ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে সবচেয়ে বড় যে ভয়টি বিশ্বকে তাড়া করে ফিরছে সেটি হলো, এমন কোনো ঘটনা ঘটবে কি না, যাতে যুদ্ধের গতিমুখ নাটকীয়ভাবে মোড় নেয়।
এটি কোনো অমূলক ভয় নয়, বিশেষ করে যখন ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে একের পর যুদ্ধোন্মাদনাকর বক্তব্য আসছে। পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা এ সময়ে সংবাদমাধ্যমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। কিন্তু ন্যাটোর কোনো সদস্যরাষ্ট্রে হামলা হলে সেটাই বড় পরিসরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হবে।
গত কয়েক মাসে ক্রেমলিনের প্রপাগান্ডাগুলো ন্যাটো যদি বিশ্লেষণ করে তাহলে কী দেখতে পাবে? ক্রেমলিনের প্রোপাগান্ডার মূল বিষয় হলো, পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়া একটি অস্তিত্বগত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। এখন ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী পোল্যান্ডের গ্রামে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটল, তাতে দুজন নিহত হয়েছেন।
ইউক্রেনের সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে রাশিয়া যখন ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র (১০০-এর মতো) হামলা চালাচ্ছিল, সে সময়েই পোল্যান্ডে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, যুদ্ধের নাটকীয় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এই বিস্ফোরণ কি তবে চূড়ান্ত মুহূর্ত হতে চলেছে?
এই মুহূর্তে যে ঘটনাপ্রবাহ, তাতে তেমনটা হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এ ঘটনা বড় সংকটের বৃত্ত তৈরি করল। আর বড় কোনো সংঘাত এড়াতে খুব সতর্ক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর বিপদে কীভাবে পাশে দাঁড়াচ্ছে এবং প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা রক্ষা করছে, প্রকৃতপক্ষে তার ওপরেই পশ্চিমের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে। সেটা অর্জন করতে হলে এখন জোরালো বিবৃতি কিংবা রাশিয়ার ওপর আরও কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার চেয়ে বেশি কিছু করতে হবে। ন্যাটো এখন যেসব পদক্ষেপ নেবে, অনিবার্যভাবেই এগুলো তার অংশ হবে। কিন্তু আরও সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার চাপ ন্যাটোর ওপর রয়েছে।
ন্যাটোর কোনো সদস্যরাষ্ট্র যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে বাকি সদস্যরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাতে পদক্ষেপ নেবে, এমন জনপ্রিয় ধারণা প্রচলিত আছে। ন্যাটো চুক্তির ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে কি স্পষ্ট করে উল্লেখ নেই যে কোনো একটি সদস্যরাষ্ট্রের ওপর হামলা হলে সেটা বাকি সদস্যের ওপর হামলা বলে বিবেচিত হবে? ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ১/১১-এর হামলার পর অনুচ্ছেদ-৫-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
তাহলে এখন ব্যতিক্রম কেন হবে? একটা বিষয় হলো, অনুচ্ছেদ-৫-এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা এখনো ত্রুটিপূর্ণ। হতে পারে রাশিয়ার তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র (অন্য ক্ষেপণাস্ত্রও হতে পারে) লক্ষ্যবস্তু ভুল করেছে। এমনটাও হতে পারে, রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রটির লক্ষ্যবস্তু ছিল পশ্চিম ইউক্রেনের শহর লিভের বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র। কিন্তু ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সেটা ঠেকাতে গিয়ে এর গতিমুখের পরিবর্তন হয়ে গেছে।
প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ যা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ক্ষেপণাস্ত্রটির ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে রাশিয়ার তৈরি ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থার সঙ্গে অনেক বেশি মিল রয়েছে। ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও শত্রুবিমান ভূপাতিত করতে ইউক্রেন এটি ব্যবহার করে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ন্যাটো চুক্তির ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ সাদা-কালো কোনো বিষয় নয়। এ অনুচ্ছেদের মধ্যে যে নমনীয়তা ও ব্যাখ্যার জন্য যে পরিসর রয়েছে, সেটা খুব ভালো একটা বিষয়। পোল্যান্ড এখন ন্যাটো চুক্তির ৪ নম্বর অনুচ্ছেদটি ধরে এগোবে। নিজ ভূখণ্ডে হামলার ঘটনা জানাতে ন্যাটোকে জরুরি সভা ডাকার অনুরোধ করবে। সেই সভায় পোল্যান্ড অনুচ্ছেদ-৫ অনুযায়ী সদস্যদেশগুলো যাতে সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নেয়, সেই দাবি করতে পারে। কিন্তু সামরিকসহ এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে সেটা ধাপে ধাপে নিতে হবে। বললাম আর হয়ে গেল, তেমনটা নয়।
অন্যদিকে ক্রেমলিন ও এর অনুগত গণমাধ্যম খুব অনুমানযোগ্যভাবেই উদ্ভট কিছু দাবি নিয়ে হাজির হবে। এর প্রধান বিষয়বস্তু হতে পারে ইউক্রেন নিজেরাই এ হামলা চালিয়েছে, যাতে ন্যাটোর নজর কাড়া যায়। যদিও এরই মধ্যে রাশিয়ার প্রধান প্রপাগান্ডাকারী মার্গারিটা সিমোইয়ান দাবি করেছেন, এটা ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্র অথবা যুদ্ধ যাতে বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে, সে জন্য পোল্যান্ড এটা করেছে। রাশিয়ার দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশ্য করে এ ধরনের ভুয়া জল্পনা নিরাপদে ছড়িয়ে দেওয়া যেতেই পারে।
কিন্তু পশ্চিমের পুতিনের প্রতি সহানুভূতিশীল লোকদেরও এ ধরনের প্রচারণা বিশ্বাস করানো কঠিন। এর বিপরীতে ইউক্রেনের দিকটা বিবেচনা করলে বলা যাবে, ন্যাটোর সম্পৃক্ততা ছাড়া ইউক্রেনের সেনাবাহিনী অনেক ভালো করছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে রাশিয়ার অসম্মানজনক পরাজয় এবং খেরসন থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহারের ঘটনা সেটা স্পষ্ট করে দেয়।
একগুচ্ছ করণীয় এখন ন্যাটোর টেবিলে। ন্যাটোকে এমন সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে মনে হয়, ঘটনার মীমাংসা তারা করেছে, তাতে ইন্ধন বা প্ররোচনা দিচ্ছে না। এ ব্যাপারে তাদের অতিমাত্রায় সতর্ক থাকতে হবে যে ন্যাটোর একটি সদস্যরাষ্ট্র আক্রান্ত হয়েছে আর ক্রেমলিন যেন সেটিকে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ না পায়।
একই সঙ্গে আবার পশ্চিমা নেতাদের এখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে দেখাতেও হবে যে তাঁর কারণে শুরু হওয়া যুদ্ধের জন্যই ন্যাটোর একটি সদস্যরাষ্ট্রে এই ধ্বংস ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এটা তাঁরা কোনোভাবেই সহ্য করছেন না।
পরিশেষে ন্যাটোকে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যেটা জোটের প্রতি পোল্যান্ডের পূর্ণমাত্রায় আস্থা বজায় থাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ ন্যাটোর নেতারা বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন যে ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্রগুলোর জোরালো প্রতিরক্ষা দেওয়া হবে।
বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর বিপদে কীভাবে পাশে দাঁড়াচ্ছে এবং প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা রক্ষা করছে, প্রকৃতপক্ষে তার ওপরেই পশ্চিমের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে। সেটা অর্জন করতে হলে এখন জোরালো বিবৃতি কিংবা রাশিয়ার ওপর আরও কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার চেয়ে বেশি কিছু করতে হবে।
ন্যাটো এখন যেসব পদক্ষেপ নেবে, অনিবার্যভাবেই এগুলো তার অংশ হবে। কিন্তু আরও সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার চাপ ন্যাটোর ওপর রয়েছে। এর মধ্যে পোল্যান্ডে ন্যাটোর সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা এবং আরও বেশি যুদ্ধের মহড়া প্রদর্শন করতে হবে।
আরও কিছু পদক্ষেপও বিবেচনা করা যেতে পারে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বেশ কয়েকবার পশ্চিমের কাছে অগ্রসর প্রযুক্তির আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছেন। সম্ভবত এখন সেটা দেওয়ার সময় এসেছে। জেলেনস্কি যখন যুক্তি দিয়ে বলছেন, ইউক্রেনের নাগরিকদের জীবন বাঁচানোর উপায় খুঁজছেন, তখন এ ধরনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তাঁদের কাছে দেওয়ার জন্য শক্ত একটি যুক্তি।
পরিশেষে, ন্যাটোকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে পুতিন যুদ্ধ-সম্পর্কিত একেবারে গোড়ার শিক্ষাটি পান। তা হলো যুদ্ধ যারা শুরু করে, খুব কম ক্ষেত্রেই তারা বিজয়ী হতে পারে।
ম্যাথিউ সাসেক্স অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডিফেন্স স্টাডিজ সেন্টারের ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ মনোজ দে