ হাজারের বেশি সেনা এতে অংশ নেবেন। হাজার হাজার সামরিক সরঞ্জাম থাকবে। ন্যাটোর প্রতিটি সদস্যদেশ মহড়ায় অংশ নেবে। উত্তর ও পূর্ব ইউরোপে মহড়াটি অনুষ্ঠিত হবে।

১৯৮৮ সালের পর এটাই ন্যাটোর সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া। শীতল যুদ্ধের শেষ সময়ের অনিশ্চয়তার সেই কালে ন্যাটোর ১ লাখ ২৫ হাজারের বেশি সেনা যৌথ প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে বড় মহড়াটি অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৮ সালে। কিন্তু সেই মহড়ায় ন্যাটোর অর্ধেক দেশ অংশ নেয়নি।

এবারের মহড়ায় ন্যাটো মূলত পূর্ব ইউরোপকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। ২০১৮ সালের মহড়ায় দক্ষিণ ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ঘিরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবারের মহড়াটি উত্তর ও পূর্ব ইউরোপে হওয়ার তাৎপর্য অনেক। প্রকৃতপক্ষে ইউএসএস গানস্টন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল ছেড়ে আসার পর প্রথম নোঙর করবে নরওয়ের বন্দরে।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রাশিয়া এখন তার প্রতিরক্ষাশিল্পের প্রসার ঘটাচ্ছে। ফলে আরও যুদ্ধ সন্নিকটে। এ প্রেক্ষাপটে ন্যাটো যদি বড় ধরনের সামরিক মহড়ার আয়োজন না করত, সেটা জোটটির জন্য দায়িত্বহীনতার কাজ হতো।

সেখান থেকে নরওয়ে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সেনাদের জাহাজে তোলা হবে প্রশিক্ষণ দেওয়া জন্য। এসব ঘটনা ন্যাটোর জন্য গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ফিনল্যান্ড এখন ন্যাটোর সদস্য আর সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দিতে চলেছে। আর্কটিক মহাসাগরীয় অঞ্চলের আটটি দেশের সাতটিই এখন ন্যাটোর নিরাপত্তার ছাতার নিচে চলে এল।
এ ছাড়া যে সময়ে মহড়াটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেটা কাকতালীয় কোনো ব্যাপার নয়।

ন্যাটো প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর হতে যাচ্ছে এ বছর। এ উপলক্ষে জুলাই মাসে ওয়াশিংটনে ন্যাটোর বিশাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেই সম্মেলনের আগে বিশাল এই সামরিক মহড়া ন্যাটোর জোটের সদস্যদেশগুলোর নীতিনির্ধারক ও জনসাধারণকে যে বিষয় মনে করিয়ে দেবে, তা হলো বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য ন্যাটোর উপযোগিতা ও প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

এই বছর মানে ২০২৪ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ওয়ারশ চুক্তির আওতাধীন দেশ বুলগেরিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়ার ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার ২০ বছর পূর্তি হবে। ন্যাটোর এই দেশগুলো বাইরের থেকে আগ্রাসনের শিকার হওয়ার সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে রয়েছে। এ কারণেই এবারের মহড়া সময়োচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ।

অবশ্যই ২০২৪ সালটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বছর। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিবিদদের অনেকে ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের সদস্যপদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আর ডেমোক্র্যাটরা একুশ শতকের উপযোগী করে ন্যাটোকে প্রস্তুত করে তোলার ক্ষেত্রে তেমন নতুন কোনো ধারণা আর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

আমরা কেবল এই আশা করতে পারি যে ন্যাটোর এ ধরনের বড় সামরিক মহড়া যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদেরা উপলব্ধি করতে পারবেন।

ন্যাটোকে সমর্থন দেওয়ার কাজটি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের জন্য মোটেই তুচ্ছ কোনো কাজ নয়। ইউরোপ আমেরিকার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বাজার। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি স্টেটের মধ্যে ৪৫টি স্টেট চীনের চেয়ে ইউরোপের বাজারে বেশি রপ্তানি করে। এতে লাখ লাখ মার্কিনের কর্মসংস্থান হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উৎস ইউরোপ। আবার ন্যাটো জোট আমেরিকা মহাদেশের স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ন্যাটো নিয়ে যে বিতর্ক উসকে উঠছে, তাতে আমেরিকান জনসাধারণের উচিত ন্যাটোর গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া।

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধই এত বড় সামরিক মহড়ার পেছনে ন্যাটোর মূল তাগিদ সৃষ্টি করেছে। ওই অঞ্চলের বাইরের মানুষের কাছে পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ সত্যিকারভাবেই উদ্বিগ্ন যে তারা রাশিয়ার পরের আগ্রাসনের শিকার হবে কি না।

ন্যাটোর হাজার হাজার সেনা স্টিডফাস্ট ডিফেন্ডার ২০২৪-এ প্রশিক্ষণ মহড়ায় অংশ নেওয়ার কারণ অবশ্যই এটা নয় যে তাঁরা প্রতিবেশী দেশে হামলা করবে অথবা আগ্রাসন চালাবে।

বরং, বাইরের কোনো দেশ যদি আগ্রাসন শুরু করে, তাহলে ন্যাটো তার সদস্যদেশকে কীভাবে প্রতিরক্ষা দেবে, তারই প্রস্তুতি এই মহড়া। সম্মিলিতভাবে ন্যাটোর প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা দেবে এই মহড়া।

বড় পরিসরের এই মহড়া ন্যাটোকে সম্মিলিতভাবে প্রতিরক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি করবে। বাইরের আগ্রাসী শক্তির সামনে দুর্বল ও নাজুক দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে ন্যাটোর অঙ্গীকারের বাস্তব প্রকাশ ঘটবে। চূড়ান্ত অর্থে, আগ্রাসী শক্তিকে তাদের আগ্রাসনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য করবে।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রাশিয়া এখন তার প্রতিরক্ষাশিল্পের প্রসার ঘটাচ্ছে। ফলে আরও যুদ্ধ সন্নিকটে। এ প্রেক্ষাপটে ন্যাটো যদি বড় ধরনের সামরিক মহড়ার আয়োজন না করত, সেটা জোটটির জন্য দায়িত্বহীনতার কাজ হতো।

যতক্ষণ পর্যন্ত ন্যাটোর কোনো সদস্যদেশ আগ্রাসী কোনো শক্তির দ্বারা আক্রান্ত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্টিডফাস্ট ডিফেন্ডার ২০২৪ সামরিক মহড়া কারও জন্য হুমকির নয়।

  • লুক কফি যুক্তরাষ্ট্রের হাডসন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো
    আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত