বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

মতামত

নেতানিয়াহু এখন ফেরারি আসামি, এর জন্য তিনিই দায়ী

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কারণে ইসরায়েল এখন আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হওয়ার পথে। কারণ, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং দুই সপ্তাহ আগে বরখাস্ত হওয়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার অভিযোগ আনা হয়েছে। 

আইসিসির সদস্য ১২৪টি দেশ এখন কার্যত এই দুই নেতার জন্য বন্ধ। তাঁরা যদি এই দেশগুলোর কোনো একটিতে যান, তাহলে গ্রেপ্তারের ঝুঁকি থাকবে। যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে জানিয়েছে, তারা আইন মেনে চলবে। অর্থাৎ নেতানিয়াহু বা গ্যালান্ট সেখানে গেলে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে। 

ইসরায়েলের মন্ত্রীরা আইসিসিকে পক্ষপাতদুষ্ট এবং দ্বৈত মানদণ্ডে কাজ করার অভিযোগ করলেও সমস্যার মূল কারণ নেতানিয়াহু নিজেই। আইসিসি সাধারণত এমন দেশগুলোতে হস্তক্ষেপ করে না, যাদের নিজস্ব বিচারব্যবস্থা কার্যকর। এ নীতিকে ‘কমপ্লিমেন্টারিটি’
বলা হয়। 

হামাসের ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর হামলা এবং তার পরবর্তী ঘটনাগুলো নিয়ে একটি রাষ্ট্রীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে সহজ সমাধান হতে পারত। ইসরায়েলের ভেতরেই এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে জোরালো দাবি রয়েছে। কিন্তু নেতানিয়াহু এই তদন্ত শুরু করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ, তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, এই তদন্তে তাঁর দায়িত্বহীনতা প্রকাশ পাবে এবং সবার সামনে পরিষ্কার হবে যে তাঁর দীর্ঘ ১৫ বছরের নেতৃত্বের সময় তিনি ইসরায়েলকে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার মুখে একা ফেলে দিয়েছিলেন। 

তদন্ত না করার মাধ্যমে নেতানিয়াহু নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এর অংশ হিসেবে তিনি সামরিক সাফল্যের কৃতিত্ব দাবি করে যাচ্ছেন। এই অবস্থান ইসরায়েলের পূর্বতন নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত এবং নেতানিয়াহুর অনীহার কারণেই আইসিসির হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। 

আইসিসির বিবৃতিতে স্পষ্ট করা হয়েছে, মামলার মূল বিষয় ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপ নয়; বরং গাজার মানবিক সহায়তার অবরোধই এ মামলার মূল বিষয়। 

আইসিসি বিশ্বাস করে, নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার বেসামরিক জনগণকে তাদের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য, পানি, ওষুধ, জ্বালানি এবং বিদ্যুতের মতো অপরিহার্য জিনিসপত্র থেকে বঞ্চিত করেছেন। 

নেতানিয়াহু এবং তাঁর সমর্থকেরা এখন আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে ‘অন্যায়’ বলে দাবি করছেন। তাঁরা বলছেন, এতে হামাসের বর্বরতার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আইসিসির মামলার মূল কেন্দ্রবিন্দু ইসরায়েলের আত্মরক্ষা নয়, বরং গাজায় সহায়তা সরবরাহ বন্ধ করার বিষয়। 

ইসরায়েলকে গাজার মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করা উচিত ছিল। কারণ, এটি নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক ছিল। আইসিসি বলছে, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল হিসেবে একটি জনগোষ্ঠীকে ‘না খাইয়ে মারার অবস্থা’ তৈরি করা অগ্রহণযোগ্য। 

দ্বিতীয়ত, এটি কৌশলগত দিক থেকে ভুল ছিল। যুদ্ধের শুরুতে, এমনকি মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারাও ইসরায়েলের নেতৃত্বকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাদের যুদ্ধ হামাসের বিরুদ্ধে হওয়া উচিত, গাজার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে নয়। 

খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহের মাধ্যমে ইসরায়েল হামাস এবং সাধারণ গাজাবাসীর মধ্যকার সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারত। কিন্তু ইসরায়েল তা করেনি। বরং তারা গাজার মানুষের জীবন আরও কঠিন করেছে, যা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করেছে। 

আইনি দিক থেকে ইসরায়েলের সাহায্য নিয়ে যথাযথ তদন্তের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। এ ক্ষেত্রে গাজায় ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ চাপানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ মন্তব্য ইসরায়েলের অবস্থানকে দুর্বল করেছে এবং আইসিসি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য যথেষ্ট যুক্তি পেয়েছে। 

