ভুল নীতির কারণে বিদ্যুতের এ সংকট অনিবার্য ছিল

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। সাবেক বিদ্যুৎ–সচিব। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বেসরকারি খাতে অবকাঠামো উন্নয়ন অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান ইডকলের প্রথম পূর্ণকালীন সিইও হিসেবে তিনি এর ভিত গড়েন। তাঁর লেখা (সহলেখক বব পারার) বই ফাইন্যান্সিং লার্জ প্রজেক্ট পিয়ারসন কর্তৃক প্রকাশিত ও চীনা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর দ্বিতীয় বই উইন-হাউ পাবলিক এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ক্যান ট্রান্সফর্ম দ্য ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ড ফরাসি ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন দেশের বর্তমান বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ও জ্বালানি খাত নিয়ে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান
প্রশ্ন

বর্তমান সরকার তাদের অন্যতম সাফল্য হিসেবে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নকে বিবেচনা করে থাকে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে এবং সরকারের তরফে শতভাগ বিদ্যুতায়নের দাবিও করা হয়েছে। অথচ এখন মাত্রাছাড়া লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি এতটা খারাপ পর্যায়ে গেল কেন?

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: প্রথমেই বিদ্যুৎ সম্পর্কে একটি কথা বলা প্রয়োজন। বিদ্যুৎ একটি সেকেন্ডারি বা দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত জ্বালানি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক বা প্রাইমারি জ্বালানি, যেমন তেল, গ্যাস, কয়লার মতো নিঃশেষযোগ্য বা সূর্যরশ্মির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রয়োজন। একসময় বলা হতো, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ভাসছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান জ্বালানি ছিল প্রাকৃতিক গ্যাস। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে বিশেষজ্ঞরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে আসছেন যে বর্তমান হারে গ্যাস ব্যবহার অব্যাহত থাকলে ও নতুন মজুত পাওয়া না গেলে বর্তমান মজুত আগামী তিন-চার দশকেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। বাস্তবে তাই হয়েছে। গ্যাসের উল্লেখযোগ্য নতুন মজুত পাওয়া না যাওয়ায় বিদ্যমান মজুত ফুরিয়ে আসছে। বর্তমান লাগামহীন লোডশেডিংয়ের মূল কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ না করতে পারার ব্যর্থতা।

প্রশ্ন

সরকার বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও এর প্রভাবে জ্বালানির মূল্য বাড়ার কারণেই বিদ্যুৎ খাত এ সংকটে পড়েছে। বর্তমান বিদ্যুৎ-সংকটের দায় কি শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের? নাকি সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতিতেও বড় ধরনের সমস্যা ছিল বা আছে?

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভ্রান্ত নীতি ও কৌশল, ব্যবস্থাপনা, আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমন্বয়ের অভাব ও স্বজনতোষণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ অনিবার্য বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করেছে মাত্র। যুদ্ধের ফলে জ্বালানির দাম বেড়েছে এ কথা সঠিক, কিন্তু জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি বা ওঠানামা নতুন কিছু নয়। মূল সমস্যা হচ্ছে রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা, উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি ও অপচয়। ফলে সরকার বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না, তারা জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ডলার পাচ্ছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকছে এবং ক্যাপাসিটি পেমেন্টের দায় বাড়ছে। এই সবকিছু মিলিয়েই মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং, সীমাহীন জনদুর্ভোগ এবং দেশীয় ও রপ্তানি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহল থেকে এসব আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার নিজেদের কল্পিত সাফল্য নিয়ে এতটাই আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল যে এসব সতর্কবার্তায় তারা কান দেয়নি। বলা যায়, অতীতের দুষ্কর্ম এখন সরকারকে ভোগাচ্ছে।

প্রশ্ন

অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর করে ফেলা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় জ্বালানির প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হওয়ায় আমাদের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: অভিযোগটি আংশিক সত্য। প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। দেখা যায়নি নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের জন্য কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা। দেশীয় কয়লার মজুত ব্যবহারে অনাগ্রহ, কয়লা নীতি চূড়ান্ত করতে না পারা আরেকটি বড় ব্যর্থতা। ফলে জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশই, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া জ্বালানি ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের বেশি আমদানিনির্ভর। তাই জ্বালানি আমদানি সমস্যা নয়, কী দামে ও পদ্ধতিতে আমদানি করা হলো, তা-ই বিবেচ্য। এলএনজি আমদানির কথাই ধরুন না। ভূমিনির্ভর এলএনজি টার্মিনাল না করে পুরোনো জাহাজের মাধ্যমে (এফএসআরইউ) কেন আমদানি করা হলো? ভূমিনির্ভর টার্মিনাল হলে গ্যাসের মূল্যের ওঠানামা কিছুটা মোকাবিলা করা সম্ভব হতো। ঢাকা চেম্বারের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিস্টোন এর  এক গবেষণায় দেখা গেছে, এফএসআরইউর মাধ্যমে আমদানি করা গ্যাসের দাম ও জাহাজের খরচ—সবই ভারতের তুলনায় অনেক বেশি এবং পাকিস্তানের সমতুল্য। যেহেতু আমাদের পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই, তাই মধ্য মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পকারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হলে আমাদের জ্বালানি আমদানি করতে হবে, তবে তা অবশ্যই হতে হবে প্রতিযোগিতামূলক দামে।

প্রশ্ন

বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় জ্বালানি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের নীতি ও উদ্যোগ কতটা কার্যকর ছিল বলে মনে করেন?

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: প্রথমেই বিদ্যুৎ খাতের ব্যবস্থাপনায় আসি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সরকারপ্রধানের হাতে ন্যস্ত। আছেন একজন উপদেষ্টা ও একজন প্রতিমন্ত্রী। ক্ষমতার এ ত্রিকেন্দ্র বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অন্যতম প্রতিবন্ধক। নানা ব্যস্ততার কারণে স্বাভাবিকভাবেই মন্ত্রণালয় পরিচালনায় অখণ্ড মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ সরকারপ্রধানের নেই। আবার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগও নেই।

নীতি-কৌশল প্রসঙ্গে বলতে হয়, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় শিল্প ও কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা ও জনজীবনে স্বস্তি প্রদানের আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে। যেহেতু বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সময়সাপেক্ষ, তাই পাঁচ বছর এসব ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হবে। বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তৈরি হলে এগুলো বন্ধ করে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার কেবল দফায় দফায় এসব ভাড়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদই বাড়ায়নি; বরং ভাড়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে, যা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত।

এরপর যা হলো, তা আরও বিস্ময়কর। কুইক রেন্টালের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ করে এ খাতে প্রতিযোগিতাকে বিসর্জন দেওয়া হলো। যাকে অনেকেই ক্ষমতাসীন ও তাদের অনুগ্রহভাজনদের ‘কুইক মানি’ বানানোর কৌশল বলে বর্ণনা করেছেন। প্রাথমিক জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রেও মান্ধাতার আমলের পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতসহ পৃথিবীর সব দেশে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য ওঠানামার সঙ্গে একটি ফর্মুলার মাধ্যমে দেশীয় বাজারে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে তা হচ্ছে না।

প্রশ্ন

২০১০ সালের এই বিশেষ বিধান আইন বাতিল বা সংশোধন করা উচিত বলে মনে করেন কি?

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: উক্ত আইনের ৯ ও ১০ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়। আইনটির ৯ ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীন গৃহীত কোনো সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। অথচ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে ‘সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে’ বলা হয়েছে। একই সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদের ১০১ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগ ও ১০৩ অনুচ্ছেদে আপিল বিভাগের এখতিয়ার নির্ধারণ করা আছে।

এ ছাড়া উক্ত আইনের ১০ ধারায় করা সব কাজের জন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অথচ দায়মুক্তির ক্ষেত্র বিষয়ে সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। আইনের ৩ ধারা যেখানে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬-কে আলোচ্য ক্ষেত্রে অকার্যকর করা হয়েছে এবং ৫(২) ধারায় প্রতিযোগিতাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে, যা পাবলিক প্রকিউরমেন্টের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার আবশ্যকতার বিষয়ে ইংলিশ ল-র অধীন বিভিন্ন দেশে প্রদত্ত উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়।

অথচ বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি করা এ আইনের ফলাফল আমরা জানি। এর ফলে বিদ্যুৎ-ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন তো হয়নি; বরং বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ অপচয়ের অভিযোগ উঠেছে। তাই দেখা যাচ্ছে, সংবিধান ও অন্যান্য প্রচলিত আইন উপেক্ষা করে গোষ্ঠীগত স্বার্থে প্রণীত আইন জনকল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।

প্রশ্ন

চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না, অথচ সরকারকে ক্যাপাসিটি ট্যাক্স হিসেবে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিপুল অর্থ দিতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে সরকারের মুক্তির পথ কী?

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: বেসরকারি খাতকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আকৃষ্ট করার জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড তাদের উৎপাদিত সব বিদ্যুৎ ক্রয় করে থাকে। বিপিডিবির ক্রয়মূল্যের একটি অংশ এই ক্যাপাসিটি চার্জ। বেসরকারি খাত বিদ্যুৎ সরবরাহে প্রস্তুত অথচ সরকারের পক্ষে বিপিডিবি চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ নিতে পারছে না। সে জন্যই ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা, যা দিয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদক তার ঋণের কিস্তি ও অন্যান্য স্থায়ী ব্যয় বহন করবে। তাত্ত্বিক দিক থেকে বিষয়টি ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়নি। ফলে এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি। তা ছাড়া এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়েকটির মান নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মনে প্রশ্ন আছে। তাই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব কটিই বিদ্যুৎ সরবরাহে প্রস্তুত কি না, ক্যাপাসিটি চার্জ পাওয়ার যোগ্য কি না, তা যাচাই করা প্রয়োজন।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, আইপিপি বা সরকারের পক্ষে বিপিডিবির বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ ক্রয়ের নিশ্চয়তা প্রদান একটি সনাতন পদ্ধতি, যা এখন আর বহুল ব্যবহৃত নয়। এ জন্যই সরকার ২০০৮ সালে মার্চেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট বা এমপিপি নীতিমালা প্রণয়ন করে। এ নীতিমালার অধীন বেসরকারি উৎপাদক বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মূল্য ও অন্যান্য বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আবদ্ধ হবে এবং হুইলিং চার্জ প্রদানের বিনিময়ে পিজিসিবির সঞ্চালন লাইন ব্যবহার করবে। বিদ্যুতের মূল্য ক্রেতা ও বিক্রেতা নির্ধারণ করবে। সরকার সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পরিমাণ বিদ্যুৎ ক্রয়ের নিশ্চয়তা প্রদান করবে। ফলে সরকার বা বিপিডিবির এ ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জসহ দায় অনেক কম হবে। রহস্যময় কারণে বর্তমান সরকার সে পথে এগোয়নি।

প্রশ্ন

একদিকে সরকারের ওপর ক্যাপাসিটি পেমেন্টের বোঝা চেপে বসেছে, আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদকেরা বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। এ পরিস্থিতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: এখানে সরকার ও বেসরকারি উৎপাদক—সবার জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রধান যুক্তি ছিল যে এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দক্ষতা বাড়বে ও নিম্নমূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। কিন্তু এ লক্ষ্যগুলোর কোনোটাই অর্জিত হয়নি প্রতিযোগিতার পথ থেকে সরে আসা ও ‘কথিত দুর্নীতির’ কারণে। অথচ নব্বইয়ের দশকে বর্তমান সরকারের পূর্বের মেয়াদে, বেসরকারি খাতে, সর্বনিম্ন মূল্যে, সর্বোচ্চ দক্ষতার দুটি বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রের (৪৫০ মেগাওয়াট মেঘনাঘাট ও ৩৬০ মেগাওয়াট হরিপুর) চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছিল।

বেসরকারি উৎপাদকেরা ধারণা করেছিল যে তাদের সুদিন অব্যাহত থাকবে, তাদের সরকার যেকোনো পরিস্থিতিতেই বিদ্যুতের উচ্চ মূল্য পরিশোধ করতে সক্ষম হবে। কিন্তু এ ব্যবস্থা যে টেকসই নয়, তারা সে ধারণা করতে পারেনি। এখন এর দায় নিতে হবে উৎপাদকদের, তাদের প্রতিষ্ঠানে অর্থ লগ্নিকারক প্রতিষ্ঠানকে, সবশেষে নিরীহ জনগণকে অব্যাহত লোডশেডিং আর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে, যদিও তা করা হবে আত্মঘাতী।

প্রশ্ন

একটি অভিযোগ আছে যে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দিলেও বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালনব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সামগ্রিকভাবে ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের দিকে তেমন মনোযোগ দেয়নি। আপনার মন্তব্য কী?

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে কেবল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করা হয়েছে। সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থা সরকারি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে ন্যস্ত। এখানে অর্থসংকট আছে। তা ছাড়া আছে ব্যাপক অপচয় ও প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা। সমন্বয়ের অভাব রয়েছে জ্বালানির সংস্থান বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থার মধ্যে।

প্রশ্ন

কিছুদিন আগে জাতীয় গ্রিডে যে বিপর্যয় ঘটল, এর পেছনের কারণ কী? পিজিসিবির প্রতিবেদনে সমন্বয়হীনতাকে বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আপনি কী মনে করেন?

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: জাতীয় গ্রিডের কাজ হলো বিদ্যুতের উৎপাদন ও লোডের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা, ৫০ হার্টজে তা করা হয়ে থাকে। এখানে সামান্য বিচ্যুতির সুযোগ থাকে, ৪৭ দশমিক ৫ থেকে ৫১ দশমিক ৫ হার্টজ পর্যন্ত। ভারসাম্যে ব্যতিক্রম হলে উৎপাদন বাড়িয়ে বা লোড কমিয়ে এটা করা হয়। ২৪ ঘণ্টা এই ভারসাম্য রক্ষার কাজটি বিদ্যুৎ সঞ্চালন বিভাগের কর্মীরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করেন। উল্লিখিত সীমা অতিক্রম করলেই গ্রিড বিপর্যয় ঘটতে পারে। ঘোড়াশালে একটি জিআইএস সাবস্টেশনে সমস্যার কারণে সম্প্রতি এটা ঘটেছে বলে জানা গেছে।

সাইক্লোন সিডরের সময়ও আকস্মিকভাবে একসঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যায়। অত দ্রুত উৎপাদন কমাতে না পারায় ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় ও বিদ্যুৎ গ্রিড বিপর্যয় ঘটে। সে সময় গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানের জন্য বুয়েটের অধ্যাপকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ভবিষ্যৎ গ্রিড বিপর্যয় রোধে কয়েকটি সুপারিশ করে, এর মধ্যে একটি ছিল অটোমেটেড জেনারেশন কন্ট্রোল বা এজিসি স্থাপন। যাতে করে নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র থেকেই বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া যায়। বর্তমানে টেলিফোনে নির্দেশের মাধ্যমে এ কাজ করা হয়, যা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এজিসি স্থাপনের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। কেবল প্রকৌশলীদের বলির পাঁঠা বানিয়ে ভবিষ্যৎ গ্রিড বিপর্যয় রোধ করা যাবে না।

প্রশ্ন

বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি চাইলেই দ্রুত বদলে ফেলা যাবে না। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নয়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে কী কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: বর্তমান সরকারের দীর্ঘ মেয়াদকালে বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নের সুযোগ ছিল। এ সময় প্রাথমিক জ্বালানির মূল্য ও বৈশ্বিক অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল। তারা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এখন খাদের কিনারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। ১. সরকারপ্রধানের বদলে একজন সৎ ও পেশাদার পূর্ণমন্ত্রীকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। ২. বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ অবিলম্বে বাতিল করে এ খাতের সব সংগ্রহ উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে করতে হবে। ৩. জ্বালানি আমদানি হ্রাস করার জন্য নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। ৪. অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশীয় কয়লার মজুত ব্যবহার করার জন্য কয়লা নীতি চূড়ান্ত করতে হবে। ৫. ভাসমান জাহাজের মাধ্যমে এলএনজি সংগ্রহে ভূমিতে এলএনজি প্ল্যান্ট স্থাপন করতে হবে। ৬. রেন্টাল, কুইক রেন্টাল প্রকল্পগুলোর নবায়ন বন্ধ করতে হবে। ৭. আইপিপির পরিবর্তে এমপিপির মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সম্পৃক্ত করতে হবে। ৮. নিরপেক্ষ ক্যাপাসিটি টেস্টের মাধ্যমে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি নির্ধারণ করতে হবে। ৯. গ্রিড বিপর্যয় এড়ানোর জন্য এজিসি সংগ্রহ করাসহ জাতীয় লোড ডেসপাচ সেন্টারের আধুনিকায়ন করতে হবে। ১০. বিদেশি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী চুক্তির ন্যায্যতা পরীক্ষা করতে হবে। ১১. প্রাথমিক জ্বালানি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থার সমন্বিত উন্নয়নের জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে তা অনুসরণ করতে হবে।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।