ইসরায়েল এবং তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে, আইসিসি তাদের বিরুদ্ধে অবিচার করেছে। তারা বলবে, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র বা ভেনেজুয়েলার মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে আইসিসি কমপ্লিমেন্টারিটি (যে অনুযায়ী একটি দেশের নিজস্ব বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্মান দেখানো হয়) অনুসরণ করে, কিন্তু ইসরায়েলের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। তারা আরও বলবে, গাজায় ত্রাণসামগ্রী পাঠানো সহজ ছিল না বা এখনো সহজ নয়। কারণ, হামাস বা অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সেই ত্রাণসামগ্রী নিজেদের জন্য ছিনতাই করতে পারে। 

এ ছাড়া ইসরায়েল অভিযোগ করবে, হামাসের একজন কমান্ডারকে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের সঙ্গে একই ওয়ারেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত হয়নি। কারণ, তারা মনে করে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং একটি সন্ত্রাসী সংগঠনকে এক পাল্লায় মাপা যায় না। তারা আইসিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে, যথেষ্ট সময় বা বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে প্রধান প্রসিকিউটর করিম খান ইসরায়েলে আসার পরিকল্পনা বাতিল করেছিলেন এবং সিএনএনে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঘোষণা করেছিলেন। তারা করিম খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলবে, করিম নিজেই একটি অভ্যন্তরীণ তদন্তের সম্মুখীন হচ্ছেন, যেখানে তঁার বিরুদ্ধে যৌন অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে। 

নেতানিয়াহুকে হেগের কাঠগড়ায় শিগগিরই দাঁড়াতে হবে—এমন কথা কেউ বিশ্বাস করেন না। বরং এই পদক্ষেপটি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে, যেমনটি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একাধিক অভ্যন্তরীণ অভিযোগের পর হয়েছিল। 

ইসরায়েলের সমর্থক দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, হাঙ্গেরি এবং অন্যরা আইসিসির বিরুদ্ধে দ্বৈত মানদণ্ডের অভিযোগ তোলার পক্ষে যুক্তি দেবে এবং আদালতকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করবে। তারা আইসিসি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অর্থসহায়তা বন্ধ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার হুমকি দিতে পারে। বাইডেন প্রশাসন ইতিমধ্যে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানাগুলোর নিন্দা করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেন। 

তবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সহজে দূর হবে না। গাজা যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনের চারজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমি নিজে কথা বলেছি। এই চারজনই বিশ্বাস করেন, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সম্ভবত ঘটেছে। তবে তাঁরা বলেছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ, অর্থাৎ গণহত্যার অভিযোগ আইনিভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। 

আইসিসির সিদ্ধান্তে তাঁদের এই ধারণা আরও শক্তিশালী হয়েছে। কারণ, তারা কৌঁসুলির করা ‘ধ্বংসের অপরাধ’ (এক্সটারমিনেশন) অভিযোগটি গ্রহণ করেনি। 

নেতানিয়াহুকে হেগের কাঠগড়ায় শিগগিরই দাঁড়াতে হবে—এমন কথা কেউ বিশ্বাস করেন না। বরং এই পদক্ষেপটি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে, যেমনটি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একাধিক অভ্যন্তরীণ অভিযোগের পর হয়েছিল। 

নেতানিয়াহু বলবেন, তিনি বাইরের ঘৃণা ছড়ানো শক্তিগুলোর শিকার। তিনি বলবেন, ইসরায়েল যে বিশ্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে, ইসরায়েল সেই বিশ্বের ঘৃণার শিকার হচ্ছে। তিনি বলবেন, তিনি একাই তার দেশের প্রকৃত রক্ষক এবং দেশের জন্য তিনি নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। 

তবে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বড় প্রভাব থাকবেই। এটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা এবং নিম্নস্তরের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্তের দাবি বাড়াবে। এটি ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা আরও ত্বরান্বিত করবে। 

মনে রাখতে হবে, হামাস ৭ অক্টোবরের হামলার মাধ্যমে ইসরায়েলকে খেপিয়ে তুলতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল, ইসরায়েল খেপে গিয়ে এমন পদক্ষেপ নিক, যা তাদের আন্তর্জাতিক বৈধতাকে নষ্ট করে দেবে। 

সে দৃষ্টিতে দেখলে বলা যায়, নেতানিয়াহু ঠিক তাই দিয়েছেন, যা হামাস চেয়েছিল। হামাস ফাঁদটি পেতেছিল। নেতানিয়াহু ঠিক সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন। 

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড দ্য গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া; ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